পাঠক-মত

খেলাপি ঋণ সংস্কৃতির অবসান জরুরি

প্রকাশ | ১৪ জুন ২০২০, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
ঋণখেলাপি সংস্কৃতি আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম বাধা হিসেবে অভিহিত, যা অর্থনৈতিক কার্যধারাকে মূল্যহীন করে দেয়। ব্যাংকসহ সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কোটি কোটি টাকার ঋণ যা আদায় করা হয়নি, ফলেই দেশের উন্নয়নমূলক কার্যক্রম বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। ঋণখেলাপিরা ব্যাংক ও অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানের বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করে রাতারাতি দামি দামি গাড়ি-বাড়ির মালিক বনে যায়। জনসাধারণের একটি বিশেষ অংশ বিভিন্নভাবে ঋণ গ্রহণ করে থাকে আবার স্বেচ্ছায় ও পরিকল্পিতভাবে ঋণখেলাপিও হয়ে থাকে, যা একটি সংক্রামক ব্যাধির মতো আত্মপ্রকাশ পেয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মুনাফা সর্বোচ্চ করার জন্য সংগৃহিত আমানত থেকে ঋণ প্রদান করে থাকে। কিন্তু খেলাপি সংস্কৃতির ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। তাই ঋণ প্রদানের সময় অধিক সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান জামানত গ্রহণ করে থাকে। যাকে বন্ধক বলা হয়। সম্পত্তি হস্তান্তর আইনে 'বন্ধক' বলতে ঋণ করার উদ্দেশ্যে স্থাবর সম্পত্তির স্বত্ব হস্তান্তরকরণকে বোঝায়। তা কর্জ নিবারণের জন্য একটি ব্যবস্থা। বন্ধকদাতা এই মর্মে সম্পত্তি বন্ধক রাখেন, ঋণের টাকা কোনো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধ করা হলে বন্ধক গ্রহীতা অতঃপর দাতার রক্ষিত সম্পত্তিটি দাতার বরাবরে ফেরত দিতে বাধ্য। ঋণপ্রদানের আগে প্রথমে তারল্য সংকটের বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। তারল্য সংকটে পড়তে হবে কিনা। বিনিয়োগকৃত বা ঋণের টাকা কত সময়ে উঠে আসবে তা বিবেচনা করে দেখতে হবে। ঋণের বিপরীতে রক্ষিত জামানত পর্যাপ্ত কিনা বিবেচনা করে দেখতে হবে। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে জামানতের সম্পত্তি বা বন্ধকী সম্পত্তি বিক্রয় করে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণের প্রদত্ত অর্থ ফিরে পাবে কিনা। মুনাফার সম্ভাবনার, ঋণ বা বিনিয়োগ খাতটি কতটুকু লাভজনক তা বিবেচনা করতে হবে। ঋণপ্রদানের আগে ঋণ গ্রহীতার আগের রেকর্ড অর্থাৎ সামাজিক সুনাম, পুলিশ রেকর্ড বা ঋণের অর্থ ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা তা যাচাই করতে হবে। অতীতের রেকর্ড খারাপ থাকলে ঋণপ্রদান থেকে বিরত থাকতে হবে। ঋণ গ্রহীতার আর্থিক অবস্থা, ব্যবসায়িক দক্ষতা দেখা জরুরি। এমন খাতে ঋণ প্রদান করতে হবে যা প্রদান করা হলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে এবং ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। দরিদ্র, মূলধন, সামর্থ্য, নির্ভরশীলতা, দায়িত্বশীলতা এবং সম্পদশীলতা ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে ধারণা নিতে হবে। স্বজনপ্রীতি ও বিভিন্নভাবে প্ররোচিত হয়ে ঋণ প্রদান করা যাবে না। ঋণ বা বিনিয়োগ প্রদানের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অবশ্যই মেনে চলতে হবে। ব্যাংক কর্তৃক অলিখিত চার্জ ডকুমেন্টে ঋণ গ্রহীতা ও জামিনদারের স্বাক্ষর গ্রহণের দীর্ঘ দিনের বেড প্র্যাকটিস বন্ধ করতে হবে। চার্জ ডকুমেন্ট এক বসায় এক হাতে এক কলমে পূরণ করতে হবে। ঋণখেলাপিরা যাতে প্রতারণা ও আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে বের হয়ে যেতে না পারে সে ব্যবস্থার পাশাপাশি ঋণ বা বিনিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকেও স্বচ্ছতার এবং জবাবদিহিতার মুখোমুখি করতে হবে। জনগণের অর্থ লুণ্ঠনের যুগে যুগে চলে আসা ধারাবাহিক প্রক্রিয়াকে রুখতে না পারলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ব্যাপক বাধাগ্রস্ত হবে। অর্থঋণ আদালত আইন ২০০৩-কে আরও গতিশীল করতে হবে। ভদ্রবেশি ঋণখেলাপিদের হাতে যাতে দরিদ্র জনগণের অর্থ না যায় তার জন্য সচেতন থাকতে হবে। এ সমস্যা সমাধানে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদারসহ পর্যবেক্ষক দলের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। প্রকৃত সৎ, পরিশ্রমী, মেধাবী ও যোগ্য ব্যবসায়ী/শিল্পপতিদের প্রয়োজনীয় ঋণ/বিনিয়োগ সুবিধাসহ প্রণোদনা ও উৎসাহ প্রদান করতে হবে। ঋণ গ্রহণের উদ্দেশ্যে প্রস্তাবকৃত জামানত বা সম্পত্তির প্রকৃতি যাচাই করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে অধিক সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সম্পত্তি কারও কাছে দায়বদ্ধ আছে কিনা বা আগে কোথাও বন্ধক প্রদান করেছে কিনা তা সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রচারের মাধ্যমে যাচাই করা জরুরি। ওই সম্পত্তি সংক্রন্তে আর,এস রেকর্ডীয় মালিক হতে স্বত্বের ধারাবাহিকতা মিলিয়ে দেখতে হবে। স্বত্বের ধারাবাহিকতার সংশ্লিষ্ট সব বায়া দলিল, আর, এস খতিয়ান, বি, এস খতিয়ান, দায়মুক্ত সনদ, বি, এস নামজারি খতিয়ান, ডিসিআর, হালসন খাজনা পরিশোধের দাখিলা, সিডিএ অনুমোদনপত্র (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), হাউজিং সোসাইটির পস্নটের ক্ষেত্রে এনওসি বা অনুমতিপত্র, সার্ভে রিপোর্ট বা আর, এস দাগের সঙ্গে বি, এস দাগ মিলামিল সংক্রান্ত সংবাদের দরখাস্ত ইত্যাদি গ্রহণ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট খতিয়ান সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট এসি (ল্যান্ড)/ সংশ্লিষ্ট কালেক্টরেটের রেকর্ডরুমে তলস্নাশিক্রমে সঠিক আছে কিনা যাচাই করে দেখতে হবে। জমির স্কেচ ও চৌহদ্দি নির্ধারণসহ তপশিলভুক্ত সম্পত্তিতে মালিকের সরেজমিন পৃথক চিহ্নিত মতে বাস্তব দখল সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে। সম্প্রতি খেলাপি ঋণের কারণ এবং তা কমিয়ে আনতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণ গ্রহীতা নির্বাচনে দুর্বলতা, ঋণের বিপরীতে রক্ষিত জামানতের অপর্যাপ্ততা, অতিমূল্যায়ন ও ঝুঁকি বিশ্লেষণে দুর্বলতা, এক ব্যাংক কর্তৃক অন্য ব্যাংকের খারাপ ঋণ অধিগ্রহণ, চলতি মূলধনের পরিমাণ নির্ধারণ না করা, একাধিক ব্যাংক থেকে চলতি মূলধন গ্রহণ, স্বজনপ্রীতি ও বিভিন্নভাবে প্ররোচিত হয়ে ঋণ প্রদান, শাখা পর্যায়ে ঋণ প্রদানের ক্ষমতা সীমিতকরণ, ঋণ পুনঃতফশিলকরণের সুবিধার অসৎ ব্যবহার খেলাপি ঋণ বাড়ার অন্যতম কারণ। পরিশেষে বলব আমাদের দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তাই ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আরও বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সাইফুদ্দীন খালেদ আইনজীবী বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট