বাশার পতনে বছরজুড়ে পরিকল্পনা

সিরিয়ার সদ্য ক্ষমতাচু্যত প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতন ঘটাতে এক বছর ধরে পরিকল্পনা করা হয় বলে জানিয়েছেন দেশটির প্রধান বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) সামরিক শাখার প্রধান আবু হাসান আল-হামুই। শুক্রবার গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা জানান তিনি। বাশার আল-আসাদের ৫৪ বছরের শাসনের পতনের পর প্রথমবারের মতো বিদেশি গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন তিনি। প্রতিবেদনে বলা হয়, সিরিয়ান বিদ্রোহীরা এক বছরের পরিকল্পনার মাধ্যমে সামরিক অভিযান শুরু করেছিল, যা বাশার শাসনের পতন ঘটায়। অত্যন্ত শৃঙ্খলাবদ্ধ এই অভিযানে নতুন একটি ড্রোন ইউনিট ব্যবহার করা হয় এবং দেশের বিভিন্ন স্থানের বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সমন্বয় ছিল বলে জানিয়েছেন প্রধান বিদ্রোহী গোষ্ঠীর শীর্ষ সামরিক কমান্ডার আবু হাসান আল-হামুই। এইচটিএসের সামরিক শাখার প্রধান জানান, তার দলের যারা দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থান করছিল, কীভাবে দক্ষিণের বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে একটি ঐক্যবদ্ধ যুদ্ধকক্ষ তৈরি করেছিল, যার লক্ষ্য ছিল উভয় দিক থেকে দামেস্ককে ঘিরে ফেলা। আল-হামুই বলেন, 'বাশারকে উৎখাতের জন্য আগ্রাসন প্রতিরোধ নামে অভিযানের পরিকল্পনা এক বছর আগে শুরু হলেও, এই দলটি বহু বছর ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছিল।' ২০১৯ সাল থেকে এইচটিএস একটি সামরিক মতবাদ গড়ে তুলছিল, যা বিভিন্ন বিরোধী এবং জিহাদি গোষ্ঠীর বিশৃঙ্খল যোদ্ধাদের একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ বাহিনীতে পরিণত করেছিল। গত পাঁচ বছর ধরে সামরিক শাখার নেতৃত্ব দেওয়া আল-হামুই বলেন, '২০১৯ সালের আগস্টে শেষ অভিযানের পর আমরা উলেস্নখযোগ্য অঞ্চল হারিয়েছি। সব বিপস্নবী গোষ্ঠী উপলব্ধি করেছিল, মূল সমস্যা ছিল নেতৃত্ব এবং যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণের অভাব।' ২০১৯ সালে সিরিয়ান শাসনবিরোধী বাহিনীর বিরুদ্ধে একটি অভিযান চালায়, যা বিরোধী দলগুলোকে ইদলিব প্রদেশে ঠেলে দেয়। এরপর ২০২০ সালের বসন্তে তুরস্কের মধ্যস্থতায় বিরোধীদের পক্ষে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়। বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে, এইচটিএস অন্য দলগুলোকে তাদের অধীনে একীভূত হওয়ার প্রস্তাব দেয় এবং অস্বীকৃত দলগুলোর সঙ্গে লড়াই করে। ধীরে ধীরে, তারা উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ায় প্রধান শক্তি হয়ে ওঠে। আল-হামুই বলেন, 'আমরা শত্রম্নকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছি এবং সেই বিশ্লেষণের ভিত্তিতে আমাদের বাহিনীকে উন্নত করেছি।' বিদ্রোহীদের নিয়ে গঠিত এই দলটি ধীরে ধীরে একটি সুশৃঙ্খল যুদ্ধ বাহিনীতে পরিণত হয়। সামরিক শাখা, ইউনিট এবং নিরাপত্তা বাহিনী তৈরি করা হয়। এইচটিএস তার নিজস্ব অস্ত্র, যানবাহন এবং গোলাবারুদ তৈরি করতে শুরু করে। ড্রোন ইউনিট তৈরি করে, যেখানে প্রকৌশলী, মেকানিক এবং রসায়নবিদরা একত্রে কাজ করেন। ২০১৯ সাল থেকে তারা ড্রোন তৈরি শুরু করে, যার মধ্যে রেইকন ড্রোন, আক্রমণ ড্রোন এবং আত্মঘাতী ড্রোন ছিল। এইচটিএসের ড্রোনগুলোর সর্বশেষ মডেল ছিল 'শাহিন' ড্রোন, যার অর্থ আরবি ভাষায় 'বাজপাখি'। বাশারের পতনে প্রথমবারের মতো এই ড্রোন ব্যবহার করা হয় এবং এটি শাসনের সামরিক যানগুলোকে অকার্যকর করতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। এক বছর আগে এইচটিএস দক্ষিণের বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে একটি অভিন্ন যুদ্ধকক্ষ তৈরি করতে সাহায্য করে। ২০১৮ সাল থেকে দক্ষিণ সিরিয়া বাশারের শাসনের অধীনে ছিল। তবে, এইচটিএসের সহায়তায় দক্ষিণের ২৫টি বিদ্রোহী দল মিলে একটি সমন্বিত যুদ্ধকক্ষ গঠন করা হয়। নভেম্বরের শেষ দিকে তারা অভিযান শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়। ২৯ নভেম্বর আলেপ্পোতে প্রবেশ করে এবং কয়েক দিনের মধ্যে হোমস এবং হামা দখল করে। দক্ষিণের বিদ্রোহীরা উত্তেজনার কারণে আগেভাগেই বিদ্রোহ শুরু করে এবং দামেস্কে পৌঁছে যায়। এরপর ৮ ডিসেম্বর বাশার আল-আসাদ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। আল-হামুই মূলত একজন কৃষি প্রকৌশলী, যিনি দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেন। বাশারের শাসনামলে পরিবারসহ তিনি ইদিলিব থেকে বাস্তুচু্যত হন। আল-হামুই নতুন বেসামরিক সরকারে কাজ করবেন বলে জানান। তবে নতুন দেশ গঠনের কাজ সহজ হবে না বলেও স্বীকার করেন তিনি। ইসলামপন্থি গোষ্ঠী তাদের নিজস্ব মতবাদ চাপিয়ে দিতে পারে বলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা আশঙ্কা করছে বলেও জানান তিনি।