বিশেষ প্রতিবেদন

জাতীয়তাবাদের পথে আরেক ধাপ

নাগরিকত্ব আইন

প্রকাশ | ২৮ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
ভারতের নাগরিকত্ব আইনে বিতর্কিত সংশোধনী নিয়ে দেশটির ভেতরে ও বাইরে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়েছে। 'সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্টে' (সিএএ) ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে যাওয়া অমুসলমান ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। এই আইনের কারণে ভারতের আসাম থেকে শুরু করে রাজধানী দিলিস্ন পর্যন্ত বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে এবং এতে সম্পদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। আন্তর্জাতিকভাবে এই আইন ভারতের সঙ্গে বহু দেশের সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, যার মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ইউরোপীয় দেশগুলো। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া ছিল আরও কঠোর। দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বলেছেন, 'যুক্তরাষ্ট্র ভারতের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছে, যাতে ভারতের সংবিধান ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তারা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা করে।' যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মীয় স্বাধীনতাবিষয়ক দূত স্যাম ব্রাউনব্যাক ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে তারা তাদের 'সাংবিধানিক প্রতিশ্রম্নতি' মেনে চলে। আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতাবিষয়ক মার্কিন কমিশন দাবি জানিয়েছে, যাতে ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এই ক্ষোভের কারণ হলো, নাগরিকত্বের সুযোগ থেকে মুসলমানদের বঞ্চিত করা হয়েছে। ভারত দাবি করেছে, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশে মুসলমানদের ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার হওয়ার আশঙ্কা কম, কারণ এই দেশগুলো মুসলমান দেশ। কিন্তু, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই আইনকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখছে না। কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল, বাবরি মসজিদের জমির মালিকানা নিয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায়, দেশজুড়ে ঘটে চলা বিভিন্ন সহিংসতার বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে এটা বলা যায়, সাম্প্রতিক বিতর্কটা মূলত হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থানের একটা বহিঃপ্রকাশ মাত্র। কিন্তু বৃহৎ পরিসরে বললে, এখানে উদারপন্থা এবং জাতীয়তাবাদের মধ্যে সংঘাতটা উঠে এসেছে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জাতীয়তাবাদের পথ বেছে নিয়েছেন। তিনি এক দেশ, এক জাতি, এক ধর্ম ও এক ভাষার মাধ্যমে একটা জাতীয় পরিচয় তৈরির চেষ্টা করছেন এবং ভারতের সমাজ ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও বিভিন্ন স্বাতন্ত্র্যকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। মোদির আশা, এই ধরনের সমন্বয় দেশের উন্নয়নের জন্য একটা স্থিতিশীল সামাজিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি তৈরি করবে এবং এর মাধ্যমে এক পর্যায়ে বিশ্বের অন্যতম শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার ভারতের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে। জাতীয়তাবাদ ও জনপ্রিয়তাবাদের উত্থানের একটা যুগে মোদির এই পদক্ষেপ বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। রাজনীতি থেকে বৈচিত্র্য মুছে দেওয়া এবং নিজের স্বার্থের ওপর জোর দেওয়ার বিষয়টি এখন নতুন করে স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। মোদি ভারতে যেটা করেছেন, সেটার সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সিদ্ধান্তের মিল রয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, মোদি ভারতকে হিন্দুদের মাতৃভূমি করার যে কৌশল নিয়েছেন, তার নিশ্চিত কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকবে। আঞ্চলিক পর্যায়ে ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর সংঘাত উসকে উঠতে পারে। বিশেষ করে যেসব দেশে হিন্দু জনসংখ্যা রয়েছে। ভারত সব হিন্দুকে নিয়ে যেতে পারবে না এবং সে ক্ষেত্রে বিদেশে অবস্থানরত হিন্দুদের রক্ষার প্রশ্ন উঠবে। হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থানের বিষয়টি আন্তর্জাতিক রাজনীতির ওপর আরও ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। হিন্দু জাতীয়তাবাদ চালিত হয় জয় দিয়ে, তাদের অব্যাহত জয়ের প্রয়োজন এবং নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য সুখ্যাতি প্রয়োজন, তাছাড়া এটা তাদের চালিকাশক্তি হারাবে অথবা এমনকি উন্নয়নকেও ধ্বংস করে দেবে, যেটা চীনের জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে হবে না। চীনের জাতীয়তাবাদ উজ্জীবিত হয় দুঃখের মানসিকতা দ্বারা, যখন দেশটি আক্রান্ত বা দমনের শিকার হয়। সে কারণে হিন্দু জাতীয়তাবাদ শুধুমাত্র ভারতের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকারী শক্তি হয়ে সন্তুষ্ট হবে না। তারা দেশকে চাপ দেবে, যাতে তারা আরও উচ্চ আন্তর্জাতিক স্ট্যাটাস অর্জনের চেষ্টা করে। বিশেষ করে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য থেকে শুরু করে ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তার করে এবং একপর্যায়ে অন্যতম বিশ্বশক্তি হয়ে ওঠে; যাতে হিন্দুত্ববাদের বিজয় আর খ্যাতির তৃষ্ণা পূরণ হয়। সংবাদসূত্র : সাউথ এশিয়ান মনিটর