বর্ণবৈষম্য, করোনা ও আমরা

মূল কথা হলো- বদলাতে হবে ব্যবস্থা। গণবিরোধী ব্যবস্থার স্থলে আনতে হবে গণমুখী ব্যবস্থার। ধনীবান্ধব ব্যবস্থার বদলে আনতে হবে দরিদ্রবান্ধব ব্যবস্থা। যার মাধ্যমে দারিদ্র্যের চির অবসান ঘটানো যায়। বদলাতে হবে শোষণনির্ভর ব্যবস্থা, আনতে হবে শোষণমুক্তির ব্যবস্থা। বদলাতে হবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। আনতে হবে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। যে ব্যবস্থা সমাজকে সাম্যের পথে অগ্রসর করে নেবে। বৈষম্যমূলক, নিপীড়ন, নির্যাতনমূলক ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে মানুষের বৈষম্যহীন সামাজিক সাম্যভিত্তিক মানবিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। কাজটি কঠিন হলেও অসাধ্য নয়। এখনো কিউবা, ভিয়েতনাম, নেপাল, কেরালা প্রভৃতি দেশ ও প্রদেশে সমাজতান্ত্রিক শক্তি ক্ষমতায় থেকে বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে তারা করোনা প্রতিরোধে সক্ষম।

প্রকাশ | ১৯ জুন ২০২০, ০০:০০

রণেশ মৈত্র
গোটাবিশ্ব্বকে আলোড়িত করল ২৫ মে ২০২০। সেদিন অবাক হয়ে শত শত কোটি মানুষ দেখলেন শত সহস্র বছরব্যাপী মার্কিন দেশে সযতনে লালিত বর্ণবাদ কী ভয়াবহ রূপ নিয়েই না আত্মপ্রকাশ করতে পারল এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে। সেদিন মানুষ চকিতচিত্তে নিজ নিজ কানে শুনতে পেলেন একটি কোনোদিন না শোনা চিৎকার। এ যুগের এক তরুণ মার্কিনি জর্জ ফ্লয়েড। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকার করোনা দমনে ব্যর্থ হলেও কৃষ্ণবর্ণের জর্জ ফ্লয়েডকে দমনে নৃশংস বর্বর অত্যাচার চালিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করতে শ্বেতাঙ্গ অহমিকা পূরণ করতে ঠিকই সক্ষম হয়েছিল। সাদা মানুষের নয়, বর্ণবাদী শ্বেতবর্ণের ট্রাম্প প্রশাসনের এক পুলিশ যে নারকীয় অত্যাচার চালিয়ে জর্জ ফ্লয়েডকে বেমালুম হত্যাকান্ড চালাতে পারলেও বিজয়ের হাসিটি হাসার সুযোগ পায়নি। মুহূর্তেই খবরটি ছড়িয়ে পড়ল সমগ্র মার্কিন মুলস্নুকে গোটাবিশ্বে বিদু্যতের মতো ছড়িয়ে পড়ল। প্রতিরোধের শক্তিগুলো একাট্টা হয়ে নেমে এলেন রাজপথগুলোতে। মিছিলের পর মিছিল কঠোরতম ভাষায় নিন্দা ও প্রতিবাদ ধ্বনিত করতে। নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন থেকে শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি রাজ্যে, শহরে, ইউরোপ, আফ্রিকা এশিয়াজুড়ে মানুষের মিছিল অবিরাম আজও চলছে। সিএনএনে লাইভ দেখলাম সেদিন জর্জ ফ্লয়েডের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া। কী বিপুল জমায়েত, সবার বুকে লেখা বস্ন্যাক মেটারস কৃষ্ণবর্ণের মানুষই কি শুধু মিছিলে ছিলেন? না, বিপুলসংখ্যক শ্বেতাঙ্গ নারী-পুরুষও। শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে মানবিক আচরণ, মানবাধিকারের ও বর্ণবৈষম্যের চির অবসানের দাবিতে বিশাল ওই জমায়েতটি ছিল মুখরিত। অথচ সেখানে তো শুধুই জর্জ ফ্লয়েডকে শেষ স্যালিউটটি জানানোই তো হওয়ার কথা ছিল সেদিন। বস্তুত কৃষ্ণাঙ্গ আদিবাসী নির্যাতন তো নতুন কিন্তু নয়- শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই ভাইরাসটি পৃথিবীর দেশে দেশে ঠাঁই করে নিয়েছে যেন এটাই কৃষ্ণাঙ্গ আদিবাসী, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ভাগ্যলিপি। হাজারো মৃতু্য, লাখো ক্রন্দন, কোটি কোটি চোখের অশ্রম্ন বহুকাল আগে থেকে সম্ভবত ফিউডাল যুগ থেকে আজ পর্যন্ত। মানুষে মানুষে সমান অধিকার আজও সর্বত্রই ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। ফিউডাল যুগের সমাপ্তি ঘটেছে, পুঁজিবাদের (তুলনামূলকভাবে অবশ্যই আধুনিক ও প্রগতিশীল) বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটেছে। আইন-আদালত চালু হয়েছে কিন্তু বর্ণবাদ, ধর্মীয় ও জাতিগত বিভাজন, নির্যাতন রয়েই গেছে- দিন দিন তা বাড়ছে বরং। সেই যে দাসপ্রথার যুগ কবেই না অবসান ঘটেছে; দাসযুগের প্রবল আন্দোলনও তীব্র জনমতের চাপে। কিন্তু ক্রীতদাসপ্রথা নানারূপে, নানা ঢঙে আজও যেন সর্বত্র বিরাজমান। ফিউডাল যুগ এলো- দাসযুগের চেয়ে আধুনিক ও প্রগতিশীল। কিন্তু ওই প্রতিক্রিয়াশীল পরিপূর্ণ অবসান আকাঙ্ক্ষিত হলেও তা ঘটেনি। ঘটতেও দেওয়া হয়নি। এলো পুঁজিবাদ। আজও তা দাপটের সঙ্গে তার অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। পুঁজিবাদকে তো নিশ্চিতভাবেই দাসযুগ ফিউডাল যুগের চেয়ে প্রগতিশীল। পুঁজিবাদ গণতন্ত্রের কথা বলে, মানবাধিকারের কথা বলে, ন্যায়বিচারের কথা বলে। সেই পুঁজিবাদী বিশ্বের মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেখানকার গণতন্ত্র, সেখানকার মানবাধিকার, ন্যায়বিচার, আইনের শাসন- এই মোহনীয় কথাগুলো কিন্তু অর্থহীন শব্দ সমষ্টির মান? বাস্তবচিত্র পুঁজিবাদী বিশ্বের সর্বত্রই আলাদা। জনমতের সঠিক প্রতিফলন কোথাও নেই। প্রতিফলন যে নেই তা এই তো সেদিন দেখিয়ে দিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যেখানে আইনের তোয়াক্কা না করে শ্বেতাঙ্গ এক পুলিশ কর্মকর্তা মিথ্যা অজুহাতে অকথ্য হামলা করে জর্জ ফ্লয়েডের কোমরের হাড় ভেঙে দিল এবং পরিণতিতে ফ্লয়েডকে মৃতু্যবরণ করতে হলো। শ্বাসরোধ করে এমন করুণ মৃতু্য ঠেকলো না, ফ্লয়েডের কণ্ঠে উচ্চারিত আকুল আর্তির করুণ চিৎকার। ফলে গোটা সচেতন বিশ্ব এই নির্মম ঘটনার প্রতিবাদে মিছিলের পর মিছিল করে মার্কিনি মিছিলকারীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে একদিকে যেমন বলছেন, 'বস্ন্যাক লাইফ মেটারস' তেমনি তারা উচ্চকণ্ঠে বলেছেন 'আমাদের শ্বাসও রুদ্ধ হয়ে এসেছে।' এমন উচ্চারণ আজ গোটা বিশ্বের। সেখানে কী শ্বেতাঙ্গ, কী কৃষ্ণাঙ্গ, কী নারী, কী পুরুষ, কী হিন্দু, কী মুসলমান, কী বৌদ্ধ, কী খ্রিষ্টান, কী সমতলের, কী পাহাড়ের আদিবাসী সব একাকার। সবাই পরস্পর পরস্পরের হাত মিলিয়ে সোচ্চার কণ্ঠে স্স্নোগানগুলো তুলছেন। একই ধরনের ঘটনা ঘটতে দেখি পাকিস্তানে- যেখানে নির্মম নির্যাতন করে ৯৯ ভাগ হিন্দু শূন্য করা হয়েছে, অসংখ্য হিন্দু নারী অপহরণ ও ধর্ষণ করা হয়েছে। হাজার হাজার হিন্দু নর-নারীকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করা হয়েছে। ভারতে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি আমলে এসে তাদের রাজত্বের প্রথমদিকে দেশটিতে গৌরবোজ্জ্বল অতীতের ঐতিহ্যকে বিসর্জন দিয়ে অসংখ্য মুসলমানকে ধর্মান্তরিত করা হয়, গো-মাংসের ভক্ষণের বা সংরক্ষণের অভিযোগে অনেক মুসলমানকে হত্যা অথবা নির্যাতন করা হয়। চিকিৎসার ক্ষেত্রেও মুসলিম রোগীরা বৈষম্যের শিকার হন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। যার কোনো অস্বীকৃতি রাষ্ট্রীয় কোনো মহল থেকে করতে দেখা যায়নি। তদুপরি নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের মাধ্যমে বহু মুসলিম নাগরিকের নাগরিকত্ব হরণের অপচেষ্টাও চলছে। বাংলাদেশের দিকে তাকালে সেখানেও কোনো ভিন্ন চিত্র চোখে পড়ে না। পাকিস্তান আমল তো গোটাটাই ছিল উগ্র সাম্প্রদায়িতকতার নগ্ন আচরণে পূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশেও বিজয়ের পর ৩-৪ বছর যেতে না যেতেই শুরু হতে থাকে সাম্প্রদায়িকতার উগ্র বহিঃপ্রকাশ। ধারাবাহিকভাবে অবাধে চলছে হিন্দুবাড়ি ও ব্যবসাস্থল দখল, আবাদি জমি জবর-দখল, অগ্নিসংযোগ, দেশত্যাগে বাধ্যকরণ, হত্যা-ধর্ষণ প্রভৃতি। কোনো বিচার নেই, কোনো অপরাধীর শাস্তি নেই। অনেক ঘটা করে যে পাবর্ত্য শান্তিচুক্তি করা হয়েছিল পাহাড়ি আদিবাসীদের সঙ্গে আজ থেকে প্রায় ২৩ বছর আগে তার পূর্ণ বাস্তবায়ন আজও হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় আজও যেন সামরিক প্রভুত্ব চলছে। কল্পনা চাকমার হদিস আজও মিলছে না। নিখিল তো মাত্র সেদিনের ঘটনা। তাস খেলার অভিযোগে পিঠের হাড় ভেঙে দিয়ে হত্যা করা হলো তাকে। সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাকে অনেক বাহানার (আপস প্রভৃতি) পর গ্রেপ্তার করা হলেও নিশ্চিতভাবেই বলা যায় এর ভবিষ্যৎ। চলছে করোনার মহামারি পৃথিবীব্যাপী মৃতু্যর মিছিল। তবুও থামে কি বর্ণবাদী, সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত নিপীড়ন, নির্যাতন। বহু আগেই এক বৈশ্বিক চরিত্র ধারণ করেছে এটি। আবার এই করোনা মহামারিকে কেন্দ্র করেই চলছে মারাত্মক মেরুকরণ প্রক্রিয়া। শ্রমিকদের হাজার হাজার চাকরিচু্যতি, নতুন নতুন বেকারের সৃষ্টি দেশে বিপজ্জনক ও আতঙ্কজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করলেও রাষ্ট্র কর্তৃক তা উপেক্ষিত। একদিকে হাসপাতাল, বেড-ডাক্তার-নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, চিকিৎসা উপকরণ, আইসিইউ, ভেন্টিলেটর প্রভৃতির নিদারুণ অভাব অন্যদিকে করোনায় মৃতু্যজনিত কারণে লাখ লাখ মায়ের বুক খালি হওয়া এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশে একটি বাজেট প্রস্তাবনা হাজির করা হয়েছে কয়েক লাখ কোটি টাকার। কিন্তু স্বাস্থ্য খাত, বেকারত্ব দূরীকরণ, করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত সব মানুষ, রোগী, চিকিৎসক, পুলিশ, সাংবাদিক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী এবং নতুন নতুন হাসপাতাল নির্মাণ, চিকিৎসক নিয়োগের সুযোগ রাখা হয়নি স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দে। নামমাত্র বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হলেও তাদের নূ্যনতম প্রয়োজন মেটানোর ধারে-কাছেও যাওয়া যাবে না। যে অনাচার, অত্যাচার, শোষণের বিবরণ হাজির করা হলো তা ঘটনাবলির বিবেচনায় অত্যন্ত কম। কিন্তু এগুলোর হাত থেকে মানুষকে রক্ষা পেতে হবে। তার পথ কী? সহজেই যে উত্তর অনেকেই দিয়ে থাকেন- তা হচ্ছে সরকার বদল চাই। কিন্তু সরকার বদল তো বহুবার ঘটেছে সমস্যাবলির সমাধান কেউ করেছে কি? মূল কথা হলো- বদলাতে হবে ব্যবস্থা। গণবিরোধী ব্যবস্থার স্থলে আনতে হবে গণমুখী ব্যবস্থার। ধনীবান্ধব ব্যবস্থার বদলে আনতে হবে দরিদ্রবান্ধব ব্যবস্থা। যার মাধ্যমে দারিদ্র্যের চির অবসান ঘটানো যায়। বদলাতে হবে শোষণনির্ভর ব্যবস্থা, আনতে হবে শোষণমুক্তির ব্যবস্থা। বদলাতে হবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। আনতে হবে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। যে ব্যবস্থা সমাজকে সাম্যের পথে অগ্রসর করে নেবে। বৈষম্যমূলক, নিপীড়ন, নির্যাতনমূলক ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে মানুষের বৈষম্যহীন সামাজিক সাম্যভিত্তিক মানবিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। কাজটি কঠিন হলেও অসাধ্য নয়। এখনো কিউবা, ভিয়েতনাম, নেপাল, কেরালা প্রভৃতি দেশ ও প্রদেশে সমাজতান্ত্রিক শক্তি ক্ষমতায় থেকে বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে তারা করোনা প্রতিরোধে সক্ষম। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপর্যয় ঘটেছে বিগত শতকের শেষ দশকে। এই সাময়িক বিপর্যয় থেকে নতুন অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে যে ব্যবস্থাকে বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য আজ বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে বিজয়ের প্রত্যয় নিয়ে আন্দোলনে নামার বিকল্প নেই। তাই সর্বজনীন বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন, সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবৈষম্য, লিঙ্গবৈষম্য, জাতিগত বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে একটি শোষণমুক্ত, সার্বজনীন সমাজব্যবস্থা গড়তে হবে। সক্ষম সবার জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান, চাকরি বা বেকারত্বের অবদানকে সুনিশ্চিত করে সবার বাসযোগ্য একটি সুন্দর, সভ্য ও গণতান্ত্রিক সমাজ গড়তে হবে। জর্জ ফ্লয়েড, বিপস্নবী সালাম। জীবন দিয়ে ব্যবস্থা বদলের চিন্তা জাগানোর জন্য। পৃথিবী জাগছে- তোমার হত্যার নিষ্ঠুরতায় সচেতন হয়ে। রণেশ মৈত্র : রাজনীতিক ও সাংবাদিক। সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ