বর্তমানে আমরা সবাই জানি বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস, প্রকৌশল, বিবিএ কিংবা রাষ্ট্রবিজ্ঞান এই বিষয়গুলোতে পড়াশোনা করে ক্যারিয়ার কেমন হবে। কিন্তু টু্যরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়াশোনা করে কী হবে এ বিষয়ে আমরা অনেকেই জানি না। বর্তমান বিশ্বে টু্যরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট একটি জনপ্রিয় এবং ক্রমবর্ধমান ক্ষেত্র। বিশ্বব্যাপী এই ক্ষেত্রের চাহিদা দ্রম্নত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও পর্যটনশিল্প দ্রম্নত বর্ধনশীল হচ্ছে এবং এটি ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে। আসুন জেনে নেওয়া যাক টু্যরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট কী?
পরিচয় : টু্যরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট (ঞড়ঁৎরংস ধহফ ঐড়ংঢ়রঃধষরঃু গধহধমবসবহঃ) হলো একটি শিক্ষাক্ষেত্র এবং পেশাগত দিক, যা পর্যটনশিল্প এবং আতিথেয়তা সেবাসংক্রান্ত বিভিন্ন দিকের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। এই ক্ষেত্রে প্রধানত পর্যটন ব্যবস্থাপনা, হোটেল ও রিসোর্ট ব্যবস্থাপনা, রেস্টুরেন্ট ও ফুড সার্ভিস, ইভেন্ট পরিকল্পনা এবং গ্রাহক সেবা উন্নয়নের বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়। এটি একটি সেক্টর বা ক্ষেত্র, যা পর্যটন ও আবাসন সেবার সঙ্গে জড়িত। টু্যরিজম সেবা ব্যবস্থাপনা, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, রিসোর্ট এবং অন্যান্য আবাসন প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা এ ম্যানেজমেন্টের মূল অংশ। হোটেল, রেস্তোরাঁ, ট্রাভেল এজেন্সি, টু্যর অপারেটর, থিম পার্ক, রিসোর্ট এবং ভ্রমণকারীর জন্য গাইডসহ অন্যান্য সেবা প্রদান করে।
পড়াশোনার বিষয়বস্তু : টু্যরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট একটি চার বছর মেয়াদি স্নাতক কোর্স। এ বিভাগে ফ্রন্ট অফিস ম্যানেজমেন্ট, হাউস কিপিং ম্যানেজমেন্ট, কালিনারি আর্টস, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ সার্ভিস ম্যানেজমেন্ট, লেইজার অ্যান্ড রিক্রিয়েশন সার্ভিসেস, ফাইন্যান্স, টু্যরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি মার্কেটিং, টু্যরিজম ইন বাংলাদেশ, রেভিনিউ ম্যানেজমেন্ট, রিসার্চ মেথটোডোলজি, গেস্নাবাল ইসু্যজ ইন টু্যরিজম, টু্যরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট ফান্ডামেন্টালস, অ্যাকাউন্টিং, ম্যানেজমেন্ট, সার্ভিস ম্যানেজমেন্টসহ অন্যান্য বিষয়ে পড়ানো করা হয়। স্নাতক শেষে তিন মাসের ইন্টার্নশিপ করতে হয়।
ভর্তির যোগ্যতা : ব্যবসায় শিক্ষা, বিজ্ঞান ও মানবিক বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা টু্যরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পড়ার সুযোগ পেয়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রচলিত ভর্তি প্রক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত ভর্তি পরীক্ষা ও মেধাক্রমের ভিত্তিতে এ বিষয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়।
যেসব প্রতিষ্ঠানে পড়ানো হয় ও ব্যয় : বর্তমানে দেশের সরকারি-বেসরকারি ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে টু্যরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে চার বছর মেয়াদি স্নাতক সম্মান ডিগ্রি কোর্স চালু আছে। এছাড়াও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও টু্যরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে চার বছর মেয়াদি স্নাতক সম্মান ডিগ্রি চালু করা হয়েছে, যা দিনে দিনে ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক কোর্সে আনুষঙ্গিক খরচ বাদে একাডেমিক খরচ ৫০-৭০ হাজার টাকার মতো। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে যা ১২-২৫ লাখের মতো। আবার বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫-৮ লাখের মতো। প্রতিষ্ঠানভেদে খরচ ভিন্ন হতে পারে।
দেশে ক্যারিয়ার : বর্তমানে আমাদের দেশে মোটেল, রিসোর্ট, থিম পার্ক ও বিনোদনকেন্দ্র বেড়েই চলছে। আন্তর্জাতিকমানের পাঁচতারকা হোটেলও বাড়ছে দেশে। সুতরাং টু্যরিজম একটি ক্রমবর্ধমান শিল্প। দিন দিন পর্যটক টু্যর অপারেটর, ট্রাভেল এজেন্সি, টু্যর গাইডের চাহিদা বাড়ছে। এদিকে দেশীয় রুটে বিমান চলাচলের সংখ্যা বাড়ছে। সেখানেও বেশ একটা সংখ্যক দক্ষ কর্মী দরকার হচ্ছে। টু্যরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্টে ফ্রন্ট অফিস ম্যানেজমেন্ট, হাউসকিপিং ম্যানেজমেন্ট, কালিনারি আর্টস বা ফুড অ্যান্ড বেভারেজ প্রোডাকশন এবং ফুড অ্যান্ড বেভারেজ সার্ভিস ম্যানেজমেন্ট পড়া হয়। ফলে বহুমুখী চাকরির সুযোগ থাকছে। এছাড়া বেসামরিক বিমান ও পর্যটন বিষয়েও পড়ানো হয়ে থাকে। কেউ চাইলে যেমন ভ্রমণ গাইড হতে পারবে, তেমনি শেফও হতে পারবে। ফলে ভবিষ্যতে এ সেক্টরে দক্ষ কর্মীর কদর বাড়বে। অনেক চাকরির সুযোগ তৈরি হবে। টু্যরিজম সেক্টরের পাশাপাশি বিবিএ এর সব সেক্টরেই চাকরির সুযোগ রয়েছে।
উচ্চশিক্ষার সুযোগ :আমাদের দেশেই টু্যরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামে স্নাতক, স্নাতকোত্তর, এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর, এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়া যায়। বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে আমেরিকা, কানাডা, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালি, পোল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়ামসহ এশিয়ার দেশগুলোর অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিষয়ে ডিগ্রির সুযোগ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত : বাংলাদেশ টু্যরিজম বোর্ডের উপপরিচালক (উপসচিব) প্রশাসন ও অর্থ মোহাম্মদ সাইফুল হাসান বলেন, 'বর্তমানে দেশের পর্যটনশিল্পে প্রায় ৫১ লাখ লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মরত রয়েছেন। দিন দিন এই সংখ্যা বাড়ছে। ২০৩০ সালে এর সংখ্যা দাঁড়াবে ৭২ লাখে। বাংলাদেশ টু্যরিজম বোর্ডের বাংলাদেশের টু্যরিজমশিল্প খাতের মাস্টারপস্ন্যান অনুসারে আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় আরও দুই কোটির অধিক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে বলে আমরা আশাবাদী।' এছাড়াও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের টু্যরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জনাব রফিকুল ইসলাম বলেন, 'দেশে আগের থেকে তুলনামূলক পর্যটন সেক্টরে চাকরির চাহিদা বাড়ছে। এর জন্য প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি। বর্তমানে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে আমাদের পর্যটন সেক্টরে দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রচুর জনবল নিয়োগ দিতে হবে। তাই টু্যরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে পড়ে নিজেকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে ভবিষ্যতে চাকরির সংকটে পড়তে হবে না।'
বেতন ও ভাতা :এই সেক্টরে চাকরির শুরুতে বেতন-ভাতার পরিমাণটা অল্প হলেও দক্ষতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভালো প্রতিষ্ঠানের কাজের সুযোগ ও বেতন-ভাতার পরিমাণ বাড়ে। শুরুতে ১২-১৫ হাজার টাকা থেকে ইন্টর্নশিপ শুরু করা যায়। দেশে এই সেক্টরে গড় বেতন ২৫-৩০ হাজার টাকার মতো। বিদেশে যা আরও বেশি। তারকা হোটেলের একটি প্রতিষ্ঠানে শেফের বেতন হতে পারে ১০ লাখ টাকা।
এই বিভাগে পড়াশোনা করে নিজেকে দক্ষ করে তুলতে পারলে বেকার থাকার আশঙ্কা খুবই কম। এছাড়াও এই সেক্টরে পড়াশোনা শেষ করে যারা নিজের উদ্যোগে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা বা অন্য যেকোনো কাজের সঙ্গে যুক্ত হবে তাদের আয়ের সুযোগ অনেক বেশি। বর্তমানে দেশে টু্যরিজম সেক্টরে কাজের সুযোগ যেমন বাড়ছে, আয়-রোজগারের উপায়ও তেমন বাড়ছে। আমাদের দেশের পর্যটনশিল্পকে আমরা যতটা উন্নত করতে পারব এই সেক্টরে চাকরির সুযোগ ততটাই বাড়বে। তাই নিজেকে দক্ষ করে গড়ে তোলার বিকল্প কিছু নেই।