টিপুকে মুছে ফেলছে বিজেপি

প্রকাশ | ১৮ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
যাযাদি ডেস্ক ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে প্রাণ হারানো দক্ষিণ ভারতের মহীশূরের রাজা টিপু সুলতান সম্পর্কে যা যা লেখা আছে কর্ণাটকের স্কুলে ইতিহাসের পাঠ্য বইগুলোতে, তা সরিয়ে দেয়ার কথা ভাবছে সে রাজ্যের সরকার। বর্তমানে কর্ণাটকে বিজেপির সরকার ক্ষমতাসীন। মুখ্যমন্ত্রী বিএস ইয়েদুরাপ্পা জানিয়েছেন, 'টিপু জন্ম-জয়ন্তী আগেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। স্কুলপাঠ্য বইতে যা রয়েছে টিপু সুলতানের সম্পর্কে, সেগুলোও সরিয়ে দেয়ার কথা ভাবছি আমরা।' সিদ্ধান্ত নেওয়া যে সময়ের অপেক্ষা, সেটাও উলেস্নখ করেছেন তিনি। বিজেপির এক নেতা এর আগে দাবি করেছিলেন, টিপু সুলতানকে যেভাবে গৌরবান্বিত করা হয় স্কুলের পাঠ্য বইগুলোতে, তা বন্ধ করা উচিত। তিনি হিন্দুদের ওপর সাংঘাতিক অত্যাচার করতেন বলেও মন্তব্য করেছিলেন কোডাগু জেলা থেকে নির্বাচিত বিধানসভা সদস্য বিজেপির এ. রঞ্জন। টিপু সুলতানের ওপর বহুদিন ধরে গবেষণা করেছেন মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সেবাস্টিয়ান যোসেফ। তিনি বলেন, 'টিপু সুলতানকে ভারতীয় ইতিহাসের একজন 'খলনায়ক' হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। তাকে নিয়ে যা বলা হচ্ছে, সেগুলো রাজনৈতিক কথাবার্তা। টিপু সুলতানকে একজন খলনায়ক করে তোলার এই প্রচেষ্টাটা কয়েক বছর ধরেই শুরু হয়েছে।' এই প্রথম নয়, এর আগেও কর্নাটকে সরকারিভাবে যে টিপু জয়ন্তী পালিত হতো, তাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বিজেপির আমলে। বিজেপি এবং হিন্দু পুনরুত্থানবাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস মনে করে, টিপু সুলতান কুর্গ, মালাবারসহ নানা এলাকায় কয়েক লাখ হিন্দুকে মেরে ফেলেছিলেন এবং বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করেছিলেন। আরএসএসের মতাদর্শে বিশ্বাস করে, এমন একটি সংগঠন 'ইতিহাস সংকলন সমিতি'র পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং ইতিহাসের অধ্যাপক রবিরঞ্জন সেন বলেন, 'বাস্তবে যা যা করেছেন টিপু সুলতান- তার সবটাই থাকা উচিত। তিনি যেমন ধর্মীয় নিপীড়ন চালিয়েছেন, তেমনই বলপূর্বক ধর্মান্তকরণও করিয়েছেন। এগুলো ঐতিহাসিক সত্য। তার যদি কিছু অবদান থেকে থাকে, সেগুলোর সঙ্গে নেতিবাচক দিকগুলোও থাকা দরকার।' রবিরঞ্জনের মতে, অনেক সময়েই পাঠ্য-পুস্তকে একপেশে, একধরনের ইতিহাস লেখা হয়ে এসেছে। কিন্তু তার জীবন আর শাসনামলের দুটি দিকই তুলে ধরা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। টিপু সুলতান যে হিন্দুদের ওপরে নিপীড়ন চালিয়েছিলেন বা লাখ লাখ হিন্দুকে মেরে ফেলেছিলেন বলে আরএসএস যে দাবি করে, তা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন অধ্যাপক যোসেফ। তার মতে, 'টিপু সুলতানকে নিয়ে যত গবেষণা হয়েছে, তাতে এ রকম তথ্য বিশেষ পাওয়া যায় না যে, তিনি নির্দিষ্টভাবে হিন্দুদের ওপরেই অত্যাচার করেছিলেন। কুর্গ বা মালাবার উপকূলে যুদ্ধ নিঃসন্দেহে হয়েছিল সেখানকার হিন্দু শাসকদের সঙ্গে। এবং সেই যুদ্ধে অনেক হিন্দুর যে প্রাণ গিয়েছিল, সেটা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু সেটাকে একটা ধর্মীয় অত্যাচার বলা ভুল।' যোসেফ বলেন, মহাভারতের কাহিনীতে তো যারা নিহত হয়েছিলেন, তারাও হিন্দু ছিলেন। আবার মারাঠারা যখন মহীশূর দখল করতে এসেছিল, তখন তারা অতি পবিত্র হিন্দু তীর্থ শৃঙ্গেরি মঠ ধ্বংস করে দিয়েছিল, এমনকি বিগ্রহটিও ধ্বংস করে দেয় তারা। শৃঙ্গেরি মঠ পুনর্নিমাণে অর্থ দিয়েছিলেন টিপু সুলতান। এগুলোকে তো ধর্মীয় নিপীড়ন বলা যায় না। টিপু সুলতান যখন ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধে যেতেন, রাজ্যের সর্বেসর্বা হয়ে শাসন চালাতেন একজন হিন্দু- পুন্নাইয়া। আবার মালাবার দখল করার সময়েও টিপুর সেনাপতি ছিলেন শ্রীনিবাস রাও- তিনিও হিন্দু। অধ্যাপক যোসেফের যুক্তি, 'টিপুর পরেই যার হাতে সব ক্ষমতা, সেই পুন্নাইয়া, কুর্গে হিন্দুদের ওপরে অত্যাচার করতে দিয়েছেন, এটা কি যুক্তিগ্রাহ্য বা হিন্দু হয়েও শ্রীনিবাস রাও মালাবারে হিন্দুদের ধর্মান্তকরণ করানোতে মদদ দিয়েছিলেন, সেটা কি মেনে নেওয়া যায়?' টিপু সুলতান ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হওয়ার পর তার ১২ পুত্র এবং পরিবার-পরিজন সবাইকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেয় ব্রিটিশ সরকার। সেই থেকে কলকাতাতেই টিপুর পরিবারের বসবাস। শহরের সবচেয়ে পরিচিত 'টিপু সুলতান মসজিদ' যেমন কলকাতাতেই, তেমনই তার ছেলে আনোয়ার শাহ এবং পরিবারের আরও কয়েকজনের নামে রয়েছে শহরের বড় বড় কয়েকটি রাস্তার নাম। সংবাদসূত্র : বিবিসি নিউজ