গোপন নথি ফাঁস

দাড়ি, বোরকা ও ইন্টারনেটের জন্যও আটক হন উইঘুররা

১৩৭ পৃষ্ঠার এই নথিতে তিন হাজারেরও বেশি উইঘুরের বিস্তৃত তথ্য রয়েছে প্রার্থনার সময়, ধরন, কীভাবে পোশাক পরেন তাও লিপিবদ্ধ

প্রকাশ | ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
উইঘুর নিয়ে ফাঁস হওয়া নথি
দাড়ি রাখা, বোরকা পরা, বিদেশ যাত্রার ইচ্ছায় পাসপোর্টের আবেদন, কিংবা শুধু ইন্টারনেটে বিদেশি ওয়েবসাইট ব্রাউজিংয়ের কারণেও চীনা কর্তৃপক্ষ উইঘুরের অসংখ্য মুসলমানকে বিভিন্ন 'ডিটেনশেন ক্যাম্পে' (অন্তরীণ শিবির) নিয়ে যায় এবং আটকে রাখে বলে সম্প্রতি 'ফাঁস হওয়া' এক নথি থেকে জানা গেছে। সংবাদসূত্র : বিবিসি জিনজিয়াং প্রদেশের শিবিরগুলোতে লাখ লাখ মুসলমানের ভাগ্য কীভাবে নির্ধারিত হচ্ছে, সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত তাদের দেখা নথিটিকে সবচেয়ে বড় প্রমাণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। নথিতে চীনের দূর পশ্চিমাঞ্চল জিনজিয়াংয়ের তিন হাজারের বেশি বাসিন্দার ব্যক্তিগত ও তাদের দৈনন্দিন জীবনাচরণের বিস্তৃত তথ্য আছে। ১৩৭ পৃষ্ঠার এ নথিতে থাকা সারি ও কলামে নিবন্ধিত ব্যক্তিদের প্রার্থনার সময়, ধরন, কীভাবে তারা পোশাক পরেন, কাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, কিংবা তাদের পরিবারের সদস্যদের আচরণ কেমন, সেসবও লিপিবদ্ধ আছে। গত বছর জিনজিয়াং থেকে ফাঁস হওয়া অত্যন্ত সংবেদনশীল বিভিন্ন নথি যেভাবে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও গণমাধ্যমের কাছে এসেছিল, ঠিক একইভাবে কিছু মানুষের ব্যক্তিগত ঝুঁকির ওপর ভিত্তি করেই এ নথিটিও ফাঁস হয়। কোনো সরকারি সিল বা চিহ্ন না থাকলেও নতুন এ নথিকে 'আসল' বলেই মনে করছেন জিনজিয়াংয়ে চীনের নীতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ, ওয়াশিংটনভিত্তিক 'ভিক্টিমস অব কমিউনিজম মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন'র জ্যেষ্ঠ ফেলো ড. আদ্রিয়ান জেনজ। তিনি বলেন, 'ধর্মীয় বিশ্বাসের চর্চার কারণে বেইজিং যে নির্যাতন করছে ও শাস্তি দিচ্ছে, অসাধারণ এ নথি তার সবচেয়ে শক্তিশালী প্রমাণ হাজির করেছে।' পশ্চিমা বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও দেশ দীর্ঘদিন ধরেই উইঘুর মুসলমানদের ওপর চীনের নির্যাতন ও নিপীড়ন নিয়ে অভিযোগ করে আসছে। বেইজিং শুরু থেকেই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলছে, সন্ত্রাসবাদ ও ধর্মীয় উগ্রবাদ মোকাবিলায় তারা জিনজিয়াংয়ে কিছু বিশেষ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বানিয়েছে। নথিতে উলেস্নখ করা চার নম্বর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটিকে শনাক্তও করতে পেরেছেন ড. জেনজ। গত বছরের মে মাসে চীনা কর্তৃপক্ষের আয়োজিত এক ভ্রমণে যারা জিনজিয়াং গিয়েছিলেন, জেনজও তাদের মধ্যে ছিলেন। ফাঁস হওয়া নথির যেসব তথ্য তারা বের করতে পেরেছেন, তার মধ্যে যেসব অংশে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের সম্ভাবনা রয়েছে, প্রকাশের আগে সেসব আড়াল করে দেওয়া হয়েছে। নথিতে দক্ষিণ জিনজিয়াংয়ের হুতার শহরের নিকটবর্তী কারাকাক্স এলাকার ৩১১ জনের অতীত তথ্য, তাদের ধর্ম চর্চা এবং আত্মীয়, প্রতিবেশী ও বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্কের বিস্তারিত তথ্য আছে। অন্তরীণ শিবিরে থাকাদের রাখা হবে নাকি ছেড়ে দেওয়া হবে এবং শিবির থেকে ছাড়া পাওয়াদের ফের নিয়ে আসা হবে কিনা, সে বিষয়ক সিদ্ধান্ত নথিটির একেবারে শেষ কলামে লেখা আছে; যাকে 'রায়' বলছে গণমাধ্যম। এসব কেন্দ্রকে চীন যে 'শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান' হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছে; নতুন এ নথির তথ্য তার সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। নথির ৫৯৮ নম্বর সারিতে ৩৮ বছর বয়সী এক নারীর বিস্তারিত তথ্য আছে; কয়েক বছর আগে মুখমন্ডল কাপড়ে ঢেকে চলাফেরার কারণে হেলসেম নামের ওই নারীকে চীনের এ তথাকথিত 'পুনঃশিক্ষণ শিবিরে' পাঠানো হয়েছিল। 'বাস্তবিক অর্থে তেমন ঝুঁকি নেই' এমনটা লেখা থাকা সত্ত্বেও ৩৪ বছর বয়সি মেমেত্তোতিকে অন্তরীণ করা হয়েছে কেবল পাসপোর্টের আবেদন করায়। বেইজিং কর্তৃপক্ষ যে এখন জিনজিয়াং থেকে বিদেশ যাত্রার আকাঙ্ক্ষাকেও 'উগ্রবাদের লক্ষণ' হিসেবে দেখছে, মেমেত্তোতিকে আটক তার নজির। কাউকে কাউকে শিবিরগুলোতে নেওয়া হয়েছে 'ঘন দাড়ি' রাখায়, কিংবা ধর্মীয় পাঠচক্র আয়োজনের কারণে। ২৩৯ নম্বর সারিতে থাকা নুরমেমেতকে পুনঃশিক্ষণ কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয় 'ওয়েবলিংকে ক্লিক করে নিজের অজান্তে বিদেশি একটি ওয়েবসাইটে চলে যাওয়ায়'। ২৮ বছর বয়সী এ যুবকের আচরণে অন্য কোনো সমস্যা নেই বলেও তাকে নিয়ে থাকা সারি ও কলামগুলোতে লেখা রয়েছে। ১৭৯, ৩১৫ ও ৩৪৫ এ বিপুল পরিমাণ ব্যক্তিগত তথ্য রয়েছে ৬৫ বছর বয়সি ইউসুফের। তার রেকর্ডে লেখা রয়েছে- ২০১৪ ও ২০১৫ সালে দুই মেয়ের নেকাব ও বোরকা পরা, ছেলের ইসলামী রাজনীতির প্রতি ঝোঁক এবং পরিবারের সদস্যদের 'হানবিরোধী মনোভাবের' কথা। রায়ের ঘরে লেখা রয়েছে- 'প্রশিক্ষণ অব্যাহত রাখা'।