বিজয় দিবস ভাবনা

এবারের বিজয় দিবস নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ জন মেধাবী শিক্ষার্থীর ভাবনা তুলে ধরেছেন

প্রকাশ | ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী জোবাইদুল ইসলাম
একাত্তরের প্রেরণায় আমাদের চব্বিশ ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালি জাতির স্বাধীনতার এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। এই যুদ্ধ আমাদের মধ্যে সংগ্রামের এক অনন্য সাহস এবং অনুপ্রেরণা জাগ্রত করেছিল। সেই প্রেরণা আজও আমাদের চেতনায় অম্স্নান। ২০২৪ সালের জুলাই বিপস্নব তারই ধারাবাহিকতায় আমাদের নতুন প্রজন্মের মধ্যে একই প্রেরণার সঞ্চার করেছে। '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পূর্বপুরুষরা যে ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন, তা ছিল শুধু ভূখন্ডের স্বাধীনতার জন্য নয়, বরং এক স্বাধীন এবং স্বনির্ভর জাতি গঠনের জন্য। এই চেতনা আমাদের হৃদয়ে আজও গেঁথে আছে। ২০২৪ সালের জুলাই বিপস্নব সেই চেতনার প্রতিফলন। এটি আমাদের নতুন প্রজন্মকে স্বনির্ভর এবং আত্মনির্ভরশীল জাতি গঠনে উৎসাহিত করছে। বাঙালির জাতীয় জীবনে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ যেমন এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল, তেমনি ২৪-এর জুলাই বিপস্নব আমাদের অগ্রগতির নতুন পথ দেখাচ্ছে। একাত্তরের প্রেরণায় আমাদের চব্বিশের এই যাত্রা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে স্বাধীনতা অর্জনের পাশাপাশি তার সঠিক রক্ষণা এবং বাস্তবায়নও সমান গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য এই প্রেরণা হয়ে উঠুক আগামী দিনের পথচলার মূলমন্ত্র। মোহাম্মদ আব্দুর রহমান শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ বৈষম্যহীনতার বার্তা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ুক বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, 'স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন।' স্বাধীনতা মানে দায়িত্ব। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের একজন ব্যক্তি থেকে শুরু করে দৈনিক মজুরিভুক্ত একজন ব্যক্তি, তার নিজ কর্মস্থলে সততা, দায়িত্ব ও কর্মনিষ্ঠা প্রদর্শন করাই হলো স্বাধীনতা। একাত্তরের ডিসেম্বর কিংবা চব্বিশের আগস্টের সারমর্ম হলো জনগণের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব এবং রাষ্ট্র গঠনে জনগণের ভূমিকা। এই দুয়ের সমান্তরাল ব্যত্যয় সব সময় নতুন স্বাধীনতার জন্ম দেবে। তাই উভয় স্বাধীনতার মূলমন্ত্র প্রত্যেক নাগরিকের মধ্যে ধারণ করে একতাবদ্ধ হয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো আরও সুদৃঢ়ভাবে পরিমার্জন করা ভীষণ প্রয়োজন। সর্বক্ষেত্রে তরুণদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ স্বাধীনতায় যোগ করবে নতুনমাত্রা। বৈষম্যহীনতার যে বার্তা নিয়ে এ দ্বিতীয় স্বাধীনতার আগমন ঘটেছে, তা বসন্তের মতো ছড়িয়ে পড়ুক চারদিকে। বাংলাদেশ এমনভাবে গড়ে উঠুক যাতে বাংলার তরুণদের আর কখনো তৃতীয় স্বাধীনতাসংগ্রামের ডাক দিতে না হয়। আতকিয়া গুঞ্জন শিক্ষার্থী, ক্রিমিনোলজি বিভাগ সব অনিয়ম দূর করতে হবে বিজয় দিবসের প্রকৃত অর্থ শুধু শত্রম্নর পরাজয় নয়, বরং দেশের মানুষের আত্মমর্যাদা, স্বাধীনতার শপথ এবং সাম্প্রতিক সময়ে দেশে যে চ্যালেঞ্জগুলো সামনে আসছে, তার মোকাবিলার অঙ্গীকার। এটি অত্যাচারী শাসকের হাত থেকে মুক্তির প্রতীক, যা আজ ২০২৪ সালে দাঁড়িয়ে এই চেতনা একটি ভিন্ন মাত্রা ধারণ করে। স্বাধীনতাসংগ্রামে যারা জীবন দিয়েছেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো জাতির কর্তব্য। একইসঙ্গে আমাদের উচিত দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে যে জ্ঞান, দক্ষতা, গণতান্ত্রিক চর্চা এবং মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ, যা অর্জনের জন্যই এই মহান মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল সেই 'সাম্য', সর্বক্ষেত্রে বৈষম্যহীন একটি দেশ গড়ে তোলা, সেটি বাস্তবায়নের দিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে। দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য সঠিক শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের উপর গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি, যদি সামাজিক ন্যায়বিচার, বাকস্বাধীনতা, আইনের শাসন নিশ্চিত করা যায়; যদি টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি বন্ধ করা যায়, যদি দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতির বদলে রাজনীতি সচেতন তরুণ ছাত্রসমাজ গড়ে তোলা যায়, তবে বাংলাদেশ আরও উন্নত, সমৃদ্ধ ও আত্মনির্ভরশীল দেশ হিসেবে বিশ্বদরবারে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে, সার্থক হয়ে উঠবে সেই '৭১-এর অর্জিত বিজয়, প্রকৃতপক্ষেই শ্রদ্ধা জানানো হবে মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগ করা প্রতিটি শহীদকে। সুলতান শরীফ উদ্দিন মাহমুদ শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ এই বিজয় দিবস শুধু উদযাপনের নয়, নতুন অঙ্গীকারেরও বাংলাদেশ আজ যেকোনো সময়ের তুলনায় ভিন্নরকম এক সময়ের সাক্ষী। ছাত্র অভু্যত্থানে সরকার পরিবর্তন শুধু দেশে নয়; সারা বিশ্বেই আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। দেশের তরুণ-ছাত্রসমাজের বিচক্ষণতা ও নেতৃত্বে লাখো জনতা রাজপথে নেমে এসেছে, নির্ভয়ে লড়াই করেছে, প্রয়োজনে রক্ত দিয়েছে। ফলাফল মাত্র এক মাসে দীর্ঘ ১৫ বছর জাতির ঘাড়ে চেপে বসা স্বৈরাচারের পতন। এবারের বিজয় দিবস শিক্ষার্থীদের নিজ হাতে গড়া বিজয়ের উদযাপন। যেটা আরও নতুন সংকল্প, নতুন প্রত্যয় নিয়ে উদযাপিত হবে। চব্বিশের বিজয় দিবস দেশময় উৎসবের আমেজ নিয়ে এসেছে, যার কেন্দ্রবিন্দু জুলাই ৩৬-এর বিজয়। বাংলাদেশকে সুখী, সমৃদ্ধ, বাসযোগ্য দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে আমাদের জুলাইয়ের চেয়েও বেশি ত্যাগ ও শ্রম দিতে হবে। এই বিজয় দিবস শুধু উদযাপনের নয়, নতুন অঙ্গীকারেরও দিন। ফারহান আহমদ তাওসীফ শিক্ষার্থী, আরবি বিভাগ দেশের স্বার্থে সবাইকে এক থাকতে হবে '৭১, তারপর ২৪। গত ৫ আগস্ট বা ৩৬ জুলাই দ্বিতীয় বিজয় অর্জনের পর আমরা গুরুত্বপূর্ণ একটি সময় পার করছি। ১৯৭১-এ আমরা এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর এই বাংলাদেশ পেয়েছিলাম। তবে ৭১-এ আমরা চূড়ান্ত স্বাধীনতা কি পেয়েছিলাম? যদি পেয়েই থাকি, তাহলে স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর ২০২৪ সালে এসে সেই বাকস্বাধীনতা, ন্যায্য অধিকার এর জন্য আবার কেন রক্ত দিতে হলো?? অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার বা এরপর যে সরকার আসবে তাদের বিরুদ্ধেও যে আমাদের সংগ্রাম করতে হবে না, এর নিশ্চয়তা আমরা দিতে পারি না। ৭১-পরবর্তী বিজয় আর জুলাই-পরবর্তী বিজয়ের প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও স্বাধীনতা রক্ষার প্রশ্নে আমরা সবাই একতাবদ্ধ। তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে সব শ্রেণির মানুষকে অধিকার সচেতন হতে হবে, নীতির প্রশ্নে সবাইকে অবিচল থাকতে হবে। তাহলে আমদের মধ্যে প্রশ্ন করার মানসিকতা তৈরি হবে। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে আমাদের এই অধিকার থেকেই সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত করা হয়েছে। আমাদের কথা বলতে দেওয়া হয়নি। জুলাই বিপস্নব-পরবর্তী সরকারকে আমরা অন্তত প্রশ্ন করার সুযোগ পাচ্ছি। এটা ২৪-এর বিজয়ের অন্যতম একটি অর্জন। এই অর্জনকে অব্যাহত রাখতে আমাদের সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন থাকতে হবে, দেশের স্বার্থে সবাইকে এক থাকতে হবে। কারণ পরাজিত শক্তি এখনো দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য লেগে আছে। সিনথিয়া ইসলাম শিক্ষার্থী, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য