বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বাজেট ও জনপ্রত্যাশা মোহাম্মদ অংকন /

আমাদের দেশের বাজেট প্রণেতারা হয় তো মাঝে মাঝে ভুলে যান যে, তারা একটি উন্নয়নশীল দেশে বসবাস করছেন। এ কারণে তারা বাজেটের ক্ষেত্রে উন্নত দেশের সঙ্গে তাল মেলাতে যান। খাত-বেখাত না দেখে সব ক্ষেত্রে সমান দৃষ্টিপাত করেন। আর এ কারণেই প্রতিবছরের ন্যায় এবারও বাজেট পেশের পরপরই অর্থনীতিবিদ, সুশীল সমাজ, সচেতন নাগরিকরা উঠে পড়ে লেগেছেন বাজেট সমালোচনায়।
মো. মাহমুদ হাসান
  ১৫ জুন ২০২০, ০০:০০

বৈশ্বিক মহামারি করোনায় বিপর্যস্ত বাংলাদেশ। ইতিমধ্যে দেশের অর্থনৈতিক খাতসমূহ নড়বড়ে হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। অনাকাঙ্ক্ষিত বেশ কিছু ব্যয় বিগত আদায়কৃত বাজেটে ঘাটতি তৈরি করে ফেলেছে। এই দুঃসময়ে অথনৈতিক পুনরুদ্ধার খুবই জরুরি। সেসব বিবেচনাপূর্বক এবারের বাজেট ঘোষণায় কোনো কালবিলম্ব লক্ষ্য করা যায়নি। দেশের আগামী এক বছরের অর্থনৈতিক কার্যকলাপের ভাগ্যে কী রয়েছে, তা তুলে ধরতেই এবারের বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে যথারীতি। গত ১১ জুন, ২০২০ অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য সংসদে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বিশাল একটি বাজেট পেশ করেছেন- যা প্রতিবারের ন্যায় এবারও সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় রয়েছে। করোনার কারণে নুয়ে পড়া দেশ থেকে কী করে সম্ভব এই বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা? শুধু এটিই নয়, আরও কয়েকটি কারণে পেশকৃত বাজেট আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। বিভিন্ন খাতে বরাদ্দের অসামঞ্জস্যতা, কালো টাকাকে স্বল্প সুদে সাদা করার সুযোগ, ভোগ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিকরণ ইত্যাদি তার মধ্যে উলেস্নখযোগ্য।

অর্থনীতিবিদ ও অর্থনৈতিক থিংক ট্যাংকগুলোর প্রধান সংশয় হলো, এত বড় বাজেট পেশ করা হলো; কিন্তু এর বাস্তবায়নের জন্য যে প্রধান অর্থ খাত অর্থাৎ রাজস্ব তা কোথা থেকে আসবে? এমন প্রশ্ন উঠে আসা অতি স্বাভাবিক। একটি ব্যাপার, যখন রাজস্ব বোর্ড তার ওপর অর্পিত রাজস্ব আদায়ের অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থতার স্বীকার হয়। এই বাজেটে রাজস্ব আয় পূর্বের তুলনায় ৪৯ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধিকে একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা বলে উলেস্নখ করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। এটা হবেই না কেন, যেখানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিগত কয়েক অর্থবছর থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার বাস্তবায়ন করতে পারছে না। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে এনবিআর তাদের লক্ষ্য মাত্রার ৫ থেকে ২০ শতাংশ রাজস্ব আদায়ে ব্যর্থ হয়েছে। বাজেট পূরণের প্রথম ও প্রধান খাতটি যদি এভাবে প্রতিবার তার লক্ষ্যচু্যত হয়, তবে এত বিশাল আকারের বাজেট দেখে আমাদের চোখ কপালে উঠবেই। এর প্রভাব পড়বে সাধারণ মানুষের মধ্যে। এবারের বাজেটে মোবাইলে কথা বলা ও ইন্টারনেট বিলেও রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করা হয়েছে। এমনিতেই মোবাইল অপারেটরদের হিডেনচার্জে গ্রাহক অতিষ্ঠ, তার ওপর ১০০ টাকা মোবাইল রিচার্জে ২৫ টাকার বেশি রাজস্ব খাতে জমা পড়বে। যা অবিসম্ভাব্য।

বর্তমান বাজেটের ক্ষেত্রে গণস্বাস্থ্যবিদরা রোগের জাতীয় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার কথা বারংবার উলেস্নখ করেছেন। নির্দিষ্টভাবে এই বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে এই রোগের জাতীয়ভাবে প্রতিরোধের বিষয় উলেস্নখ করার প্রধান কারণ হলো চলমান করোনাভাইরাস পরিস্থিতি। শুধু কি করোনা- পরিস্থিতির জন্যই এরূপ ব্যবস্থা নেয়া উচিত নাকি সবসময়ের জন্য বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত? বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানভেদে প্রতিনিয়ত বিপদ আসন্ন। মহামারি, অতিমারি, ছোঁয়াচে রোগ প্রায়ই দেখা দিচ্ছে। বিনা চিকিৎসায় হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। এ জন্য কি আগাম প্রস্তুতি থাকা উচিত নয়? বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে প্রয়োজনীয় অর্থবরাদ্দের পরও যেন সিস্টেমজনিত সমস্যায় কোনো উন্নয়ন লক্ষ্য করা যায় না। (করোনা-পরিস্থিতি এসে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে দেশের স্বাস্থ্য খাতের বেহাল দশার চিত্র। ১৩ জুন ২০২০ তারিখে করোনায় নিজের জীবনকে বিসর্জন দেওয়ার মধ্যদিয়ে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম প্রমাণ করলেন দেশের স্বাস্থ্য খাত মোটেও ভালো না। তাকে সিঙ্গাপুর নিলে অবশ্যই সুস্থ হয়ে উঠতেন।) পূর্বের মেয়াদের কোনো সরকারই বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে নজরদারি করার প্রয়োজন মনে করেননি। নিজেদের জ্বর, সর্দি, কাশি হলেই ছুটেছেন বিদেশে। আর দেশের মানুষ বিনা চিকিৎসায় মরেছে।

প্রতিবছর বাজেট ঘাটতি পূরণে নিত্যভোগ্য পণ্যের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি করে থাকে সরকার। যেগুলো জনগণ ভোগ করতে বাধ্য, অতিরিক্ত কর দিতে বাধ্য। ২০২০-২১ বাজেট প্রণয়নের ফলে গত ১১ জুন, ২০২০ থেকে প্রায় ২৯ ধরনের পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে, অথচ এখনো বাজেটের কার্যকারিতা শুরু হয়নি। বাজেটে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে- যা প্রতিবারই লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যায়। সরকার কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। করোনার এই দুঃসময়ে দেশে পণ্য রপ্তানিতে ব্যাপক ধস নেমেছে। সে অনুযায়ী বাণিজ্য ঘাটতি স্বাভাবিক রাখতে আমদানিকৃত প্রধান পণ্যের ওপর আরও বেশি করারোপ করা যুক্তিযুক্ত ছিল। কিন্তু অতি প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের (কলরেট, ইন্টারনেট খরচ ও স্মার্ট ফোন) ওপর অতিরিক্ত ভ্যাট আরোপ করা দেশের প্রযুক্তি খাত চলমান আধুনিকীকরণের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। শুধু তাই নয়, প্রযুক্তি নির্ভরতায় জনগণ নিরুসাহিত হতে পারে। বর্তমানে স্মার্ট টেকনোলজিকে জনগণ বিলাসিতা মনে করে না, প্রয়োজনীয়তা মনে করে। করোনাকাল আসায় মানবজীবনে ইন্টারনেট ও প্রযুক্তিপণ্যের সঠিক ব্যবহার কতটা জরুরিরূপে দেখা দিয়েছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এ দিকটি বাজেট প্রণেতারা লক্ষ্য করেছিলেন কি না সে সম্পর্কে আমাদের যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

আমাদের দেশের বাজেট প্রণেতারা হয় তো মাঝে মাঝে ভুলে যান যে, তারা একটি উন্নয়নশীল দেশে বসবাস করছেন। এ কারণে তারা বাজেটের ক্ষেত্রে উন্নত দেশের সঙ্গে তাল মেলাতে যান। খাত-বেখাত না দেখে সব ক্ষেত্রে সমান দৃষ্টিপাত করেন। আর এ কারণেই প্রতিবছরের ন্যায় এবারও বাজেট পেশের পরপরই অর্থনীতিবিদ, সুশীল সমাজ, সচেতন নাগরিকরা উঠে পড়ে লেগেছেন বাজেট সমালোচনায়।

\হদেশে এমন বাজেট কেন পেশ হবে যে, সেখানে সমালোচনা করার স্কোপ থাকবে? কেন প্রশ্ন করার জায়গা তৈরি হবে? দেশের মানুষ আজকাল বেশ সচেতন। কথা হচ্ছে, ইতিবাচক সমালোচনা কি বাজেট প্রণেতারা কেউ শোনেন? পূর্বেকার ভুল শুধরে পরের বছর গ্রহণযোগ্য বাজেট কি তারা পাশ করেন? যদি তা না হয়ে থাকে, তবে এসব মেধা ও অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল নিজে একথা ঠিকই বলেছেন, 'এই করোনা-মহামারি আমাদের স্বাস্থ্য খাতের দুর্বল দিকগুলোকে সামনে এনেছে।' কিন্তু তার বাজেটে সেসব দিকগুলোকে সবল করার পরিকল্পনা খুব কমই দেখা গিয়েছে। তিনি আবার একথাও বলেছেন, 'এ বাজেট জীবনরক্ষার বাজেট।' তাই যদি হয়ে থাকে, তবে আমরা দেখব, আগামী অর্থবছরে কতজন বিনা চিকিৎসায় মারা যায়, কতগুলো ব্যাংক দেউলিয়া ঘোষণা করে বন্ধ হয়ে যায়, কতজন নাগরিক খাদ্যের অভাবে মারা যায়। তারপর জবাবটা তাকে দেওয়া যাবে।

পরিসংখ্যান বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য যে কোনো দেশের চেয়ে বাংলাদেশের মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ কম। এই করোনা-মহামারি সে রেকর্ডকে ভেঙে ফেলবে বলে মনে হচ্ছে। প্রতি অর্থবছরে পেশ হয়ে আসতে থাকা ঘাটতি বাজেটগুলো দেশকে স্বনির্ভর থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। বৈদেশিক ঋণ নির্ভরতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বড় বড় প্রকল্প হাতে নিলেই বৈদেশিক ঋণের জন্য হাত পাততে হচ্ছে। একথা স্বীকার্য দেশের অর্থনীতি কখনওই স্বনির্ভর ছিল না। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমল থেকেই অর্থপাচার, কালো টাকার ছড়াছড়ি, আমলাদের প্রতিযোগিতামূলক দুর্নীতি লক্ষ্য করা গেছে। যাদের শত শত কোটি টাকা, তারা যদি দেশে কর না দেয়, তবে প্রান্তিক জনগণ আর কত পরোক্ষ কর দিয়ে দেশকে স্বনির্ভর করবে? প্রবাসীরা আর কত গায়ের ঘাম পায়ে ফেলে দেশে রেমিট্যান্স দেবে?

চলমান করোনা পরিস্থিতির কারণে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবারের বাজেট দেশের অর্থনীতিতে বিশেষ প্রভাব ফেলবে। বিগত বছরের বাজেট ঘাটতি, অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যয়ের হিসাব গিয়ে পড়বে বর্তমান বাজেটে। গত বছরের তুলনায় ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি বরাদ্দ দেয়া স্বাস্থ্য খাত নিয়ে তারপরেও অর্থনীতিবিদরা চিন্তিত। যেহেতু এই বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের চেয়েও বেশি বরাদ্দকৃত খাতগুলো হলো- শিক্ষা ও প্রযুক্তি, সুদ পরিশোধ, স্থানীয় সরকার, পরিবহন ও যোগাযোগ, প্রতিরক্ষা ও জনপ্রশাসন। মোট বাজেটের ৫ দশমিক ২ শতাংশ অর্থাৎ ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া অর্ধেকের বেশিই ১৬ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে পরিচালনা ব্যয়ে আর বাকি অর্থ ব্যয় হবে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে। ২০২০-২১ বাজেটের ঘাটতি ধরা হয়েছে ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা- যা জাতীয় আয়ের ৬ শতাংশ। গত বাজেটে যা ছিল ৫ শতাংশ। এখন সতর্ক থাকতে হবে অর্থনীতির চরম এ দুর্দশা থেকে উত্তরণের জন্য তৈরি করা এই ঘাটতি যেন অর্থনীতিকে সুদ পরিশোধের বেড়াজালে আটকে না ফেলে।

আমাদের প্রত্যাশা ছিল, বাজেটের আকার বৃদ্ধি না পাক। তবে করোনার কারণে দেশের যে অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, তা যেন পুনঃরুদ্ধার হয়। এ বাজেট পুনঃরুদ্ধারের বাজেট হওয়া উচিত ছিল। তা না করে দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি করার দিকে নজর দিয়েছে সরকার। বৈশ্বিক মহামারি করোনা পরিস্থিতিতে অর্থনীতি যখন সংকটাপন্ন, তখন দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধিকরণ যেন 'মরার উপর খাঁড়ার ঘা' ছাড়া আর কিছুই না। সর্বশেষ, যে কথাটি বলতে চাই, আমাদের প্রত্যাশা ছিল, এবারের বাজেট হবে জনগণের চাহিদার প্রতিফলনের বাজেট। তা মোটেও হয়নি। সরকার শক্তিশালী খাতসমূহকে প্রণোদনা দিয়ে দেশের অর্থনীতিকে নড়বড়ে করে সাধারণ জনগণকে কোণঠাসায় ফেলে দিতে চলেছে। যেখানে জীবন না জীবিকা আগে, সে প্রশ্নে দেশের মানুষ আটকে আছে, সেখানে অতিরিক্ত জীবিকার ব্যয়ভার দরিদ্রকে অতিদরিদ্র করবে, ধনীকে আরও ধনী করবে। বর্তমান বাজেট শ্রেণি বৈষম্যকে আরও তীব্রতর করবে। দেশের অসম উন্নয়নের চেয়ে প্রান্তিক জনগণকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। যত দিন দেশে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অচিকিৎসা, অশিক্ষা থাকবে, তত দিন এত বড় আকারের বাজেট দেশের কাজে আসবে না। অতএব, বাজেট নিয়ে আরও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা দরকার ছিল।

মোহাম্মদ অংকন : তরুণ লেখক

মো. মাহমুদ হাসান : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<102472 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1