মানবসম্প্রীতির অনন্য নিদর্শন পবিত্র ঈদ

ঈদ অর্থ খুশি এবং ফিতর এসেছে ফিতরা থেকে। কবি কাজী নজরুলের ভাষায় 'তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিলস্নাহ/ দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ।' সমগ্র বিশ্বের প্রত্যেক মুসলমান যাতে ঈদুল ফিতরের আনন্দ উপভোগ করতে পারেন, সেজন্য রমজান মাসে বেশি পরিমাণে দান-খয়রাত, জাকাত ও ফিতরা প্রদানের কথা বলা হয়েছে।

প্রকাশ | ২৩ মে ২০২০, ০০:০০

মোহাম্মদ আবু নোমান
'ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ/ তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।' ঈদুল ফিতরকে নিয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এ কালজয়ী গান রচনা করেন ১৯৩১ সালে। লেখার চারদিন পর শিল্পী আব্বাসউদ্দীনের গলায় গানটি রেকর্ড করা হয়। দুই মাস পর ঈদের ঠিক আগে আগে এই রেকর্ড প্রচার করা হয়। 'ঈদ' শব্দটি আরবি। শব্দ মূল 'আউদ', এর অর্থ এমন উৎসব যা ফিরে ফিরে আসে, পুনরায় অনুষ্ঠিত হয়। ঈদ মানেই পরম আনন্দ ও খুশির উৎসব। প্রতি বছর দু-দুটি ঈদ উৎসব মুসলমানদের জীবনে নিয়ে আসে আনন্দের ফল্গুধারা। এ দুটি ঈদের মধ্যে ঈদুল ফিতরের প্রভাব, ব্যাপ্তি মুসলিম মানসে ও জীবনে বহুদূর বিস্তৃত। পূর্ণ একমাস সিয়াম সাধনার পর ঈদ উৎসব মুসলিম জাতির প্রতি সত্যিই মহান রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে এক বিরাট নেয়ামত ও পুরস্কার। আর মনে রাখতে হবে, ইসলাম কোনো অনুষ্ঠানসর্বস্ব ধর্ম নয়। মানুষের জীবনব্যবস্থা থেকে ইসলামকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার কোনো সংস্থান নেই। মানুষের ক্ষুধা-পিপাসা আছে, জৈবিক চাহিদা আছে। তা সত্ত্বেও মহান সৃষ্টিকর্তার নির্দেশ 'খেয়ো না, পান করো না'; তখন মানুষ আলস্নাহর ভয়, আলস্নাহর বড়ত্ব এবং আনুগত্যের ভিত্তিতে পানাহার থেকে বিরত থাকে। ফ্রিজে ঠান্ডা পানি আছে, পিপাসায় কাতর, ঘরে কেউ নেই, আলস্নাহর ভয়ে সারা দিন ঠোঁট, মুখ, কণ্ঠনালি শুকিয়ে রাখে; তবুও পানি পান করে না। মহান আলস্নাহর অসংখ্য শোকর, তিনি আমাদের পবিত্র রমজান দান করেছেন। মাসটিকে তিনি অফুরন্ত নেয়ামত দ্বারা সমৃদ্ধ করেছেন। এ মোবারক মাস শেষে তার বরকত লাভে ধন্য হওয়ার খুশিতে ঈদুল ফিতর দান করেছেন। সাধারণ ক্ষমার দিন ঈদ সাধারণত দুনিয়ার রাজা-বাদশাহরা বছরের বিশেষ কিছু দিনে দেশের অপরাধীদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে থাকেন। তেমনি মহান আলস্নাহ তার বান্দাদের জন্য ঈদের দিন সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (স.) ইরশাদ করেন, ঈদের দিন মহান আলস্নাহ ফেরেশতাদের মধ্যে (যারা মানব সৃষ্টিতে আপত্তি তুলেছিল) রোজাদারদের নিয়ে গর্ব করে বলেন, হে ফেরেশতাগণ, আমার কর্তব্যপরায়ণ প্রেমিক বান্দার বিনিময় কী হবে ফেরেশতাগণ উত্তরে বলেন, যে শ্রমিক তার কাজ পূর্ণ করেছে তার পরিপূর্ণ মজুরি দেয়া কর্তব্য। আলস্নাহপাক বলেন, আমার বান্দারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছে। দোয়া করতে করতে ঈদগাহে গমন করেছে। আমার মর্যাদা, আমার সম্মান, দয়া ও বড়ত্বের কসম আমি তাদের দোয়া কবুল করব এবং তাদের মাফ করে দেবো। মুসলমানের উৎসব মুসলমানদের ধর্মীয় দুটি উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার প্রবর্তন হয় দ্বিতীয় হিজরি সনে। বদরের বিজয়ের ১৩ দিন পর পহেলা শাওয়াল ঈদুল ফিতর উদযাপন করা হয়। পরে মদিনার সুদখোর মহাজন ইহুদি বনু কাইনুকা সম্প্রদায়কে নিরস্ত্র করার পর ১০ জিলহজ ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ পালন করা হয়। রাসূল (স.) বলেন, 'প্রতিটি জাতির উৎসব আছে, আমাদের উৎসব হলো এই দুই ঈদ' (মুসলিম, তিরমিজি)। মহানবী (স.) ইরশাদ করেন, 'যারা রমজানে রোজা রাখেনি তারা ঈদের নামাজে সুসংবাদপ্রাপ্ত মুক্তিপ্রাপ্ত মানুষের কাতারে শামিল হবে না। তাদের জন্য কোনো আনন্দ নেই। আর যারা রোজা পালন করেছে, গরিবদের নিজের মাল থেকে ফিতরা দিয়েছে শুধু ঈদ তাদের জন্যই। তবে যাদের রোজা রাখার বয়স হয়নি অথবা বিশেষ কোনো কারণে রোজা রাখতে পারেনি তারাও ঈদের এই আনন্দে শরিক হতে পারবে। কিন্তু যারা বিনা কারণে এবং অলসতা করে রোজা রাখেনি তাদের জন্য এ ঈদে আনন্দ নেই। এ ঈদ তাদের জন্য আনন্দস্বরূপ নয়, বরং তিরস্কারস্বরূপ।' সাদাকাতুল ফিতরের আর্থ-সামাজিক গুরুত্ব ঈদ অর্থ খুশি এবং ফিতর এসেছে ফিতরা থেকে। কবি কাজী নজরুলের ভাষায় 'তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিলস্নাহ/ দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ।' সমগ্র বিশ্বের প্রত্যেক মুসলমান যাতে ঈদুল ফিতরের আনন্দ উপভোগ করতে পারেন, সেজন্য রমজান মাসে বেশি পরিমাণে দান-খয়রাত, জাকাত ও ফিতরা প্রদানের কথা বলা হয়েছে। ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সাদা-কালো নির্বিশেষে একই কাতারে মিলিত হওয়া মানবসম্প্রীতির এক অনন্য নিদর্শন পবিত্র ঈদ। সুতরাং ঈদুল ফিতরের অর্থ দাঁড়ায় দান-খয়রাতের মাধ্যমে পবিত্র ঈদের উৎসবকে আনন্দে উদ্ভাসিত করে তোলা। কাজী নজরুল ইসলাম আরও বলেন, 'যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা, নিত্য উপবাসী/ সেই গরিব ইয়াতিম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদ'। ঈদে শুধু বিত্তশালীরা আনন্দ করবে এরকম নয়, বরং ঈদ সবার জন্য। ধনীরা যেভাবে পোশাক পরে ভালোভালো খাবার খেয়ে আনন্দ করে গরিবরাও সেভাবে আনন্দ করবে। শুধু ধনীরা আনন্দ করবে আর এতিম অসহায়রা আনন্দ থেকে বঞ্চিত থাকবে- এটা ঈদের মূল শিক্ষা নয়। অসহায় ও গরিব মানুষ এই সমাজেরই। তারা সারা বছরই দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে নিদারুণ কষ্টের মধ্যে থাকে। তারা কমপক্ষে ঈদের দিন যাতে আনন্দে সবার সঙ্গে শরিক হতে পারে, এ জন্য তাদের কিছু খাদ্য ও বস্ত্রের ব্যবস্থা করে দেয়া উচিত। ঈদের দিনে যাতে মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘোরা থেকে তারা বাঁচতে পারে। সমাজে বসবাসকারী ধনিক শ্রেণির মানুষের সঙ্গে গরিবরাও যাতে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারে, এ জন্য সাদাকাতুল ফিতরের আমলকে ওয়াজিব করা হয়েছে। ফিতরার মাধ্যমে মুসলিম সমাজে বসবাসকারী ধনীদের অর্থ গরিবদের মধ্যে বণ্টিত হয় এবং এর দ্বারা তাদের জীবনযাপনে কিছুটা হলেও গতি সৃষ্টি হয়। এজন্য ইসলামে সাদাকাতুল ফিতরের গুরুত্ব অপরিসীম। এর মাধ্যমে সমাজে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে সমতা আসে এবং সহযোগিতার বিস্তার ঘটে। সামর্থাবান, জীবিকা নির্বাহের অত্যাবশকীয় সামগ্রী ছাড়া নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকদের পক্ষ থেকে, গরিবদের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণের অর্থ প্রদান করাই মূলত সাদাকাতুল ফিতর। রোজা না রাখলে অথবা রাখতে না পারলেও ফিতরা দেওয়া ওয়াজিব। ফিতরা ওয়াজিব করা হয়েছে- প্রথমত রোজা রাখার ক্ষেত্রে যে কোনো ধরনের ভুলভ্রান্তি হয়ে থাকলে তার ক্ষতিপূরণ বা কাফফারা হিসেবে। দ্বিতীয়ত অসহায় মিসকিনদের জন্য ঈদের রিজিকের ব্যবস্থা করার জন্য, যাতে তারাও সবার সঙ্গে আনন্দ উপভোগ করতে পারে। রাসূল (স.) রোজা ফরজ হওয়ার বছরেই, জাকাত ফরজ হওয়ার আগে সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তবে জাকাতের মতো এ ক্ষেত্রে এক বছর অতিক্রান্ত হওয়া জরুরি নয়। বরং কেউ যদি ঈদের আগের দিনও ইসলাম নির্দেশিত (নিসাব) পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়, তাকেই ফিতরা আদায় করতে হবে। ধর্মীয় তাৎপর্য রমজানে রোজা পালনের মূল শিক্ষা হচ্ছে, তাকওয়া অর্জন করা। মাহে রমজানের রোজার মাধ্যমে নিজেদের অতীত জীবনের সব পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হওয়ার অনুভূতি ধারণ করেই পরিপূর্ণতা লাভ করে ঈদের খুশি। ঈদুল ফিতরের দিন আমাদের পর্যবেক্ষণ করার আহ্বান জানায়, আমরা আমল ও আখলাকের এ প্রশিক্ষণ কোর্সে সত্যিই কি সফলতা লাভ করেছি সত্যিই কি আলস্নাহর সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের উন্নতি ঘটেছে আমরা কি বান্দার হক চিনতে শুরু করেছি আমাদের অন্তরে আমানতদারি, সাধুতা, সংযম ও কর্মপ্রেরণা সৃষ্টি হয়েছে কী আমরা কি সর্বত্র বিস্তৃত সামাজিক অপকর্ম বিলুপ্ত করার ও নিজেরা তা থেকে বিরত থাকার নতুন করে অঙ্গীকার করেছি আমাদের অন্তরে দেশ জাতির কল্যাণ ও উন্নতি সাধনের উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে কি আমরা কি পরস্পরের কলহ-বিবাদ মিটিয়ে এক দেহ এক প্রাণের মতো ঐক্য স্থাপনের সংকল্প করেছি ঠান্ডা মাথায় ও ইনসাফের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করার পর যদি এসব প্রশ্নের কিংবা এর মধ্যে থেকে কিছু প্রশ্নের উত্তর ইতিবাচক পাওয়া যায়, তাহলে তার জন্য সত্যিই ঈদ মোবারক। ঈদ সংস্কৃতি মূলত মানুষকে পরিশুদ্ধ করার জন্য। জীবনযাপনে স্বচ্ছতা আনয়ন করা, ত্যাগী মানসিকতা সৃষ্টি করা, প্রকৃত মানবতার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করা এবং আলস্নাহ রাব্বুল আলামিনের প্রতিটি সৃষ্টির প্রতি তার নির্দেশিত পন্থায় আচরণ করা। সব ঈদের তাৎপর্য অনুধাবন করলেই ঈদ উদযাপনের সার্থকতার পাশাপাশি সমাজের প্রকৃত কল্যাণ সাধন সম্ভব। সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন কবি নজরুল ইসলামের ভাষায়, 'আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমন, হাত মেলাও হাতে/ তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ।' ঈদ এসেছে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে একে-অন্যের সঙ্গে আবদ্ধ হওয়ার জন্য। হিংসা, বিদ্বেষ হানাহানি, মারামারি সব মুছে ফেলার জন্য। ঈদুল ফিতরের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতায় পরস্পরের শুভেচ্ছা, আন্তরিকতা ও সহমর্মিতা বিনিময়ের মাধ্যমে মানবিক ও সামাজিক সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। ঈদে পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানানো শরিয়ত অনুমোদিত একটি বিষয়। বিভিন্ন বাক্য দ্বারা এ শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। হাফেজ ইবনে হাজার (র.) বলেছেন, সাহাবায়ে কেরামরা ঈদের দিন সাক্ষাৎকালে একে অন্যকে বলতেন : 'তাকাব্বালালস্নাহু মিন্না, ওয়া মিনকা' অর্থ- আলস্নাহতায়ালা আমাদের ও আপনার ভালো কাজগুলো কবুল করুন। এছাড়া 'ঈদ মোবারক' শব্দটি মুসলিমদের একটি ঐতিহ্যবাহী শুভেচ্ছাবাক্য যেটি তারা ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহায় পরস্পরকে বলে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করে থাকেন। ঈদ শব্দের অর্থ আনন্দ বা উদযাপন। আর মোবারক শব্দের অর্থ কল্যাণময়। সুতরাং ঈদ মোবারকের অর্থ হলো ঈদ বা আনন্দ উদযাপন কল্যাণময় হোক। ঈদের দিনের কয়েকটি আমল শরিয়তের সীমার মধ্যে থেকে যথাসাধ্য সুসজ্জিত হওয়া, ২. গোসল করা, ৩. মিসওয়াক করা, ৪. যথাসম্ভব উত্তম কাপড় পরিধান করা, ৫. খোশবু লাগানো, ৬. খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠা, ৭. ফজরের নামাজের পরই ভোরে ঈদগাহে যাওয়া, ৮. ঈদগাহে যাওয়ার আগে খুরমা অথবা অন্য কোনো মিষ্টিদ্রব্য খাওয়া, ৯. ঈদগাহে যাওয়ার আগে সদকায়ে ফিতর আদায় করা, ১০. ঈদের নামাজ ঈদগাহে আদায় করা; ওজর ছাড়া মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় না করা, ১১. ঈদগাহে এক রাস্তায় যাওয়া ও অন্য রাস্তায় ফিরে আসা, ১২. ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া, ১৩. ঈদের চাঁদ দেখার পর থেকে তাকবির পাঠ করা : তাকবির পাঠ করার মাধ্যমে আলস্নাহর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করা হয়। তাকবির হলো 'আলস্নাহু আকবার, আলস্নাহু আকবার, লা-ইলাহা ইলস্নালস্নাহু আলস্নাহু আকবার, আলস্নাহু আকবার, ওয়া লিলস্নাহিল হামদ'। রাসূল (সা.) ঈদুল ফিতরের দিন ঘর থেকে বের হয়ে ঈদগাহে পৌঁছা পর্যন্ত তাকবির পাঠ করতেন। মোহাম্মদ আবু নোমান: কলাম লেখক