ভাইরাস নিয়ে চলছে নিরন্তর গবেষণা
যাযাদি ডেস্ক
মৃতের সংখ্যার পাশাপাশি আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকলেও, নতুন ধরনের করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কোথা থেকে শুরু হয়েছে, সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত হতে পারেননি বিশেষজ্ঞরা। সাপ, বাদুড়ের মতো বেশ কিছু প্রাণীকে দায়ী করে
যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে নানা কথা হচ্ছে, সেখানে চীনাদের খাদ্যাভ্যাস নিয়েও মন্তব্য আসছে আক্রমণাত্মক ভাষায়। কিন্তু আসলে কীভাবে এই ভাইরাসের বিস্তার ঘটেছে চীনের উহানে?
বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রাণঘাতী এ ভাইরাস কোনো ধরনের প্রাণী থেকেই মানুষের দেহে এসেছে। তারপর এ রোগের জীবাণু বাতাসে ভেসে ও স্পর্শের মাধ্যমে মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ছে। গত ডিসেম্বরের একেবারে শেষে মধ্য চীনের শহর উহানে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার কয়েকটি ঘটনা নিয়ে সতর্ক করেছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাবিস্নউএইচও)। এর এক সপ্তাহ পর নতুন ওই ভাইরাসটি শনাক্ত করে চীনা কর্তৃপক্ষ।
সার্স (সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম) এবং মার্স (মিডল-ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম) গোত্রের এই করোনাভাইরাসের নাম দেওয়া হয় নভেল করোনাভাইরাস; সংক্ষেপে ২০১৯-এনসিওভি।
করোনাভাইরাসের প্রথম সন্ধান মেলে ১৯৩০-এর দশকে। বিজ্ঞানবিষয়ক জার্নাল 'সায়েন্সডাইরেক্ট ডটকমে' ২০১২ সালের এক গবেষণামূলক নিবন্ধে বলা হয়েছে, মুরগির 'অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ইনফেকশন' দেখা দিলে জানা যায় ইনফেকশাস ব্রঙ্কাইটিস ভাইরাসের (আইবিভি) মূল কারণ। আর ষাটের দশকে প্রথমবারের মতো মানুষের দেহে করোনাভাইরাস সংক্রমণের তথ্য পান বিজ্ঞানীরা।
'সায়েন্সঅ্যালার্ট' বলছে, এই ভাইরাসের রয়েছে চারটি জেনাস বা গণ। আর এগুলো হলো- আলফা করোনাভাইরাস, বেটা করোনাভাইরাস, গামা করোনাভাইরাস এবং ডেলটা করোনাভাইরাস। প্রথমটি বাদুড়, শূকর, বিড়াল ও মানুষে সংক্রমণ ঘটায়। আর গামা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয় পাখি ও পোলট্রি প্রজাতির প্রাণী। তবে ডেলটা করোনাভাইরাসে পাখি ও স্তন্যপ্রায়ী প্রাণী উভয়ই আক্রান্ত হতে পারে।
নিউইয়র্কের মাউন্ট সিনাই হাসপাতালের সংক্রমণ রোধ ও নিয়ন্ত্রণ বিভাগের পরিচালক ডা. ওয়ালিদ জাভেদ বলেন, 'বহু ধরনের করোনাভাইরাস শনাক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে নতুন করোনাভাইরাসসহ সাতটি মানুষের দেহে সংক্রমিত হতে পারে। এর মধ্যে চারটি সাধারণ সর্দি-কাশির উপসর্গ নিয়েই দেখা দেয় এবং এই ভাইরাস বহুদিন ধরেই ছড়িয়ে আছে।'
২০০২ সালে প্রথম সার্স আক্রান্ত রোগী মিলেছিল চীনেই। ফ্লু উপসর্গের এই রোগে প্রায় ২৬টি দেশে আক্রান্ত হয়েছিল ৮ হাজারের বেশি মানুষ; মারা গিয়েছিল অন্তত ৮০০ জন। তবে মানব শরীরে কী করে এই জীবাণুর সংক্রমণ ঘটেছিল, সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
মার্সের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল সৌদি আরবে। জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া ছিল মার্সের লক্ষণ। ধারণা করা হয়, ২০১২ সালের এই মহামারি ছড়িয়েছিল উট থেকে। এর প্রায় আট বছর পর নতুন আতঙ্ক নিয়ে এসেছে নভেল বা নতুন করোনাভাইরাস। এই ভাইরাসের সঙ্গে উহান শহরে একটি সি ফুড মার্কেটের যোগ পাওয়া যায়। তবে ওই বাজারে মুরগি, বাদুড়, খরগোশ, সাপ, সামুদ্রিক প্রাণীসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর বিকিকিনি হতো। গত ১ জানুয়ারি এই বাজারটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
নতুন করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্কের মধ্যে সবার নজর ওই বাজারের দিকে থাকলেও সংক্রমক রোগ বিশেষজ্ঞ ডেনিয়েল লুসি মনে করেন, যদি ওই বাজার থেকেই রোগটি বিস্তার ঘটে থাকে, সেক্ষেত্রেও কোনো না কোনোভাবে আগে ওই বাজারে ভাইরাসটির প্রবেশ ঘটেছে।
প্রাণিবিজ্ঞানী ক্রিস্টিয়ান আন্ডারসনও এখনই চোখ বুঁজে উহানের বাজারকেই দায়ী করতে চান না। স্বাস্থ্যবিষয়ক জার্নাল ল্যানসেটের এক নিবন্ধে তিনি করোনাভাইরাসের তিনটি সম্ভাব্য উৎস নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, 'এমন হতে পারে, কেউ একজন আগেই এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং তারপর তিনি বাজারে এলে তার থেকেই তা ছড়ায়। আবার এমনও হতে পারে, এই জীবাণু বহন করা একদল অথবা একটি প্রাণীকে এই বাজারে আনা হয়েছিল, এই সম্ভাবনা নিয়েও গবেষণা চলছে।'
সাপ থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে বলে একটি দল দাবি করলেও তা নাকচ করে দিয়ে আরেকদল বিজ্ঞানী বলছেন, পাখি ও স্তন্যপ্রায়ী প্রাণী ছাড়া অন্য প্রাণীতে এই রোগের সংক্রমণ ঘটেছে বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ডেভিড রবার্টসন বলেন, 'সাপ থেকে এই রোগ ছড়িয়েছে, তা বলার মতো কোনো মজবুত প্রমাণ নেই।' বিজ্ঞানীদের অধিকাংশ গবেষণা সাপের সঙ্গে করোনাভাইরাসের সম্পর্ক নাকচ করে দিলেও বাদুড় ও ভোঁদড়ের দিকেই রয়েছে তাদের ইঙ্গিত। সংবাদসূত্র : নেচার ডটকম