দিলিস্ন বিধানসভা নির্বাচন

ধর্মীয় মেরুকরণ নয়, উন্নয়নেই আস্থা

প্রকাশ | ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
বিজয়ের পর সমর্থকদের উদ্দেশে অরবিন্দ কেজরিওয়াল
ধর্ম না উন্নয়ন? এই প্রশ্নে দ্বিতীয় বিকল্পকেই বেছে নিয়েছে ভারতের রাজধানী দিলিস্ন। তৃতীয়বারের জন্য দিলিস্নর মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে আগামীকাল (রোববার) ফের বসছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। আসন কিছুটা কমলেও বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে আম আদমি পার্টি (আপ)। বিজেপির আসন বাড়লেও ধর্মীয় মেরুকরণ, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি), জাতীয় জনসংখ্যা রেজিস্টার (এনপিআর)-এর ধাক্কায় এবারও দিলিস্নর মসনদ অধরাই থেকে গেল বিজেপির কাছে। কিন্তু কী এমন ম্যাজিক দেখিয়েছেন কেজরিওয়াল? প্রথমবার ৪৫ দিনের মাথায় মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে কেজরিওয়াল কার্যত বোকামিই করেছিলেন বলে অনেকেই কটাক্ষ করতে ছাড়েননি। কিন্তু সেটা যে লম্বা দৌড়ের প্রস্তুতি ছিল, তা বোঝা গেছে গত পাঁচ বছরে তার উন্নয়নের রাজনীতিতে। গত পাঁচ বছরে সাধারণ মানুষের জন্য অনেক উন্নয়নমুখী প্রকল্প তৈরি এবং তার বাস্তব রূপায়ণের ওপরই আস্থা রেখেছে দিলিস্নবাসী। উন্নয়ন প্রকল্পগুলো কেমন? এই ২০১৫ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে যেসব প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছিলেন কেজরিওয়াল, সেগুলোর প্রায় সবকটি ধরে ধরে বাস্তবায়ন করে দেখানোর রাজনীতিতে কেজরিওয়ালের বিশ্বাসযোগ্যতা বেড়েছে। দিলিস্নবাসীর জন্য ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদু্যতের বিল মওকুফ করেছে আপ সরকার। নারীদের সরকারি বাসে বিনামূল্যে সফর এবং তাদের নিরাপত্তায় বাসে মার্শাল নিয়োগ করা, বিনে পয়সায় প্রতিদিন ৭০০ লিটার পর্যন্ত পানি দেওয়ার মতো প্রকল্প বাস্তবে করে দেখিয়েছে দিলিস্নর সরকার। নতুন অনেক স্কুল তৈরি হয়েছে, পুরানো স্কুলগুলোর খোলনলচে বদলে আধুনিক রূপ দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কার্যত যুগান্তকারী বিপস্নব এনেছে কেজরিওয়ালের 'মহলস্না ক্লিনিক' মডেল। এই ক্লিনিকগুলোতে বিনামূল্যে চিকিৎসা তো বটেই, ওষুধও দেয় সরকার। এই মহলস্না ক্লিনিকগুলো পরিদর্শন করেছে ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা 'ডাবিস্নউএইচও'র মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা। এসব সংস্থাও এই ক্লিনিকগুলোকে দরাজ সার্টিফিকেট দিয়েছে। আসলে এগুলো সাধারণ মানুষের জন্য এই জনমুখী প্রকল্প হলেও এটাই ছিল কেজরিওয়ালের রাজনৈতিক কৌশল। ভোটের প্রচারেও এই উন্নয়ন মডেলকেই হাতিয়ার করেছিলেন কেজরিওয়াল। বিজেপির ধর্মীয় মেরুকরণের উসকানিতে পা না দিয়ে প্রচার করে গেছেন শুধু নিজের সরকারের এসব জনমুখী প্রকল্পের সাফল্য। শাহিনবাগের আঁচ কার্যত গায়ে মাখেননি, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে (জেএনইউ) হামলার ঘটনায়ও মুখ খোলেননি। দিলিস্নবাসীকে বোঝাতে পেরেছেন, জাতপাত, ধর্মীয় বিভেদ নয়, উন্নয়নই তার পাখির চোখ। অথচ কয়েক মাস আগের লোকসভা ভোটেও ভরাডুবি হয়েছিল আপের। সাতটির একটিতেও জিততে পারেনি। সবকটি আসন ঝুলিতে পুরেছিল বিজেপি। তার ওপর নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহের মতো চৌকষ রাজনৈতিক জুটির বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে তাকে। এই দু'জন তো বটেই, দলের সব এমপি, একাধিক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে এনে প্রচার করেছে বিজেপি। ধর্মীয় মেরুকরণের তিরে বিঁধলেও তার বিরুদ্ধে কেজরিওয়াল সে সব গায়ে মাখেননি। সিএএ-এনআরসি নিয়ে কোনো জনসভায় একটি কথাও শোনা যায়নি তার মুখে। তার সঙ্গে বিরোধী ভোটকে একমুখী করার কৃতিত্বও কেজরিওয়ালের প্রাপ্য। ভোটের ফলের দিকে নজর রাখলেই দেখা যাবে, ভোট হয়েছে কার্যত দ্বিমুখী। একদিকে বিজেপি। বিপরীতে আপ এবং অ-বিজেপি। কংগ্রেসের নেতা-কর্মীদের প্রতিও আহ্বান জানিয়েছেন, নিজের দল ছাড়তে হবে না, শুধু এবারের জন্য আপকে ভোট দিন। সেই আর্জিতেও কাজ হয়েছে। বিজেপিবিরোধী ভোটের প্রায় পুরোটাই পকেটে পুরতে পেরেছেন কেজরিওয়াল। কিন্তু কেজরিওয়ালের যাত্রা এতটা কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। এমনকি, ঘনিষ্ঠ মহলে কেজরিওয়াল স্বীকার করেছেন, সরাসরি রাজনীতিতে আসার কথা 'ক্যারিয়ারের' শুরুতে কখনোই ভাবেননি। কিন্তু 'ইনডিয়ান রেভিনিউ সার্ভিস'র নিশ্চিন্ত সরকারি চাকরি ছাড়ার পর থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যেভাবে ঘটনা প্রবাহ এগিয়েছে, তাতে ধীরে ধীরে রাজনীতির গন্ডিতে কার্যত নিজের অজান্তেই পা দিয়ে ফেলেছিলেন খড়গপুর আইআইটির সাবেক এই কর্মকর্তা কেজরিওয়াল। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, কেজরিওয়ালের অজান্তেই সেই পথের সূচনা হয়েছিল সমাজকর্মী আন্না হাজারের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে দুর্নীতির বিরুদ্ধে টানা অনশন-ধর্না আন্দোলন। লোকপাল বিলের দাবিতে যেভাবে দিনের পর দিন অনশন ও শান্তিপূর্ণ অবস্থান ধর্মঘট করেছিলেন কেজরিওয়াল, তাতে তার মধ্যে এক নতুন নেতার স্ফূলিঙ্গ দেখেছিল ভারতবাসী। সেই 'মাফলার ম্যান' কেজরিওয়ালের হাত ধরেই স্বপ্ন দেখেছিল এক নতুন ভারতের। এক দুর্নীতিমুক্ত ভারতের। সংবাদসূত্র : এবিপি নিউজ