পাঠক মত

করোনাতেও ধর্ষণ

প্রকাশ | ১৬ জুন ২০২০, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
করোনাভাইরাসের তান্ডবে সারা বিশ্বের প্রায় দুই শতাধিক দেশগুলোর মতো বাংলাদেশও ব্যাপকভাবে করোনার এই ভয়াল থাবায় আক্রান্ত। যার প্রভাবে জনজীবন হয়ে উঠেছে অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত। পাল্টে গেছে সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের গতিধারা। করোনার এই ভয়াবহ অবস্থার কারণে সমাজের মানুষ যখন আতঙ্কিত এবং বেশ হতাশাজনকভাবে সময় কাটাচ্ছে তার মধ্যেও মাথাচাড়া দিয়ে ব্যাপক আকার ধারণ করছে সামাজিক ব্যাধিগুলো। ক্রমেই বেড়ে চলেছে সমাজের এরূপ ভয়াবহ অবস্থা যার প্রভাবে করোনার পাশাপাশি মনুষ্য সৃষ্ট এমন সমস্যাগুলোও সমাজ ও দেশের মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করছে এক অন্যরকম আতঙ্ক। দেশে করোনার এরূপ ভয়াবহ অবস্থাতেও বেড়ে চলেছে খুন, ধর্ষণ ও হত্যা। যা এই সময়ে সমাজ ও দেশের ওপর চরম বিরূপ অবস্থা সৃষ্টি করছে। সমাজের এই ব্যাধি আমাদের কাছে অতি পরিচিত হলেও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বর্তমান সময়ে তা খুবই বেদনাদায়ক ও দুঃখজনক যে মানুষ কতটা হীন মানুষিকতার হলে বর্তমান এই কঠিন সময়েও এমন আচারণ করতে পারে। প্রতিনিয়তই আমরা টেলিভিশনের পর্দা বা খবরের কাগজে খুন, ধর্ষণ এবং হত্যার খবর পেয়ে থাকি। সমাজের ছোট-খাটো বিষয়াবলি নিয়ে অনাবরত বেড়েই চলেছে হত্যাকান্ড। আর এই হত্যাকান্ডগুলো ঘটছে বেশির ভাগ আভিজাত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে। এছাড়া লাগামহীনভাবে চলছে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের মতো নিকৃষ্টতম কাজ। শুধু এখানেই শেষ নয়- ধর্ষণের পর তাকে শিকার। ধর্ষণের এই নির্মমকান্ড থেকে বাদ যাচ্ছে না ছয় মাস বয়সির শিশুরাও। ছয় মাসের শিশু থেকে শুরু করে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে ষাটোর্ধ্ব বয়সের মহিলারাও। যা সমাজের জন্য অত্যন্ত নেতিবাচক দিক। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ধর্ষণের ও হত্যার কিছু বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হলো- (১) ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলায় দুই বোনকে দল বেঁধে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার (১২ মে) রাতে ওই দুই তরুণীর বাবার অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে এ যুবকদের আটক করে পুলিশ। (২) গাজীপুরের শ্রীপুরে ১৭ বছরের এক কিশোর মুঠোফোন চুরি করতে গিয়ে একে একে কুপিয়ে হত্যা করেছে বাড়ির চার বাসিন্দাকে। রক্তাক্ত অবস্থায় ধর্ষণ করেছে দুই কিশোরী বোনকে। শেষমেশ ছুরি দিয়ে গলাকেটে মৃতু্য নিশ্চিত করেছে প্রত্যেকের। এই নির্মমতা থেকে রেহাই পায়নি আট বছরের প্রতিবন্ধী শিশুও। এ যেন এক মর্মান্তিক ঘটনার বিরল দৃষ্টান্ত। (৩) পঞ্চগড়ে ধর্ষণের অভিযোগে সালিশে নির্যাতন, অপমানে এক কিশোরী আত্মহত্যা করেছে। পঞ্চগড় সদর উপজেলার অমরখানা ইউনিয়নের সোনারবান-বাঁশবাড়ি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। (৪) খুলনা মহানগরীর খানজাহান আলী থানার যোগীপোলে তিন বন্ধু কর্তৃক ৪র্থ শ্রেণির এক মাদ্রাসা ছাত্রীকে গণধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে। এ ঘটনায় ওই ছাত্রীর মা বাদী হয়ে ২ মে নগরীর খানজাহান আলী থানায় মামলটি করেন। তিন বন্ধু মিলে চতুর্থ শ্রেণির ওই ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনাটি অতি মর্মান্তিক। (৫) নওগাঁর ধামইরহাটে এক কিশোরী গণধর্ষণের শিকার। (৬) চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে সাত বছর বয়সি এক শিশুকে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগ পাওয়া গেছে। (৭) চাঁদপুরে সদর উপজেলায় নবম শ্রেণির এক ছাত্রী ধর্ষণের শিকার। (৮) শুনতে খারাপ লাগলেও সত্য যে গত ১৩ মে যশোরের চৌগাছায় পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করেন তার পাষন্ড পিতা। এতে এলাকায় ব্যাপক তোলপাড় ঘটে গেছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশে করোনার এই ভয়াবহ অবস্থাতেও থেমে নেই ধর্ষণের মতো এমন কুকর্ম। নীতি-নৈতিকতাহীন মানুষরূপী হিংস্র পশুগুলো যখন-তখন ঝাঁপিয়ে পড়ে নারীর উপর। এদের এমন আচারণে মনে হয় না এদের ভিতর মনুষ্যত্ব বোধ আছে। প্রতিনিয়ত ঘটেই চলেছে ধর্ষণের মতো এমন বিকৃত কাজ যা কলুষিত করে আমাদের সমাজ ও আমাদের রাষ্ট্রকে। আর এর সঙ্গে আমাদের সমাজ ও দেশের সুশীল সমাজের মানুষ দায়ী, কারণ অন্যায় করা ও অন্যায় সহা সমান অপরাধ। বারবার এমন ঘটনার দৃষ্টান্ত আমাদের এটা জানান দেয়, আমাদের দেশে ধর্ষণের বিরুদ্ধে সঠিক বিচার নেই, সঠিক পদক্ষেপ নেই, নেই ধর্ষকের সাজা। যার কারণেই একজন ধর্ষক এমন খারাপ একটা কাজ করার পরেও সমাজে বুক ফুলিয়ে চলে এবং আবার সেই একই কাজ করতে সাহস পায়। আজ যদি আমাদের দেশে ধর্ষণের কঠিন বিচারব্যবস্থা থাকতো তাহলে একজনের কঠিন শাস্তি দেখে অন্যরা সাবধান হয়ে যেত, ফলে সমাজে বারবার এমন ঘটনা ঘটত না। কিন্তু আমরা দেখি ধর্ষণের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত পরিমাণ নিয়ম-কানুন আমাদের সংবিধানে চালু আছে। ধর্ষণের বিরুদ্ধে আগের নিয়ম দেখলেই আমরা জানতে পারি, ১৯৯৫ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ বিশেষ বিধান আইন করা হয়। পর্যায়ক্রমে ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন করা হয়। ২০০৩ সালে এ আইন আবার সংশোধন করা হয়। ধর্ষণের শাস্তি কত ভয়ানক, তা অনেকেই জানেন না। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ৯ ধারায় ধর্ষণের বিচার হয়। এ আইনে ধর্ষণের সর্বনিম্ন শাস্তি পাঁচ বছরের কারাদন্ড এবং সর্বোচ্চ শাস্তি মৃতু্যদন্ড করা হয়েছে। আইনের ৯(১) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে, তাহলে সে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হবে। এ ছাড়া অর্থদন্ডও দিতে হবে। ৯(২) উপধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা ওই ধর্ষণ-পরবর্তী তার অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিত নারী বা শিশুর মৃতু্য ঘটে, তাহলে ওই ব্যক্তি মৃতু্যদন্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হবে। অতিরিক্ত এক লাখ টাকা অর্থদন্ড ও দন্ডনীয় হবে। উপধারা ৯(৩)-এ বলা হয়েছে, যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে এবং ধর্ষণের ফলে ওই নারী বা শিশুর মৃতু্য ঘটে বা তিনি আহত হন, তাহলে ওই দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃতু্যর জন্য দায়ী। যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে মৃতু্য ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করে, তাহলে ওই ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হবে ও এর অতিরিক্ত অর্থদন্ডেও দন্ডণীয় হবে। এদিকে সম্প্রতি 'মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন'-এর করা একটি জরিপে এসেছে, গেল এপ্রিল মাসে দেশের ২৭ জেলায় ৪ হাজার ২৪৯ জন নারী ও ৪৫৬ জন শিশু সহিংসতার শিকার হয়েছে। এবং মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের বিগত একটা তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ২০১৯ সালে ৯০২ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যা ২০১৮ সালের ৩৫৬ জনের তুলনায় ১৫৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ বেশি। এ ছাড়া গেল বছরে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৯৩ শিশু। ধর্ষণের শিকারদের মধ্যে ৪৮ শতাংশের বয়স ১৩ থেকে ১৮ বছর এবং ৩৯ শতাংশের বয়স ৭ থেকে ১২ বছর। এ বছর জানুয়ারিতে ধর্ষণের প্রকোপের ফলে সংসদে এমন একটি প্রস্তাবনা ওঠে যেখানে বলা হয় ধর্ষণের শাস্তি হবে ক্রসফায়ার। যদি তাই করা হয় তাহলে সমাজ থেকে ধর্ষণ নামক শব্দটা মুছে যাবে। কিন্তু আলোচিত প্রস্তাবনার যথাযথ প্রয়োগ দেখা না যাওয়ায় বেড়েই চলেছে ধর্ষণের প্রভাব। করোনায় লকডাউনের কারণে মানুষ ঘরবন্দি হয়ে যাওয়ায় তাদের রুচির বিপর্যয় ঘটেছে। পর্ন সাইটের কারণে মানুষ নীতি-নৈতিকতা থেকে সরে যাচ্ছে অনেকগুণ। মানুষের এরূপ অবস্থা থেকে ফেরাতে প্রয়োজন ধর্মীয় ও নীতি-নৈতিকতার জ্ঞান। সমাজ থেকে ধর্ষণনামক শব্দ মুছে দিতে হলে প্রয়োজন আইনের সঠিক প্রয়োগ এবং নৈতিক শিক্ষা এবং ধর্মের কঠোরতা। পাশাপাশি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে হবে। সমাজের সবাইকে সচেতন হতে হবে। সমাজের সবাইকে এক হয়ে এ ধরনের হীন কাজের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। সবাই সচেতন হলেই এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। পাশাপাশি দোষীরা যাতে শাস্তি পায় সে দিকটাও কঠোরভাবে নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই ধর্ষণনামক এই কলুষিত কাজ থেকে আমরা আমাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে মুক্ত করতে পারব। ইমরান হুসাইন শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা