করোনাভাইরাস, ডেঙ্গু অতঃপর

আম্পান এটিও প্রকৃতির লীলাখেলা। প্রকৃতিকে আমরা নানাভাবে আঘাত করে চলেছি আমাদের জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে। তাই প্রকৃতিও আমাদের ওপর প্রতিশোধ হিসেবে তার কার্যকারণ দেখাচ্ছে। প্রকৃতির এবারের হাতিয়ার ছিল আম্পান নামক ঘূর্ণিঝড়। প্রকৃতির দান সুন্দরবন তার বুক বিলিয়ে দিয়ে আম্পানকে অন্যদিকে সরিয়ে দিয়ে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ তথা আমাদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা করেছে।

প্রকাশ | ২৯ মে ২০২০, ০০:০০

আম্পান শতদল বড়ুয়া
করোনাভাইরাসের গতির কোনো সীমারেখা নেই। একেক সময় একেক জায়গায় গিয়ে আত্মপ্রকাশ ঘটাচ্ছে তবে এটি ঠিক যে, এ গতির হঠাৎ পতন ঘটবে। তাই সবকিছু সময়ের ব্যাপার। বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জে এমন আঘাত হানে পুরো বাংলাদেশ বিশ্বের মতো থমকে যায়। আমাদের করণীয় কী তা বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রতিদিন দুপুর আড়াইটায় সংবাদ বুলেটিনের মাধ্যমে জানিয়ে দিচ্ছেন। দেশ দরদি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর হস্তক্ষেপের কারণে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে অনেকটা সফলতা এসেছে। সরকার প্রধান হিসেবে তিনি সবধরনের সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে দেশের সাধারণ জনগণকে। দেশের মানুষ প্রথম প্রথম করোনাভাইরাসকে সমীহ করলেও বর্তমানে অকুতোভয়ের মতো আচরণ দেখাচ্ছে। এতেই আমাদের হিতে বিপরীত হচ্ছে। করোনাভাইরাস লাফিয়ে লাফিয়ে মানুষের শরীরে বাসা বেঁধে তার বিস্তার ঘটাচ্ছে। বাংলাদেশে প্রথম ঝুঁকিতে ছিল নারায়ণগঞ্জ। এখন দ্বিতীয় ঝুঁকিতে চট্টগ্রাম। কাউতে তো দোষারোপ করতে পারছি না। অচেনা লোককে আমরাই তো পথ চিনিয়ে দিচ্ছি। কুড়ালকে গাছ বলে- তুমি এত নিষ্ঠুর কেন? আমাকে কেটে কেটে ক্ষত-বিক্ষত করে দিচ্ছ? কুড়াল বলে- আমাকে দোষারোপ করে লাভ কি? তোমার জাতভাই তো তোমার জীবন বিপন্ন করে দিচ্ছে। করোনাভাইরাসকেও আমরা উলিস্নখিতভাবে সোহাগ-আদর করে নিজেদের বিপদ নিজেরাই ডেকে আনছি। চট্টগ্রামে সাংবাদিক ও চিকিৎসকসহ ৬১ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এই নীরব ঘাতকের হাত থেকে রক্ষার একমাত্র উপায় নিজে সচেতন থাকা এবং অন্যকে নিরাপদে রাখার জন্য সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। প্রতিদিন বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে জনসচেতনতামূলক সতর্কবাণী বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক এবং টেলিভিশন চ্যানেলের প্রচার করা হচ্ছে। একজন ব্যাংকার বললেন, এখন আর টিভি দেখি না, খবরের কাগজও পড়ি না। বিরক্তিভাব এসে গেছে। তার সহকর্মী বলল- আপনি একজন শিক্ষিত লোক হয়ে একথা বলতে পারলেন। অন্যরা কোথায় যাবে? টিভি না দেখলেন, খবরের কাগজও পড়লেন না অন্যজনকে কীভাবে আপনি পরামর্শ দেবেন বা দিকনিদের্শনা প্রদান করবেন? এ দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে আপনার দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক। ব্যাংকার বললেন- দূর ভাই আর বক বক করেন না, পকেটে অর্থ না থাকলে মাথা এমনি খারাপ হয়ে যায়। বউ-বাচ্চাকে বাঁচিয়ে রাখবো কীভাবে! যাক, আমরা নানা মুনির নানা তপে যাচ্ছি না। সরকারি নির্দেশনা মেনে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সচেতন না হলে আরও কঠিন সময় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন দেশের বাঘা বাঘা গবেষক, বিজ্ঞানী এবং চিন্তাবিদরা। নিজের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিজেরই হাতে। পরিবার-পরিজনকে ভালো রাখতে চাইলে সরকার নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে আমাদের। বিজ্ঞজনের মতামত হলো- আপাতত করোনাভাইরাস প্রতিরোধের একমাত্র প্রতিষেধক সরকারি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। এখন জীবন-মরণ আপনার হাতে। ডেঙ্গ : ডেঙ্গুও স্বমহিমায় আত্মপ্রকাশ ঘটাতে শুরু করেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে করোনাভাইরাসের সঙ্গে ডেঙ্গুর সুসম্পর্ক রয়েছে। ডেঙ্গু তো মৌসুমী রোগ। বছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এর দাপট চলে। এখন দেখা যায় ডেঙ্গু জ্বরের সময়কাল অনেক এগিয়ে এসেছে। ডেঙ্গু জ্বরও আমাদের জীবন গতি চিরদিনের জন্য থামিয়ে দিতে কার্পণ্য করে না। তাই বলব- সাবধানতার কোনো বিকল্প নেই। করোনাভাইরাসের মতো ডেঙ্গু জ্বরেরও সুনির্দিষ্ট লক্ষণ রয়েছে বলে জানালেন বিশিষ্ট একজন চিকিৎসক। জ্বর ১০১ ডিগ্রি থেকে ১০২ ডিগ্রি তাপমাত্রা একটানা থাকতে পারে। ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে দেওয়ার পর আবারও জ্বর আসতে পারে। শরীরের সঙ্গে মাথাব্যথা, চোখের পিছনে ব্যথা, চামড়ায় লালচে দাগ র্(যাশ) হতে পারে। এই লক্ষণগুলো না থাকলেও ডেঙ্গু জ্বর হতে পারে। ডেঙ্গু জ্বরেরও এ, বি, সি তিন স্তর রয়েছে। এ-শ্রেণির জ্বর সাধারণ। বি-শ্রেণির জ্বরও প্রায় স্বাভাবিক পর্যায়ের। তারপরেও কিছু লক্ষণ হলো- পেটে ব্যথা, প্রচুর পরিমাণে বমি, কিছু খেতে মন না চাওয়া। জ্বরের কারণে শরীর ঠান্ডা হয়ে যেতে পারে বলেও জানালেন ওই চিকিৎসক। সেই শ্রেণির জ্বর মারাত্মক। সি-শ্রেণির জ্বর মারাত্মক এ ধরনের রোগীর ক্ষেত্রে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউর প্রয়োজন হতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ একান্ত অপরিহার্য বিষয়। চিকিৎসক আরও জানালেন- ডেঙ্গু জ্বরের বাহক এডিস মশা। এরা নাকি ভদ্র মশা হিসেবেও পরিচিত। এদের পছন্দ হলো- আলিশান সুন্দর বাড়ি। এরা কিন্তু আক্রমণ করে নির্দিষ্ট সময়ে। অন্ধকারে এরা কামড়ায় না। সকালের দিকে এবং সন্ধ্যার কিছু আগে এডিস মশা তৎপর হয়ে ওঠে। এডিস মশা ডিম পাড়ে স্বচ্ছ পানিতে। বাড়ির ছাদে কিংবা ফুলের টবে, নির্মাণাধীন ভবনের বিভিন্ন পয়েন্টে, রাস্তার পাশে পড়ে থাকা টায়ারে কিংবা অন্যান্য পাত্রে জমে থাকা পানিতে এডিস মশা বংশবিস্তার করে। অন্যান্য সাধারণ মশার চেয়ে এডিস মশা খুবই মারাত্মক। শারীরিক গঠনের দিক দিয়ে এডিস মশা সাধারণ মশার চেয়ে বড়। আমরা একটু লক্ষ্য করলে সহজেই বুঝতে পারব। এডিস মশার কামড় তথা ডেঙ্গু জ্বরের হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে নিজেদেরই সচেতন হতে হবে। ঠিক করোনাভাইরাসের মতো। তাই আমি শুরুতে বলেছি- এদের মধ্যে একটা সুসম্পর্ক রয়েছে, যা এবার আমাদের ইঙ্গিত দিল আগামতৎপর হয়ে ওঠে। জমা পানি এদের বংশবিস্তারের প্রধান উৎস। তিন থেকে পাঁচদিনের অধিক পানি পাত্রে জমা রাখা যাবে না। ঢাকনাবিহীন পানি বাসা-বাড়িতে এসময়ে রাখা মোটেও উচিত হবে না জানালেন বিজ্ঞমহল। দেশের সিটি করপোরেশনের মেয়ররা এডিস মশা নিধনে নালা-নর্দমার ওষুধ ছিটানোর কাজ শুরু করে দিয়েছেন। এদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ সাধারণ জনগণও দিতে পারে। কারণ সম্মিলিত প্রচেষ্টার কোনো জুড়ি নেই। কাউকে সরাসরি দোষারোপ না করে নাগরিক অধিকার হিসেবে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে এডিস মশা নিধনে সবাই এগিয়ে এলে ডেঙ্গু জ্বর থেকে রেহাই পাবো আমরা। একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না- রোগের লক্ষণ দেখা দিলে অবহেলা না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। না হয় জীবনপ্রদীপ চিরদিনের জন্য নিভেও যেতে পারে। আম্পান এটিও প্রকৃতির লীলাখেলা। প্রকৃতিকে আমরা নানাভাবে আঘাত করে চলেছি আমাদের জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে। তাই প্রকৃতিও আমাদের ওপর প্রতিশোধ হিসেবে তার কার্যকারণ দেখাচ্ছে। প্রকৃতির এবারের হাতিয়ার ছিল আম্পান নামক ঘূর্ণিঝড়। প্রকৃতির দান সুন্দরবন তার বুক বিলিয়ে দিয়ে আম্পানকে অন্যদিকে সরিয়ে দিয়ে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ তথা আমাদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা করেছে। তারপরও সাতক্ষীরাসহ বাংলাদেশের কয়েকটি অঞ্চলকে লন্ডভন্ড করে দিয়ে আম্পান। প্রায় ২৬ জন মানুষের মৃতু্য ঘটিয়েছে। প্রকৃতি থেকে আমাদের শিক্ষণীয় অনেক কিছু আছে। আসুন প্রকৃতিকে শান্ত রাখার আন্দোলন গড়ে তুলি। নয়তো প্রকৃতি আমাদের অহরাত্র অশান্তিতে রাখবে। শতদল বড়ুয়া : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক