পাঠক-মত

সভ্য সমাজে বর্ণবাদের বর্বরতা আর কতকাল

প্রকাশ | ১৪ জুন ২০২০, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
মানুষের চিরন্তন অবাধ্য হলো তার গায়ের রঙ। এই সাদা-কালোর দ্বন্দ্ব, বৈষম্য, বিদ্বেষের নাম বর্ণবাদ। আমেরিকায় শেকড় থেকে শিখরে রেসিজম। ১৮৬২ সালে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন দাসপ্রথা তুলে দিয়ে তাদের মুক্ত মানুষ হিসেবে ঘোষণা দেন; কিন্তু এর কালো ছায়া আজও বিদ্যমান। ১৯১৯ সালে জেমস বার্ডের নির্মম হত্যাকান্ড ছিল অত্যন্ত ভয়ংকর। টেক্সাসের এক নির্জন গ্রাম্য পথে হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল কৃষ্ণাঙ্গ পঙ্গু জেমস বার্ড। এমন সময় একটি জিপ আসতে দেখে হাত তুলে সেটি থামিয়ে রাইড প্রার্থনা করেন। জিপের তিনজন শ্বেতাঙ্গ যুবক সানন্দে তাকে রাইড দিতে চায়। তারা তাকে জিপের পিছনে বেঁধে গ্রামের আঁকাবাঁকা অসমতল পথে তিন মাইল জিপ চালিয়েছিল। সেই অসমতল পথের ঘর্ষণে একসময় তার মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বীভৎসভাবে মারা যায়। মৃতু্যর কারণ সে ছিল কালো। পরে বিচারে সেই নির্দয় খুনি জন উইলিয়াম কিংকে মৃতু্যদন্ড দেওয়া হয়। ১৮৯০ সালেও শিকাগোর মাফিয়াচক্র ঠিক করে দিত কারা আমেরিকায় নির্বাচন করবে। ৫০০ বছরের ৩০০ বছরই কালোরা ছিল দাস। ছিল না ভোটাধিকার। ১৯৬৫ সালে প্রেসিডেন্ট লিল্ডন জনসন কালোদের ভোটাধিকার, অধিকার, বৈষম্যমূলক আইন প্রত্যাহার এবং সমান অধিকার আইন প্রণয়ন করেন। ১৯৬৫ সালের ৭ মার্চ আলবামা অঙ্গরাজ্যের সেলমায় কৃষ্ণাঙ্গরা ড. মার্টিন লুথার কিংয়ের নেতৃত্বে ভোটের দাবিতে যে মিছিল করেছিল সেই মিছিলের ওপর শ্বেতাঙ্গ পুলিশের নির্মম বেত্রাঘাত আর ঘোড়া চালিয়ে দেওয়ার দৃশ্য কি লজ্জা দেয় না আমেরিকান সাদাদের? মাত্র ৪৩ বছরেই ২০০৮ সালে তারা কি ভেবেছিল, এক কালো মানুষ বারাক ওবামা তাদের হোয়াইট হাউজে প্রবেশ করবে। কলিন পাওয়েল এবং কন্ডোলিসা রাইস পররাষ্ট্রমন্ত্রী হবেন? যে দেশে রেস্তোরাঁয় ঢোকার অনুমতি তো ছিলই না বরং সেখানে লেখা থাকত 'নো ডগ, নো নিগ্রো'। ১৮১৪ সালের ২৪ আগস্টের আগে হোয়াইট হাউজের রঙ এরকম ছিল না। যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় ব্রিটিশ সৈন্যরা আমেরিকার প্রেসিডেন্টশিয়াল হাউজ জ্বালিয়ে দেয়, আগুনে পোড়া এবং ধোঁয়ার দাগ ঢাকতে হোয়াইট হাউজ সাদা বা শ্বেত রঙ করা হয়। উত্থান-পতনের ইতিহাস প্রায় সবারই আছে। অসম্ভব মেধাবী, বাগ্মী, কালোদের আলোর দিশারি, মহাত্মা গান্ধীর অনুসারী, অহিংসা আন্দোলনের নেতা, মানবতাবাদী এই মহারথী ড. মার্টিন লুথার (১৯২৯- ১৯৬৮) ১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট ওয়াশিংটন ডিসিতে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। যার শিরোনাম হলো- 'আই হ্যাভ এ ড্রিম'। তিনি স্বপ্ন দেখতেন 'শোষণমুক্ত সমাজ, শর্তহীন ভালোবাসা, বর্ণবৈষম্য রাষ্ট্রব্যবস্থা, দারিদ্র্য মুক্তির সমাজে শান্তি সাম্য প্রতিষ্ঠা, শিশুদের সমান অধিকার স্কুলে খেলার মাঠে, এক টেবিলে বসবে, সাদা-কালোর ভেদাভেদ থাকবে না, চাকরিতে বেতন-বৈষম্য রবে না, সাদা-কালো হাতে হাত রেখে চলবে' ইত্যাদি। সাদাদের বসার সিট যানবাহনে তিনি ছেড়ে দেননি। ১৯৫৪ সালে তিনি ৩৮১ দিন আলবামায় বয়কট আন্দোলন করলে রাজ্য সরকার যানবাহনে বর্ণবৈষম্য বেআইনি ঘোষণা করেন। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ১৯৬৪ সালে তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান এবং সেই প্রাইজ মানির ৫৬ হাজার ডলার নির্লোভ মনে দান করেন নাগরিক অধিকার আন্দোলনের সংস্থাগুলোকে। যে আন্দোলন তিনি ১৯৬০ সালে শুরু করেছিলেন। মাত্র ৩৯ বছর জীবনে ২৬ বার কারাবন্দি হন এবং ১৯৬৮ সালে গুপ্ত ঘাতকের হাতে নিহত হলে তখন ১২৫টি শহরে বিদ্রোহ শুরু হয়। আজ যেভাবে হচ্ছে। গত ২৫ মে মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের সিনোপলিস শহরে মাত্র ২০ ডলার জালনোট ব্যবহারের অভিযোগে ৪৬ বছর বয়সি রেস্তোরাঁর নিরাপত্তাকর্মী কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডকে হাঁটু দিয়ে বর্বরোচিত কায়দায় গলা চেপে ধরে রাখা হয়। নিস্তেজ হওয়ার আগে বেশ কয়েকবার তিনি আকুতি জানান 'আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না, বলে মাকে ডাক দেন'। মুখ দিয়ে ফেনা বেরিয়ে এলেও এবং পানি খেতে চাইলেও মানসিক অবস্থার বিন্দুমাত্র সাড়া ফেলেনি বা পরিবর্তন হয়নি শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসারের। এর ফলাফল আমরা সবাই অবগত। হায়রে সভ্যতার দাবিদার বর্ণবাদের ভয়ংকর কালো থাবা, বিভাজন আর কতকাল চলবে, তা কেউ জানে না। মো. কায়ছার আলী ঢাকা