বিশ্লেষণ

কাশ্মীর আরও গভীর সংকটে

প্রকাশ | ১৮ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
কড়া নিরাপত্তার চাদরে বেষ্টিত শ্রীনগরের এই সড়ক
বিগত প্রায় সত্তর বছর ধরে যা চলে আসছিল, এক ঝটকায় ভারত-শাসিত কাশ্মীরের সেই বিশেষ মর্যাদা ছিনিয়ে নিয়ে দিলিস্নর নরেন্দ্র মোদি সরকার যে বড় ঝুঁকি নিয়েছে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এই পদক্ষেপের পরিণাম যে কী হতে চলেছে, তা এখনো অনেকটাই অনুমানসাপেক্ষ। কাশ্মীরের বেশিরভাগ মানুষ এই সিদ্ধান্তে যে প্রবল ক্ষুব্ধ, তা আর গোপন নেই, এবং এর ফলে উপত্যকায় সশস্ত্র বিক্ষোভ নতুন করে প্রসার পাবে কি-না, সে প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে। আবদুলস্নাহ বা মুফতি পরিবারের মতো কাশ্মীরের 'ভারতপন্থী' রাজনীতিকদের কিংবা হুরিয়ত কনফারেন্সের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের প্রাসঙ্গিকতা কতটা বজায় থাকবে, সেটাও বেশ অস্পষ্ট। তবে সবচেয়ে বড় কথা, লাখ লাখ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করে কাশ্মীরকে বাকি ভারতের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে মিশিয়ে দেয়ার যে উদ্যোগ দিলিস্ন নিয়েছে, তা আদৌ সফল হবে কি-না, মূলত সেটাই এখন দেখার বিষয়। ভারত সরকার কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেয়ার পর প্রায় সবাই নিশ্চিত, কারফিউ একবার উঠলেই উপত্যকা গর্জে উঠবে। শ্রীনগরের বাডগামের বাসিন্দা আশরাফ-মুদাসসরারা বলছিলেন, 'মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই কাশ্মীরের প্রতিটা জেলায় মুসলমানদের হেনস্থা করা হচ্ছে। গর্ভবতী মহিলারা পর্যন্ত হাসপাতালে যেতে পারছেন না। তলস্নাশি-চৌকি আর ফৌজি ব্যারিকেডে আমাদের স্বাভাবিক জীবন-যাপন বিপর্যস্ত হয়ে উঠছে।' স্থানীয় যুবক বিলাল আহমেদ ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে দ্বিধা করলেন না, 'অমিত শাহের কথামত কাশ্মীরের ৮০ শতাংশ মানুষের যদি এই সিদ্ধান্তে সমর্থন থাকে, তাহলে মাত্র ৮ মিনিটের জন্য তিনি কারফিউ তুলেই দেখুন না কী হয়!' এখন প্রশ্ন, ৩৭০ ধারা বিলোপের সবশেষ আঘাত কি তাদের অস্ত্র হাতে তুলে নিতে উৎসাহিত করবে? কাশ্মীরের প্রবীণ শিক্ষাবিদ হামিদা নাঈম বানো বলেন, 'গত দুই-তিন বছরে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী কাশ্মীরে হাজারের ওপর কিশোর-যুবককে খতম করেছে। এটা তো বুঝতে হবে, এই দুর্বিষহ জীবনে হতাশ হয়েই কাশ্মীরিরা বন্দুক হাতে তুলে নিচ্ছে। নইলে কেন শিক্ষিত, প্রতিভাবান তরুণরা এমনি এমনি নিজেদের জীবন শেষ করে দিতে যাবে?' বছর তিনেক আগে বিদ্রোহী নেতা বুরহান ওয়ানির মৃতু্য যেভাবে কাশ্মীরি তরুণদের দলে দলে সশস্ত্র পথে আসতে উদ্বুদ্ধ করেছিল, এখন রাতারাতি ৩৭০ ধারা মুছে দেয়ার সিদ্ধান্তও একই ধরনের ট্রিগারের কাজ করবে বলে অনেকেই মনে করছেন। শ্রীনগরের রাজপুরায় গওহর বাট বলেন, 'তরুণদের যদি সরকার পাশে চায়, তাহলে তাদের স্বপ্নটা কী, তা তো বুঝতে হবে। তা না করে আপনি দুম করে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নিলেন, এর লাভ-ক্ষতি কী হবে, সেটা তরুণদের বোঝানোর কোনো চেষ্টাই করলেন না। তা ওরা তো বিগড়ে যাবেই।' কাশ্মীরি তরুণদের সশস্ত্র পথের দিকে ঝোঁকার আরেকটা বড় কারণ হলো বহু বছর ধরে সেখানে যারা রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন, তাদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন আছে। বাদামিবাগ এলাকার ব্যবসায়ী ইরফান জাভিদ বলেন, 'এই ফারুক আবদুলস্নাহর পরিবারকেই দেখুন না। যাদের ভরসায় গত ৭০ বছর ধরে দিলিস্ন এখানে রাজত্ব করল, তাদেরকেও আজ প্রমাণ দিতে হচ্ছে তারা ভারতীয় কি-না। আবদুলস্নাহ পরিবারের এই হাল হলে সাধারণ কাশ্মীরিদের কী অবস্থা বুঝতেই পারছেন।' দিলিস্নর নিরাপত্তা থিঙ্কট্যাঙ্ক বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো শ্রীরাধা দত্ত মনে করছেন, এই পটভূমিতে এখন ভারত সরকারের প্রচ্ছন্ন মদদে কাশ্মীরে নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্বকে উঠিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে। কিন্তু কাশ্মীরে দিলিস্নর সমর্থনপুষ্ট কোনো নতুন রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব হলেই কি বাকি ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের আত্মিক যোগাযোগ সম্ভব? কাশ্মীরের নবীন রাজনীতিবিদ ও জেএনইউর সাবেক ছাত্র-নেত্রী শেহলা রশিদ মনে করেন, 'এই তথাকথিত ঐক্যবদ্ধতার তত্ত্বটা একেবারেই অবাস্তব।' সমস্যা হলো, ৩৭০ ধারা বিলোপের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত কাশ্মীরের ওপর আচমকাই চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, ভারত সেখানে কাশ্মীরের মতামত নেয়ার কোনো প্রয়োজন বোধ করেনি। কাশ্মীরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ প্রাণপণে তা রুখতে চাইছে, ফলে সেই সংঘাতের পরিণতি উপত্যকায় শান্তি ও সমৃদ্ধি ডেকে আনবে, তা এখন বিশ্বাস করা রীতিমত অসম্ভবই মনে হচ্ছে। সংবাদসূত্র : বিবিসি নিউজ