স্বপ্ন যখন এগিয়ে চলা- আত্মবিশ্বাসই শক্তি
বর্তমান যুগ প্রতিযোগিতার, যেখানে টিকে থাকতে হলে থেমে থাকার সুযোগ নেই। কিন্তু অনেক নারী পিছিয়ে পড়েন শুধু নিজস্ব দ্বিধা ও অনিশ্চয়তার কারণে। আমি মনে করি, নারীর অগ্রযাত্রার পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো নারীদের এগিয়ে চলার আত্মবিশ্বাসের অভাব। এক সময় সমাজ ও পরিবারের গন্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকলেও, এখন নারীরা শিক্ষা, প্রযুক্তি, ব্যবসা ও প্রশাসনসহ প্রায় সব ক্ষেত্রে নিজেদের দক্ষতার প্রমাণ দিচ্ছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নারীদের জন্য তৈরি করে দিচ্ছে প্রচুর সম্ভাবনা কর্মের সুযোগ। কিন্তু দেখা যায় আমরা নিজেরাই এই সুযোগগুলো কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যেতে পারি না; কিংবা এগিয়ে যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত চেষ্টা করছি না। বর্তমানে অনেকাংশেই শিক্ষা, সচেতনতা, ও নীতিগত পরিবর্তন আসলেও স্বপ্ন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসের অভাবে মাঝ পথে থেমে যায় অনেক নারী। নারীর এগিয়ে চলার পথে বৈষম্য, নিরাপত্তাহীনতা ও সামাজিক বাধা যতই থাকুক, যদি তারা নিজেরাই সচেতন ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে না ওঠেন, তবে স্বপ্ন পূরণের পথ কঠিন হয়ে যাবে। নারীর অগ্রযাত্রা শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং এটি একটি সমৃদ্ধ সমাজের প্রতিচ্ছবি।
সাদিয়া আফরিন হেমা
বিএসসি ইন ইলেক্ট্রনিক্স অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং,
ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি।
নারীর ক্ষমতায়ন নাকি বৈষম্য দূরীকরণ?
'মানুষ কেন বলে মোদের, নারীর নাই নিজস্ব কিছু; আমি তো দেখি জগৎ চলে, নারীর পিছু পিছু।'
শরদিন্দু কর্মকারের চমৎকার উপমায় ফুটে উঠেছে অসামান্য নারীদের জগৎ-সংসারে অবদানের প্রতিচ্ছবি। পরিবার, বিদ্যালয়, সমাজ, রাষ্ট্র- এমনকি গোটা বিশ্বের সভ্যতার প্রতিটি মোড়কে যেন আঁকা 'নারী' নামক অধ্যায়ের ইতিকথা। বাস্তবতা বলে- নারীর অধিকার, সমতা কেবলমাত্র তখনই সম্ভব হবে যখন বৈষম্য দূর করে ঐক্য ও ক্ষমতার আসনে নারীকে বসানো যাবে। সর্বশেষ আদমশুমারি মতে, দেশে নারী ও পুরুষের অনুপাত ১০০:৯৮। তাই দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশে অসমতা বজায় রেখে উন্নয়নশীল এ দেশকে উন্নত করার চেষ্টা নিরর্থক। অবহেলা, অবজ্ঞা, কর্মক্ষেত্রে বিড়ম্বনা, নিরাপত্তাহীনতা ও অশিক্ষাই নারীর অনগ্রসরতার মূল কারণ। নারী দিবসকে শুধু দিন হিসেবে উৎযাপন নয়, সর্বস্তরের মানুষের মাঝে নারীদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করাই এর উদ্দেশ্য। সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ পিছিয়ে পড়া নারীসমাজ থেকে বৈষম্য দূরীকরণ করে ক্ষমতায়ন করা। কেননা, নারী-পুরুষের সমতার মাঝেই নারী ও কন্যার উন্নয়ন নিহিত- যা 'নারী দিবস-২০২৫' এর প্রতিপাদ্য বিষয়।
দিপা আক্তার
এমবিবিএস, পঞ্চম বর্ষ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ।
নারীর প্রতি বৈষম্য ও সহিংসতা বন্ধ হোক
১৯০৮ সালে নারীর সমঅধিকার, ন্যায্য মজুরি, কর্মঘণ্টা হ্রাস ও ভোটাধিকারের দাবিতে যে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, তার পথ ধরেই আজ আমরা আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করি। কিন্তু ২০২৫ সালেও কি সেই দাবিগুলো পূরণ হয়েছে? নারীরা এখনো অধিকার ও নিরাপত্তার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র, নেতৃত্ব সবখানেই নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। তবু নিরাপত্তাহীনতা তাদের নিত্যসঙ্গী। প্রতিদিনের সংবাদ কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চোখ রাখলেই নারীর প্রতি সহিংসতা, বৈষম্য কিংবা যৌন নিপীড়নের নির্মম চিত্র দেখা যায়। দ্যা ডেইলি স্টারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৪ বছরে প্রতিদিন প্রায় দুইজন নারী ধর্ষিত হয়- এ যেন সভ্যতার ভয়াবহ নিদর্শন!
নারীরা স্বপ্ন দেখতে শিখেছে, ঘর থেকে বেরিয়ে কাজ করতে শিখেছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়- তারা কি আদো নিরাপদ?
তাই নারী দিবস শুধু প্রতীকী উদযাপন নয়, এটি হোক অধিকার, মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার শপথের দিন। বৈষম্য ও সহিংসতা বন্ধ হোক। গড়ে উঠুক এক নিরাপদ, সম্মানজনক ও সাম্যের সমাজ- যেখানে নারী শুধুই বাঁচবে না, সম্মানের সঙ্গে বাঁচবে।
সানজিদা নাজমীন তারিন
প্রাণিবিদ্যা বিভাগ
ফেনী সরকারি কলেজ।
অপরাজিতা নারী যখন পরাজয়ের কাতারে
একটা বোধ বিবেচনা ক্ষমতা প্রদত্ত প্রাণী, জন্ম নেয়, কিছুটা বড় হয়, তারপর থেকে অপরের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করে। আর এই সীমিত নিজস্বতার জীবনেও তারা কেউ কেউ সৃষ্টি করে যায় অতুলনীয় দৃষ্টান্ত। শরীরে জোর কম, রুখে দাঁড়ানোর সাহসও তাই কম। নিরাপত্তার জন্য আইন নামক বেড়াজালে জড়ানোর মতো সামর্থ বা ইচ্ছে তারা পোষণ করে খুব সামান্য। বলছি, নারী নামক প্রাণীর কথা। বিভিন্ন ধর্ম মতে এই নারীদের সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করা হলেও, মনুষ্যত্ববোধের অভাব, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিপরীত লিঙ্গের বিবেক বিবেচনা বর্জিত কিছু প্রাণীর মনে সাড়া জাগায় না, যখন তারা সেই নারীর প্রতি তাদের পশুত্ব কায়েমে তৎপর। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের এটা সাধারণ ধর্ম যে এখানে সবাই সমান মর্যাদা ভোগ করবে, সমান নিরাপত্তা ভোগ করবে। আদৌ কি তা হয়? নাকি হওয়া সম্ভব?
আইনের বেড়াজাল সম্পর্কে আমিও সেই নারীদের কাতারেই সীমাবদ্ধ। তাই পরামর্শ দিতে পারি, নিজের নিরাপত্তা নিজেই যদি কিছুটা নিশ্চত করতে পারি, সেল্ফ ডিফেন্স কৌশল শিখে, ঘরের বাইরে সর্বদা বিপদ মোকাবিলায় তৈরি থেকে, সম্ভব হলে আইন বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করে।
সানজিদা শারমিন
ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্সু্যরেন্স বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
নারী-পুরুষ সমতা, স্বপ্ন হোক বাস্তবতা
'বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী,অর্ধেক তার নর'।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম ঠিক এভাবেই নারীদের কাজের প্রশংসা করে গিয়েছেন তার কবিতার ছন্দে।
কিন্তু আমাদের সমাজ ব্যবস্থা কি নারীদের আসলেই প্রকৃত মর্যাদা দিতে পারছে? নাকি শুধু নারী দিবসের শুভেচ্ছা অব্দি সেটি সীমাবদ্ধ? ৮ মার্চ নারী দিবস হিসেবে স্বকৃীতি পাওয়ার পেছনেও রয়েছে নানা অত্যাচারের গল্প। নারীদের প্রতি বৈষম্য রোধে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কনভেনশন হলো সিডো- যা নারীর অধিকারের ওপর একটি বিস্তৃত চুক্তি হিসেবে, নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতা নিশ্চিত করার জন্য নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করার জন্য রাষ্ট্রপক্ষের ওপর আইনগতভাবে বাধ্যবাধকতা স্থাপন করে। তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৪ সালে এই সনদে স্বাক্ষর করে। কিন্তু আমরা আমাদের চারপাশে এখনো নারীদের ওপর নানা অত্যাচার খবর দেখতে পাই- র?্যাপ, ইভটিজিং এসব যেন নিত্যকার ঘটনা। যে উদ্দেশ্যে আমরা নারী দিবস উদযাপন করছি তার যথাযথ প্রয়োগ যেন নিশ্চিত হয়। নারী দিবসে চাই সব নারীরা নিরাপদ থাকুক, সুস্থ থাকুক, ভালো থাকুক। সবাইকে নারী দিবসের শুভেচ্ছা।
আনিকা তাবাসসুম অন্তরা
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ,
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
নারীর চোখে বিশ্ব জয়
সভ্যতার বিকাশের জন্য পুরুষের পাশাপাশি নারীর উন্নয়ন জরুরি। পাশ্চাত্যের তুলনায় দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নারীরা কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও বর্তমানে তারা এগিয়ে যাচ্ছেন। একুশ শতকের বাংলার নারীরা সংসারের পাশাপাশি নিজের জ্ঞান, প্রতিভা, শক্তিসামর্থ্য ও কর্মদক্ষতার দরুন প্রতিটা সেক্টরে সাফল্যের পরিচয় দিচ্ছেন দাপটের সঙ্গে। পোশাক শিল্পে অসামান্য অবদানের মাধ্যমে অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখছেন। সর্বশেষ জুলাই'র গণ-অভু্যত্থানে নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ, সাহসী ভূমিকা নারীর ইতিবাচক উন্নয়নের দিকেই ইঙ্গিত করে।
কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নকামী দেশগুলোতে এখনো নারীরা এগিয়ে যাওয়ার পথে নানারকম বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হন। গৃহ থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, কর্মক্ষেত্র প্রতিটা জায়গায় শারীরিক, মানসিক নিপীড়নের শিকার হন। এমনকি শিশু থেকে শুরু করে ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধাকে হতে হয় যৌন লালসার শিকার। তবু আমাদের প্রত্যাশা সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে আপনশক্তিতে নারী বিশ্ব জয় করবেই। নজরুল বলেছেন, 'শত নিষেধের সিন্ধুর মাঝে অন্তরালের অন্তরীপ তারি বুকে নারী বসে আছে জ্বালি বিপদ বাতির সিন্ধুদীপ' নারীর আত্ম ও বহির্জগতের মুক্তি হোক আন্তর্জাতিক নারী দিবসে আমাদের অঙ্গীকার।
\হ
জান্নাতুল নাঈমা
শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।