শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায় আমাদের সক্ষমতা

এটা স্বীকার করতেই হবে, ২০১০ সাল থেকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি দেশে যে হারে বেড়েছে দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে সেভাবে সাফল্য আসেনি। উপরন্তু করোনাকালে বেড়েছে। যদিও দারিদ্র্য হার কমিয়ে আনতে সব দরিদ্র পরিবারকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আনা হয়েছে। এবারের বাজেটেও সংখ্যা ও সুযোগ দুটোই বৃদ্ধি করা হয়েছে। সরকারের এ ধরনের নানামুখী দরিদ্রবান্ধব পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ অত্যন্ত ইতিবাচক। করোনাকালে সরকার দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বিশেষ প্রণোদনা দিয়েছে। তবে কৃষিই আমাদের প্রধান ভরসা।
সালাম সালেহ উদদীন
  ১৭ জুন ২০২০, ০০:০০

করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার কারণে সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে। বিশ্বে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইতিমধ্যে বহু দেশ থেকে কর্মী ছাঁটাই করা হয়েছে। কোটি কোটি মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। ফলে বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য বাড়বে। করোনাভাইরাস সংকটের অর্থনৈতিক পরিণতি বিশ্বের ৬ কোটি মানুষকে চরম দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ কথা বলে সতর্ক করেছেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড মালপাস। বর্তমান পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয় বলেও মনে করেন তিনি। ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। তার এ মন্তব্য খুবই উদ্বেগজনক। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে চরম দারিদ্র্য বলতে ওই মানুষকে বলা হয়েছে, যিনি প্রতি দিন ১ দশমিক ৯০ ডলারের (১৬১ টাকা) চেয়ে কম অর্থে জীবনযাপন করেন। বিশ্বব্যাংক আশঙ্কা করছে ২০২০ সালে বিশ্ব অর্থনৈতিক উৎপাদন পাঁচ শতাংশেরও বেশি সংকুচিত হবে। যা দারিদ্র্য দূরীকরণে বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর গত তিন বছরে প্রচেষ্টা মুছে ফেলবে।

এ কথা সত্য, করোনাভাইরাসের থাবায় ইতিমধ্যে লাখ লাখ জীবিকা ধ্বংস হয়ে গেছে এবং বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা চাপের মধ্যে রয়েছে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে স্বাস্থ্যগত ও লকডাউনের কারণে যে অর্থনৈতিক প্রভাব পড়েছে, তা মারাত্মক। এর ফলে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ একেবারে দরিদ্র হয়ে যাবে।

আশার কথা, দরিদ্র দেশগুলোকে সংকট মোকাবিলায় সহায়তায় বিশ্বব্যাংক ১৬০ বিলিয়ন ডলারের অনুদান এবং ১৫ মাসের স্বল্পসুদে ঋণ বিতরণ কর্মসূচি নিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ১০০টি দেশের জন্য ইতিমধ্যে জরুরি অর্থ ছাড় করা হয়েছে। এই সব দেশে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ বাস করে। এই অর্থ স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করার পাশাপাশি চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহে প্রদান করা হচ্ছে। তবে বিশ্বব্যাংক যে পরিমাণ অর্থ সরবরাহ করছে, তা পর্যাপ্ত নয়। বিশ্বের অন্যান্য অর্থ প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাকে এ ব্যাপারে সাহায্যের হাত বাড়াতে হবে।

করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত বিশ্ব অর্থনীতি। কমে গেছে মানুষের আয়। এর ফলে বিশ্বজুড়ে দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করা মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাবে। বিশেষ করে মধ্যআয়ের দেশগুলোতে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বাড়বে বলে জানিয়েছেন কিংস কলেজ লন্ডন ও অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটির গবেষকরা। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বাংলাদেশ, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান এবং ফিলিপাইন্সসহ এশিয়ার দেশগুলোর কথাও বলা হয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারির বিস্তার রোধে লকডাউন ঘোষণা করায় এসব দেশের অর্থনীতিতে যে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে তার ধাক্কা কাটিয়ে ওঠা সহজ হবে না বলেই মত গবেষকদের। গবেষকদের একজন কিংস কলেজ লন্ডনের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ের অধ্যাপক অ্যান্ডি সামনার বলেছেন, 'উন্নয়শীল দেশগুলোতে এই মহামারি দ্রম্নত অর্থনৈতিক সংকটে পরিণত হবে। মধ্যআয়ের দেশগুলোতে যেহেতু কোটি কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার সামান্য উপরে বাস করে, সেহেতু কোভিড-১৯ মহামারির কারণে তাদের আয় হ্রাস পাবে। মহামারি একটি দেশের অর্থনীতিকে যে ঝাঁকুনি দেয় তাতে এই মানুষের ভবিষ্যৎ সবচেয়ে বেশি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে চরম দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করা মানুষের সংখ্যাও বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা গবেষকদের।

বিশ্বে এখন প্রায় ৭০ কোটি মানুষ চরম দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করে। এ সংখ্যা বেড়ে ১০০ কোটির বেশি হবে। সামনার বলেন, 'এখনই ব্যবস্থা না নিলে বিশ্বে দারিদ্র্য হ্রাসের প্রক্রিয়া ২০, এমনকি ৩০ বছর পিছিয়ে যাবে'। গবেষকরা এই সংকট মোকাবিলায় দ্রম্নত বিশ্ব নেতাদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান; কিন্তু আপাতত বিশ্বনেতাদের এগিয়ে আসার লক্ষণ তেমন দেখা যাচ্ছে না। ক্যাম্প ডেভিড এ ১০ থেকে ১২ জুন 'গ্রম্নপ অব সেভেন' (জি-৭) নেতাদের যে সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল তা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনাগ্রহের কারণে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। গ্রম্নপের বাকি দেশগুলো রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারত সেপ্টেম্বরে সম্মেলন হলেও মহামারি থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে আলোচনা কতটা এগোবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে।

অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে, সামগ্রিক মাথাপিছু আয় বা ভোগে ২০ শতাংশ সংকোচন হলে সে পরিস্থিতিকে সবচেয়ে খারাপ বিবেচনা করা হয়েছে। দৈনিক ১ দশমিক ৯০ ডলার বা ১৬৩ টাকায় যারা জীবন নির্বাহ করে থাকেন বিশ্বব্যাংকের মানদন্ড অনুযায়ী এমন মানুষকে চরম দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাসকারী বলা হয়। এছাড়া দারিদ্র্যসীমার ওপরের দিকে বসবাসকারীদের ক্ষেত্রে এ হিসাব করা হয় দৈনিক ৫ দশমিক ৫০ ডলার বা ৪৮০ টাকা ধরে। গবেষণায় বলা হচ্ছে, করোনার প্রকোপ চরম দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়ে ১১২ কোটি পর্যন্ত হতে পারে। এ ছাড়া দৈনিক ৪৮০ টাকার কমে জীবনযাপন করেন এমন মানুষের সংখ্যা বেড়ে ৩৭০ কোটিরও বেশি হতে পারে। ফলে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবে।

দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ সবচেয়ে বেশি চরম দারিদ্র্যসীমার মধ্যে প্রবেশ করবে। একক দেশ হিসেবে এ তালিকায় প্রথমে থাকবে ভারত। এরপরই রয়েছে সাব সাহার আফ্রিকা অঞ্চলের দেশগুলো। ফলে দারিদ্র্য হ্রাসে জাতিসংঘের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রার অগ্রগতি আরও ২০-৩০ বছর পিছিয়ে যেতে পারে।

করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্যের হার বাড়লেও বাংলাদেশে এর তেমন প্রভাব পড়বে না। বাংলাদেশ দারিদ্র্য বিমোচন ও মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে যে উলেস্নখযোগ্য অগ্রগতি, এর বেশির ভাগই সম্ভব হয়েছে শ্রমআয় বৃদ্ধির কারণে। ২০১০-২০১৬ সময়ে ৮০ লাখ বাংলাদেশি দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে এসেছে। জোরালো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশে দারিদ্র্য কমাচ্ছে। তবে দারিদ্র্য কমছে তুলনামূলক কম গতিতে। করোনাকালে দেশে দারিদ্র্য কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে লকডাউনের কারণে। আগে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ ভাগ আর এখন তা বেড়ে ৩৫ ভাগ হয়েছে।

এটা স্বীকার করতেই হবে, ২০১০ সাল থেকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি দেশে যে হারে বেড়েছে দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে সেভাবে সাফল্য আসেনি। উপরন্তু করোনাকালে বেড়েছে। যদিও দারিদ্র্য হার কমিয়ে আনতে সব দরিদ্র পরিবারকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আনা হয়েছে। এবারের বাজেটেও সংখ্যা ও সুযোগ দুটোই বৃদ্ধি করা হয়েছে। সরকারের এ ধরনের নানামুখী দরিদ্রবান্ধব পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ অত্যন্ত ইতিবাচক। করোনাকালে সরকার দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বিশেষ প্রণোদনা দিয়েছে। তবে কৃষিই আমাদের প্রধান ভরসা।

করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) পরিস্থিতিতে সৃষ্ট দুর্যোগে দেশের সাধারণ মানুষের কষ্ট লাঘবে মানবিক সহায়তা হিসেবে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রেখেছে সরকার। এ পর্যন্ত সারা দেশে প্রায় দেড় কোটি পরিবারের সাড়ে ৬ কোটি মানুষকে ত্রাণের চাল দেয়া হয়েছে।

করোনাকালে অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে সবচেয়ে বড় আশা কৃষি। বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ। করোনা আতঙ্কে সারা বিশ্বই বিপর্যস্ত এবং দেশের মানুষও আতঙ্কিত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। আর এমন পরিস্থিতিতে দেশের জন্য সুসংবাদ বয়ে আনছে মার্কিন কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ)। এ বিভাগের পূর্বাভাস বলছে, চলতি অর্থবছর চাল উৎপাদন ৩ কোটি ৬০ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে। এর মধ্যদিয়ে ইন্দোনেশিয়াকে টপকে বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ চাল উৎপাদনকারী দেশ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ স্থানটি ধরে রাখতে উৎপাদন আরও বাড়াতে হবে। আধুনিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক চাষাবাদে যেতে হবে। কৃষককে নানা ধরনের উপকরণ দিয়ে আরও বেশি সহযোগিতা করতে হবে, যাতে উৎপাদন আরও বাড়ানো যায়।

করোনাভাইরাসের মহামারির মধ্যে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়বে। ইতিমধ্যে ৮ লাখ প্রবাসী দেশে ফিরেছে, দেশেও লাখ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এ বিষয়টিও সরকারকে মাথায় রাখতে হবে। উলেস্নখ্য বর্তমানে দেশে সব মিলিয়ে ২৭ লাখ বেকার রয়েছে। করোনায় এই বেকারত্ব আরো বাড়বে। বিকল্প কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা কীভাবে করা যায় সেদিকে সরকারকে বিশেষ নজর দিতে হবে। কারণ গার্মেন্ট ও রেমিটেন্স পরিস্থিতি ভালো নয়। দেশে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেওয়ার পেছনে এই দুটো খাত প্রভাব ফেলবে।

পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্র থেকে দারিদ্র্য দূর হোক এটাই আমরা চাই। আমরা এও চাই করোনাকালে দেশ যাতে অর্থনৈতিক মন্দার কবলে না পড়ে। তবে দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করতে না পারলে দারিদ্র্য পুরোপুরি দূর করা সম্ভব নয়। দূর করা সম্ভব নয় অর্থনৈতিক মন্দাও। কারণ করোনাকালেও দুর্নীতি থেমে নেই। জনপ্রতিনিধিরা ত্রাণের চাল, তেল চুরি করেছে। প্রায় ১০০ জনপ্রতিনিধি বরখাস্ত হয়েছেন। এসব কারণে আমাদের যেভাবে এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, প্রচুর সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আমরা সে অবস্থায় এখনো যেতে পারিনি। এসব বাধা দূর করতে পারলে অর্থনৈতিক মন্দাসহ দারিদ্র্য আশানুরূপ হ্রাস করা সম্ভব। সম্ভব পর্যায়ক্রমে মধ্যমআয়ের ও উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছাও। তবে করোনার জন্য বিশ্বব্যাপী যে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেবে তার প্রভাব যে বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে পড়বে না, এটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। সুতরাং আমাদের সেভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। অর্জন করতে হবে অর্থনৈতিক সক্ষমতা।

সালাম সালেহ উদদীন : কবি কথাসাহিত্যিক সাংবাদিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<102716 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1