শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

করোনা ও সময় চলে যায়

অবিনাশ পুরকায়স্থ
  ০৫ জুন ২০২০, ০০:০০

করোনা তার ক্রান্তিকাল অতিক্রম ক্ষেত্রে বেদনাময় ঘটনার পাশাপাশি শুভ কোনো ঘটনার প্রাপ্তি পাইয়ে দেবে কিনা তা এই মুহূর্তে ভাবতে বসে অজানা; কিন্তু যেটি জানা সেটি হলো বন্যায় বসত-বাড়ি, ক্ষেত-খামার সবই ভাসিয়ে নিয়ে যায়; কিন্তু যাওয়ার বেলায় মাটিতে পলি ফেলে যায়, যে পলিমাটিকে কেন্দ্র করে উর্বর, ফসলকে করে পুষ্ট। অনেকটা তেমনই রানু হাফিজের গল্প অবলম্বনে হামিদুর রহমান পাপ্পুর নাট্যরূপ এবং নির্দেশনায় শৌখিন থিয়েটারের প্রযোজনা শ্রম্নতি নাটক 'সময় চলে যায়' যার উদ্বোধনী উপস্থাপন ও শ্রবণ হয় শৌখিন থিয়েটারের নিজস্ব ফেসবুক মাধ্যমে প্রকাশনায়।

প্রকাশিত সত্য, ইংরেজি বিভাগের শিক্ষয়িত্রী নীলা ঘরে ফিরে দেখেন দরজা ভাঙা, আলমারির কপাট আলগা, লকারে রক্ষিত সব অর্থ, স্বর্ণালংকার লোপাট। ঘরের দামি জিনিসপত্র লুট হয়ে গেলেও তাতে ভেঙে পড়েনি নীলা, কারণ দসু্যরা সব নিলেও নেয় নিতার আত্মার স্মৃতিবিজড়িত পুরাতন রেডিও। রেডিও রেখে যাওয়ার কারণে দসু্যদের প্রতি নীলার এক রকমের কৃতজ্ঞতা।

কৃতজ্ঞ হয়েছিল লিনা যখন শাশুড়ি তার বিবাহের দিন ভালোবেসে তুলে দিয়েছিল তার হাতে আলমারির এক লকারভর্তি সোনার গহনা। স্বামী রায়হানের পাশাপাশি এই গহনা প্রাপ্তি ছিল শাশুড়িমায়ের কাছ থেকে বংশের সুনাম ঐতিহ্য ধারণ ও বহনের মিষ্টিমধুর দিকনির্দেশনা। নির্দেশিত পথে হাঁটতে গিয়ে গর্ভের সন্তানকে নিয়ে এক ঝড়-বৃষ্টির রাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নীলা দেখেছিল, দেশকে স্বাধীন করতে স্বামীর মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া। ভালোবেসে গর্ভের সন্তান সোহেল বিবাহে আবদ্ধ হয়ে মা নীলা পুত্রবধূকে স্বাগত জানিয়ে লকারভর্তি গহনা দিতে মেয়ে পুত্রবধূ কর্তৃক হয় প্রত্যাঘাত। আধুনিক ডিজাইনের কাছে এই গহনা কোনোভাবেই টেকে না। নিজ বাড়িতে ছেলের বউকে রাখতে চাইলেও তারা বারিধারার হাই ফ্যামিলিতে থাকবে বলে মায়ের কাছে থাকে না। দিদার সাথী যে নাতি সেই নাতিকেও দিদা আধুনিক মা লালিত পরিবারের কারণে পায় না। ১৭ বছর বয়স থেকে স্ত্রী লিনা যুদ্ধফেরত রায়হানের আসার অপেক্ষায় তবু রায়হান আসে না। সন্তানের সব রুচির সমর্থক হয়েও সন্তান ও বৌমাকে কাছে রাখতে মা নীলা পারে না। নাতির সান্নিধ্য পেতে উতলা হয়েও দিদা নীলার অসহায়ত্ব কাটে না। অসহায় নীলা গৃহের জানালার পাশে রেডিওর ভলিউম বাড়িয়ে দিয়ে দূর আকাশ পানে চোখ ভাসায়। এই রেডিওটা নীলাও তার স্বামীর স্মৃতির সর্বাপেক্ষা নিকটতম সঙ্গী। দসু্যরা সব নিলেও রেডিও নেয়নি। অর্থ নীলা ও রায়হান ক্ষেত্রে সেই যুদ্ধে যাওয়া আর আজকের দিনেও অপেক্ষার যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মধ্যবর্তী অনেকটা বছরজুড়ে উভয়ে দূরে থেকেও কাছে, কাছে না পেয়েও অন্তরের মাঝে, বিরহের অগ্নিতে পুড়তে পুড়তে পরস্পর পরস্পরকে ভালোবাসে। ভালোবাসার অগ্নিসিক্ত চোখে বিরহী নীলা দেখে, সময় চলে যায় রায়হানের অস্তিত্বের রঙিন ছোঁয়ায়।

সেলুলয়েডের রঙিন ছোঁয়া সদ্য প্রয়াত অভিনেতা ইরফান খানকে আমরা কমবেশি সবাই চিনি; কিন্তু যেটি কম জানি সেটা হলো তার বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে শ্রম্নতি নাটক শোনার গল্প। তিনি চাইতেন অভিনয়জীবনে গল্প বলতে আর তাই শৈশব থেকে শেষ সময়টা পর্যন্ত তিনি গল্প খুঁজে গেছেন রেডিও নাটক শুনে তথা শ্রম্নতি নাটকে কল্পনার ডানা মেলে। শ্রোতাদের কল্পনার ডানা মেলাতে রানু হাফিজের গল্পে ডানা রূপ নাট্যরূপ ও নির্দেশনায় আন্তরিকতাপূর্ণ দক্ষতায় সুনিপুণ এবং মাত্রায় পরিমিত এক অসামান্য কাজ নির্মাণ করেছে শৌখিন থিয়েটারের প্রধান নির্বাহী এবং নির্দেশক হামিদুর রহমান পাপ্পু। শ্রম্নতি নাটকের মূল সুর বিরহী দূরত্বের মতোই করোনাকালীন দূরত্বজনিত বাস্তবতায় এই নির্মাণ যেন জীবন ও শিল্পের এক নান্দনিক নির্মাণ। সংলাপের সঙ্গে শব্দের (সাউন্ড), রসায়ন, বাচিক অভিনয়ের সঙ্গে নাটকের চরিত্রের সংমিশ্রণ, চলমান দৃশ্যের সঙ্গে অতীত দৃশ্যও নিখুঁত সংযুক্তি। নিঃশব্দকে শব্দ দিয়ে স্ফুরণ প্রভৃতিতে নির্দেশক শ্রোতার কাছে নির্ভরতার, নিজের কাছে তৃপ্তির আর দায়িত্ববান হয়ে ওঠার সম্ভাবনা আগামীর।

নীলা চরিত্রে অভিনেত্রী তাসমী চৌধুরী বহুমাত্রিকতা যেমন- স্বামী পেয়ে আনন্দে, স্বামীকে বিদায় জানাতে গিয়ে থমকে, স্বামী না ফেরার তুষের আগুনের মতো দগদগে পোড়ায়, ছেলের বউয়ের ঔদ্ধত্য দেখেও নিজেকে সামলানোয়, কলিকের অহেতুক খোঁচা সম্ভ্রান্তভাবে শোকাবেলায়, সন্তানকে স্নেহে ভরিয়ে তোলায়, মামাকে সাহারা হিসেবে পেয়েও পাওয়ায়, বাচিক অভিনেত্রী এক কথায় অনবদ্য এবং অনেক কথায় সবার কাছে আদৃত। ছেলের বউয়ের চরিত্রে অভিনেত্রী সাবরিনা শারমীন প্রিয়াংকা নাক সিঁটকানো-ভ্রূ কৃচকানী, শ্যামল চরিত্রে অভিনেতা ওয়াহিদুল ইসলামের থমকে থামিয়ে দেওয়ার প্রবণতা, সোহেল চরিত্রে অভিনেতা সানোয়ার না খেয়েও অনেক খাওয়ার ভান, মামা চরিত্রে অভিনেতা গৌড় চন্দ্র মন্ডল জয় অভয়দান এবং রায়হান চরিত্রে অভিনেতা হামিদুর রহমান পাপ্পুর অপেক্ষার অবসানে সে উচ্ছ্বাস প্রদর্শিত হয়, তাতে বোঝা যায় শৌখিন থিয়েটার এই নির্মাণের সব ক্ষেত্রে করোনাসংকটে একমাত্র শারীরিক দূরত্বটাই সত্য বাদ বাকি প্রতিটি ধাপ তথা স্কিপ্ট থেকে প্রডাকশন, প্রতিটি চরিত্র অনুধাবন থেকে নির্মাণ, কল্পিত কাহিনীকে কল্পনায় ভাসানোর বাস্তবায়নে শ্রম্নতি নাটক 'সময় চলে যায়' অনুরাগী শ্রোতাদের বাশরীয় সুরে ডাক দিয়ে যায়।

অবিনাশ পুরকায়স্থ: প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<101254 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1