গাজায় জাতিগত নিধনের আশঙ্কা, মধ্যপ্রাচ্যে উদ্বেগ

ফিলিস্তিনিদের জর্ডান-মিসরে পাঠাতে ট্রাম্পের প্রস্তাব

প্রকাশ | ২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
গাজায় ৮৫ শতাংশ বাসিন্দা বাস্তুচু্যত -ফাইল ছবি
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রস্তাব আকারে বলেছেন গাজার ২৩ লাখ ফিলিস্তিনিকে জর্ডান এবং মিসরে স্থানান্তর করার বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত। ১৫ মাস ধরে চলা যুদ্ধের কারণে বিধ্বস্ত গাজার জন্য এই পরিকল্পনা স্থানীয় বাসিন্দাদের পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশগুলোতেও উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ খবর জানিয়েছে। ট্রাম্পের প্রস্তাব ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ১৯৪৮ সালের নাকবার স্মৃতি আবার উসকে দিয়েছে। তখন ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় সাত লাখ ফিলিস্তিনি তাদের ভূমি থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন। অনেকে জর্ডান, সিরিয়া ও লেবাননের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন। গাজায় বর্তমান সংঘাতে ইসরাইলের নজিরবিহীন বোমাবর্ষণ এবং স্থল অভিযান শহরাঞ্চলকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। ফিলিস্তিনি ও জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের মতে, গাজায় আর নিরাপদ স্থান অবশিষ্ট নেই। আক্রমণের আগে গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে বাসিন্দাদের দক্ষিণাঞ্চলে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয় ইসরাইল। কিন্তু এরপরে দক্ষিণাঞ্চলকেও লক্ষ্যবস্তু করা হয়। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, গাজার ২৩ লাখ মানুষের ৮৫ শতাংশ ইতোমধ্যে বাস্তুচু্যত হয়েছে। গাজার বহু ফিলিস্তিনি মনে করেন, তারা যদি এই অঞ্চল ছাড়েন তবে তা ১৯৪৮ সালের পুনরাবৃত্তি ঘটাবে। অন্যদিকে মিসর সীমান্ত বন্ধ রেখেছে এবং শুধু বিদেশি ও দ্বৈত নাগরিকদের প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে। মিসর ও আরব দেশগুলো ফিলিস্তিনিদের অন্যত্র সরিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টার ঘোর বিরোধিতা করে। তারা মনে করে, এটি দুই-রাষ্ট্র নীতির সম্ভাবনাকে ক্ষুণ্‌ণ করবে এবং মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতা বাড়াবে। যুদ্ধের শুরু থেকেই মিসর ও জর্ডানের মতো আরব দেশগুলো ফিলিস্তিনিদের তাদের ভূমিতে থেকে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘের কর্মকর্তারা বলছেন, গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া মানবিক সংকটকে আরও তীব্র করবে। ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ বলেছেন, গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের বিতাড়নের কোনও পরিকল্পনা নেই। তবে, সরকারের কিছু সদস্য বাস্তুচু্যতি নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন। অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মট্রিচ এবং জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতমার বেন-গভির গাজার বাসিন্দাদের অন্যত্র সরিয়ে দেওয়ার পক্ষে কথা বলেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, তিনি গাজাকে খালি করতে চান। অবরুদ্ধ এই উপত্যকা থেকে আরও ফিলিস্তিনিদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য মিশর এবং জর্ডানকে আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। তবে তার এমন প্রস্তাবের কারণে গাজায় জাতিগত নিধনের আশঙ্কা করা হচ্ছে। খবর আল জাজিরার। শনিবার প্রেসিডেন্টকে বহনকারী এয়ার ফোর্স ওয়ানের ফ্লাইটে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ট্রাম্প জানান, তিনি জর্ডানের রাজা দ্বিতীয় আবদুলস্নাহর সঙ্গে ফোনে আলাপ করেছেন। রোববার মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসির সঙ্গেও তার আলাপ হওয়ার কথা। ট্রাম্প বলেন, আমি মিশরকে আহ্বান করছি গাজা থেকে লোকজনকে আশ্রয় দেবেন। আপনারা সম্ভবত ১৫ লাখ মানুষের কথা বলছেন। আমরা কেবল পুরো জিনিসটাকে পরিষ্কার করে বলি। আপনারা জানেন, এখানে সব শেষ। ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের সফলভাবে গ্রহণ করার জন্য জর্ডানের প্রশংসা করেছেন ট্রাম্প। তিনি জর্ডানের রাজাকে বলেন, আমি চাই আপনারা আরও বেশি ফিলিস্তিনিদের আশ্রয় দেবেন। কারণ আমি এখন পুরো গাজা উপত্যকার দিকে তাকিয়ে আছি, সেখানে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ইসরাইলি বাহিনীর গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের কারণে গাজার প্রায় ২৩ লাখ মানুষ বাস্তুচু্যত হয়ে পড়েছে। দখলদার বাহিনীর হামলার কারণে ফিলিস্তিনিদের প্রতিনিয়ত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। ট্রাম্প বলেছেন, গাজার বাসিন্দাদের সাময়িকভাবে বা দীর্ঘমেয়াদে স্থানান্তর করা যেতে পারে। তিনি বলেন, এটি এখন আক্ষরিক অর্থে একটি ধ্বংসস্তুপ। প্রায় সবকিছুই ভেঙে ফেলা হয়েছে এবং সেখানে মানুষ মারা যাচ্ছে। সুতরাং আমি কিছু আরব দেশের সাথে যুক্ত হতে চাই এবং একটি ভিন্ন জায়গায় আবাসন তৈরি করতে চাই যেখানে ফিলিস্তিনিরা শান্তিতে থাকতে থাকতে পারবে। তবে কাতারের জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবদুলস্নাহ আল-আরিয়ান আল জাজিরাকে বলেছেন যে, ইসরাইলি কর্মকর্তারা ফিলিস্তিনি ভূখন্ডে যুদ্ধের শুরুতেই যতটা সম্ভব দ্রম্নত সময়ে 'জাতিগত নিধনের' ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। কিন্তু নানা কারণে তাদের সেই পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। তাছাড়া ফিলিস্তিনিরা নিজেরাও ট্রাম্পের এমন প্রস্তাবে আগ্রহী হবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ এসব ফিলিস্তিনিরা ভালো করেই জানেন যে, তাদের ভূমি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার মানে কি হবে। এই ভূমির অধিকার রক্ষার জন্য গত ৭০ বছর ধরে ফিলিস্তিনি নারী, শিশু, বৃদ্ধ এবং তরুণরা জীবন দিয়ে যাচ্ছেন। এভাবে সবকিছু ছেড়ে তারা অন্যত্র আশ্রয় নেবেন না। এদিকে উগ্র ডানপন্থী ইসরাইলি অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ গাজার বাসিন্দাদের মিশর ও জর্ডানে স্থানান্তরের বিষয়ে ট্রাম্পের প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ভালোভাবে জীবন শুরু করার জন্য অন্য জায়গা খুঁজে পেতে তাদের সাহায্য করার পরিকল্পনাটি দুর্দান্ত। অন্য জায়গায় তারা নতুন ভাবে উন্নত জীবন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে। গাজা উপত্যকার বাসিন্দাদের মিশর ও জর্ডানে স্থানান্তরের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবকে 'শত্রম্নতাপূর্ণ পদক্ষেপ' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন জর্ডানের বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এই পরিকল্পনা দুই মার্কিন মিত্র দেশের বিরুদ্ধে এবং ফিলিস্তিনের ইসু্যকে 'প্রশমিত' করার উদ্দেশ্য ছাড়া কিছু নয়।