করোনার কালবেলা

যুক্তরাষ্ট্রে এক দিনে মৃতু্য হাজারের বেশি

নিউইয়র্কে মৃতু্যর সংখ্যা কমায় সুড়ঙ্গের শেষে আলো দেখছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মহামারি এখনো সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে পৌঁছায়নি বলে সতর্ক করলেন জাতিসংঘ মহাসচিব বিশ্বে মৃতের সংখ্যা ৭১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে

প্রকাশ | ০৭ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
প্রেস ব্রিফিংয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
ইতালি, স্পেনকে পেছনে ফেলে যুক্তরাষ্ট্রে রোববার একদিনেই করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয়েছে ২৫ হাজার ৫৪৪ জন। একই দিন মারা গেছে এক হাজার ১৬৫ জন। সোমবারও মৃতু্য সংখ্যা বাড়ছে। তারপরও মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছেন, নিউইয়র্কে নতুন করে আক্রান্ত ও মৃতু্যর সংখ্যা কমে আসায় তিনি সুড়ঙ্গের শেষে আলো দেখছেন। আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থা 'ওয়ার্ল্ডোমিটারের' তথ্যানুযায়ী, সোমবারও বিশ্বে মৃতু্যর সংখ্যা হুহু করে বাড়ছে। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত (বাংলাদেশ সময় রাত ৯টা) মৃতের সংখ্যা ৭১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আর আক্রান্ত প্রায় ১২ লাখ মানুষ। এরমধ্যে গুরুতর অবস্থা ৪৬ হাজারের বেশি। তবে, সুস্থ হয়ে ওঠার সংখ্যাও নেহাত কম নয়। ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্যানুযায়ী, সোমবার পর্যন্ত এই সংখ্যা প্রায় তিন লাখ। করোনাভাইরাস এ পর্যন্ত বিশ্বের ২০৮টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। সংবাদসূত্র : সিএনএন, বিবিসি, রয়টার্স আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে শনিবারের তুলনায় রোববার নতুন সংক্রমণ ও মৃতের সংখ্যা তুলনামূলক কমে এসেছে। আগের দিন শনিবার নতুন করে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৩৪ হাজার ১২৩। শনিবার প্রাণ হারিয়েছে এক হাজার ৩৪৪ জন। আর রোববার মারা গেছে এক হাজার ১৬৫ জন। এদিকে, করোনাভাইরাসের ব্যাপক প্রাদুর্ভাবের ফলে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে মাস্কের ব্যাপক চাহিদা বেড়েছে। ফলে বাজারে এর ঘাটতি দেখা দেওয়ার আশঙ্কা করছে ট্রাম্প প্রশাসন। এজন্য মাস্ক না পেলে পরিষ্কার কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, 'কাপড়ের ঘনত্বের বিচারে স্কার্ফ মাস্কের ভালো বিকল্প।' ট্রাম্প প্রশাসনের হাতে মাস্ক বা এ সংক্রান্ত সরঞ্জামের পর্যাপ্ত মজুদ নেই। যা ছিল তাও প্রায় শেষ পর্যায়ে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের জন্য বাজারে পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে বাধ্য হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রে এ মহামারির কেন্দ্রস্থল নিউইয়র্কের মেয়র বিল ডে বস্নাসিও-র ভাষায়, 'আপনি এটা বলতে পারেন না যে, প্রতিটি রাজ্য নিজেদের জন্য, প্রতিটি শহর নিজেদের জন্য। এটা যুক্তরাষ্ট্রের চিত্র হতে পারে না।' উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্থানীয় হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে হিমশিম খাচ্ছে বিভিন্ন শহর কর্তৃপক্ষ। বিদ্যমান সংকট মুহূর্ত কাটিয়ে উঠতে নতুন স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগের দিকেও নজর দিচ্ছেন অনেকে। নিউইয়র্কের মেয়র বিল ডে বস্নাসিওর আশঙ্কা, করোনা মহামারির সবচেয়ে খারাপের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আর মাত্র কয়েক দিন বাকি আছে। যুক্তরাষ্ট্রে তার রাজ্যেই এ ভাইরাসে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষের মৃতু্য হয়েছে। বস্নাসিও বলেন, সময়ের বিরুদ্ধ স্রোতে লড়াই করছে নিউইয়র্ক। এ সময় করোনা মোকাবিলার প্রচেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীকে যুক্ত করতে ফেডারেল সরকারের প্রতি নিজের আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি। নিউইয়র্কের মেয়র বলেন, 'আমরা এমন এক শত্রম্নর মোকাবিলা করছি, যা হাজার হাজার মার্কিনিকে হত্যা করছে।' সুড়ঙ্গের শেষে আলো দেখছেন ট্রাম্প এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাসের 'হটস্পট'গুলোতে আক্রান্তের সংখ্যা কমে আসছে উলেস্নখ করে শিগগিরই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার আশা প্রকাশ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। স্থানীয় সময় রোববার সন্ধ্যায় করোনাভাইরাস নিয়ে নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে ট্রাম্প বলেন, তিনি সুড়ঙ্গের শেষে উঁকি দেওয়া আলোর ঝলক দেখতে পাচ্ছেন। রোববার নিউইয়র্কে নতুন আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কমতে দেখা যাওয়ায় একে 'শুভ লক্ষণ' বলে মনে করছেন ট্রাম্প। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, 'আমরা সুড়ঙ্গের (টানেল) শেষ প্রান্তে আলো দেখতে পাচ্ছি। প্রতিদিন অনেক কিছু হচ্ছে। প্রতিদিন অনেক কিছু ঘটছে। আমরা সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তের আলো দেখতে শুরু করেছি। আশা করছি, আমরা খুব বেশি দূরে নেই। এই সময়ে যা কিছু করেছি, সেটার জন্য আমরা সবাই গর্ববোধ করব।' তবে একইসঙ্গে তিনি আবারও সতর্ক করেছেন, সামনের দিনগুলোতে আরও অনেক মানুষের মৃতু্য হবে। যুক্তরাষ্ট্রের যেসব অঙ্গরাজ্য করোনায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে, তাদের জন্য মাস্ক ও ভেন্টিলেটরসহ ও আরও বেশি চিকিৎসা সামগ্রী পাঠানোর কথা জানান ট্রাম্প। এর আগে শনিবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক সংবাদ সম্মেলনে সতর্ক করেন, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সামনে আরও কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। তিনি বলেন, 'চলতি সপ্তাহ ও আগামী সপ্তাহের মধ্যবর্তী সময়টি সবচেয়ে কঠিন সময় হতে পারে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ সময়ে অনেক মানুষের মৃতু্য হতে পারে। ব্যবস্থা না নিলে যত মানুষের মৃতু্য হতে পারতো, তার চেয়ে অনেক কম মানুষ মারা যাবে ঠিকই, তবে প্রাণহানি হবেই।' ট্রাম্প আরও বলেন, 'আমাদের সামনে এমন সময় আসছে, যা খুব ভয়ঙ্কর হতে পারে। আমরা কখনো এত বেশি সংখ্যক মৃতু্য দেখিনি। সম্ভবত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কিংবা এ ধরনের যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যেও না।' এ প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানিয়েছেন, তারা ১৬ লাখ মানুষের কোভিড-১৯ টেস্ট করিয়েছে। ট্রাম্প বলেন, 'মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকা ১৬ লাখ মানুষের করোনাভাইরাস টেস্ট (পরীক্ষা) করা হয়েছে এবং তাদের রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। যা যেকোনো দেশের চেয়ে অনেক বেশি। এমনটা বিশ্বের আর কোনো দেশ করতে পারেনি।' তার ভাষায়, ২৭ মার্চ থেকে অনুমতি পাওয়া অ্যাবোট ল্যাবরেটরি ১৫ মিনিটে করোনাভাইরাস টেস্ট করতে পারবে। সপ্তাহে তারা ১২০০ টেস্ট করাবে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান থেকে ছড়িয়ে পড়ে করোনাভাইরাস। তবে সেখানে এরই মধ্যে ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাব কমে গেলেও আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যায় চীনকে ছাড়িয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বের অন্যান্য দেশে এই ভাইরাসের প্রকোপ বাড়ছে। চীনের বাইরে করোনাভাইরাসের প্রকোপ ১৩ গুণ বৃদ্ধি পাওয়ার প্রেক্ষাপটে গত ১১ মার্চ দুনিয়াজুড়ে মহামারি ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি আক্রান্তের সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রে। তবে মৃতের হিসাবে শীর্ষে রয়েছে ইতালি। দেশটিতে মৃতের সংখ্যা প্রায় ১৬ হাজার। মৃতের হিসাবে তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে স্পেন। দেশটিতে মৃতের সংখ্যা ১৩ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। মৃতের সংখ্যায় চতুর্থ স্থানে রয়েছে ফ্রান্স। দেশটিতে প্রায় ৯ হাজার মানুষের মৃতু্য হয়েছে। যুক্তরাজ্য ও ইরানে মারা গেছে যথাক্রমে পাঁচ এবং তিন হাজারের বেশি। ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীনে মৃতের সংখ্যা তিন হাজার ৩৩৩। যদিও দেশটির বিরুদ্ধে প্রকৃত পরিস্থিতি গোপনের অভিযোগ রয়েছে। উহানের একজন স্বেচ্ছাসেবী বলেন, 'বুদ্ধি-বিবেচনাসম্পন্ন যেকোনো মানুষই এই সংখ্যা (সরকারি পরিসংখ্যান) নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করবে।' এদিকে, করোনাভাইরাসের মহামারি এখনো সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে পৌঁছায়নি বলে সতর্ক করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। সিরিয়া, লিবিয়া ও ইয়েমেনের মতো সংঘাত কবলিত দেশগুলোতে সংক্রমণ শুরু হলে পরিস্থিতি আরও বিপর্যয়কর হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি। ফলে বিশ্বজুড়ে যুদ্ধবিরতির আহ্বানও পুনর্ব্যক্ত করেছেন তিনি।