চাকরি হারানোর আতঙ্ক

একটি দেশের উন্নয়ন কখনো সম্ভব নয়, যদি সে দেশের শ্রমজীবী মানুষ তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকে। তাই একটা বিষয় সবার মনে রাখতে হবে- শ্রমিকরা শুধু মালিকদের কারখানার উৎপাদন ব্যবস্থার অংশ না। বরং তারা দেশের দক্ষ নাগরিক ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের অন্যতম কারিগরও।

প্রকাশ | ২০ জুন ২০২০, ০০:০০

সাহাদাৎ রানা
করোনাভাইরাসে প্রতিদিন আমাদের দেশে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে ভয় আর উৎকণ্ঠা। বেঁচে থাকার প্রশ্নে এখন করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সবাই যার যার মতো লড়াই করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। এ লড়াই শুধু করোনা নামক একটি ক্ষুদ্র ভাইরাসের বিরুদ্ধে নয়, অনেক কিছুর সঙ্গেই লড়াই করতে হচ্ছে মানুষকে। সবার আগে লড়াইটা বেঁচে থাকার প্রশ্নে। আরও সহজ করে বললে ক্ষুধার সঙ্গে। সবার মতো বাংলাদেশের মানুষও এই লড়াইয়ে শামিল। তবে বাস্তবতা হলো আমাদের দেশে করোনাকালীন এমন কঠিন সময়ে সবাই কষ্টে আছেন। তবে সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছেন বেসরকারি চাকরিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষ। এসব মানুষের জীবন কাটছে নিদারুণ কষ্ট ও শঙ্কার মধ্যে। এখন সবচেয়ে বেশি শঙ্কা তৈরি হয়েছে এসব মানুষের চাকরির নিশ্চয়তা বিষয়ে। ইতোমধ্যে বিশ্বের অনেক প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরি হারাচ্ছেন লাখ লাখ মানুষ। এর বাইরে নয়, বাংলাদেশও। বাংলাদেশেও ইতোমধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠানের অনেক লোক বেকার হয়ে গেছেন। তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি আঘাত লাগার শঙ্কায় রয়েছে তৈরি পোশাক শিল্পে। এছাড়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের লোকজনও সেই আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। আতঙ্কটা চাকরি থাকা না থাকার বিষয়ে। আমাদের দেশের রপ্তানির ৮৪ ভাগ আয় আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। কিন্তু দুখের বিষয় হলো এই খাত থেকেই বর্তমানে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক ছাঁটাইয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেখা দিয়েছে অসন্তোষও। অথচ, পোশাক খাতের সমস্যা নিরসনে মালিকপক্ষ অঙ্গীকার করেছিল শ্রমিক ছাঁটাই করা হবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা সে অঙ্গীকার রাখেননি। নীরবে শ্রমিক ছাঁটাই করা হচ্ছে। এদিকে পোশাক মালিকদের দাবি কারখানায় কাজ না থাকা সত্ত্বেও দুই মাস তারা শ্রমিকদের বেতন দিয়েছেন। এখন অর্ডার কমে যাওয়ায় কাজের চাপও কমে গেছে। তাই কারখানায় কাজ না থাকলে শ্রমিকদের বসে বসে বেতন দেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। মালিকদের কথায় কিছু যুক্তি রয়েছে। তবে এটাও সত্যি দীর্ঘদিন এসব শ্রমিকদের শ্রমের কারণে মালিকরাও বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন। এখন কয়েক মাস কম লাভ করার কারণে এসব শ্রমিকদের ছাঁটাই কোনোভাবেই কাম্য নয়। অথচ, এসব শ্রমিকদের কঠোর শ্রমের কারণেই মালিকদের টাকার পাহাড় হয়েছে। তাই শ্রমিকদের দুর্দিনে মালিকপক্ষের উচিত তাদের পাশে থাকা। কিন্তু তা না করে উল্টো শ্রমিকদের ছাঁটাই করা হচ্ছে। তবে বাস্তবতা হলো বর্তমান পরিস্থিতিতে বহু কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বন্ধ হলে তখন এমনিতেই শ্রমিকরা বেকার হয়ে যাবে। যা দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো খবর নয়। কেননা, বর্তমানে দেশে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করে তৈরি পোশাক খাতে। যদি কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে যায় তবে কয়েক হাজার শ্রমিক নিশ্চিতভাবে বেকার হয়ে যাবেন। এটা শুধু দেশের তৈরি পোশাক খাতের জন্য অশনিসংকেত নয়, অর্থনীতির জন্যও শঙ্কার খবর। এটা সত্যি করোনার কারণে টানা ৬৬ দিন দেশ লকডাউনে থাকার কারণে অর্থনীতির ওপর বড় রকমের আঘাত এসেছে। তবে সরকার সেই আঘাত কাটিয়ে উঠার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে সরকার করোনা শুরুর সময়ে তৈরি পোশাক খাতে বিশাল অঙ্কের প্রণোদনা দিয়েছে। শুধু তাই নয়, সবার পাশে থাকার বিষয়েও আশ্বাস দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বাস্তবিকভাবে তাদের পাশে থেকে সরকার সেটার প্রমাণও দিয়েছে। তবে এখন কঠিন সময় হলেও তৈরি পোশাকশিল্প খাতকে এগিয়ে নিতে হবে। কেননা, দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে এই খাতের ভূমিকা ব্যাপক। আর এ ক্ষেত্রে সরকার গুরুত্বও দিয়েছে শুরু থেকেই। এর আগে করোনার সময় যখন সরকারি অফিস খোলা হয়নি তখন দেশে সীমিত আকারে গার্মেন্টস চালু করা হয়েছিল। সে সময় নিজেদের কর্মস্থলে যোগ দিতে এসব শ্রমিকরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে ঢাকায় এসেছে। কোনো নিয়ম নীতি না মেনে তারা প্রবেশ করেছে কর্মস্থলে। এখানে অবশ্য শ্রমিকদের দায় দিয়ে কোনো লাভ নেই। তারা একমাত্র সম্বল চাকরি বাঁচাতে বাধ্য হয়ে পায়ে হেঁটে কর্মস্থলে এসেছিল। যদিও সে সময় মালিকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল কাজে যোগ না দিলেও চাকরি যাবে না। কিন্তু শ্রমিকরা এমন আশ্বাসকে বিশ্বাস করতে পারেনি। বিশ্বাস না করার মতোও যথেষ্ট কারণ ছিল। কেননা, গার্মেন্টস চালু হওয়ার পর থেকেই শ্রমিক ছাঁটাইয়ের অভিযোগ উঠেছে। চাকরি ফিরে পাওয়ার দাবিতে রাস্তা অবরোধ করার ঘটনাও দেখা গেছে। শুধু তাই নয়, চাকরি হারানোর পাশাপাশি অনেক প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা তাদের কয়েক মাসের বকেয়া বেতনের দাবিতে রাস্তায়ও নেমেছে। করোনাভাইরাসের মতো মহামারির সময় এমন ঘটনা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। অবশ্য আমাদের দেশে শ্রমিকদের বকেয়া বেতন বা ছাঁটাইয়ের ঘটনার উদাহরণ ও প্রতিবাদ নতুন কিছু নয়। তবে করোনার মতো কঠিন এই সময়ে এমনটি কেউ আশা করেনি। এখানে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- মালিক পক্ষ অনেক সময় শ্রমিকদের বাড়তি উৎপাদনের জন্য অতিরিক্ত শ্রম দিতে বাধ্য করছে। এখনো অতিরিক্ত শ্রম দিচ্ছে শ্রমিকরা। কিন্তু বিপরীতে ওভার টাইমের প্রাপ্য মজুরি ভাগ্যে খুব একটা জোটে না এসব শ্রমিকদের। এটা তৈরি পোশাক শ্রমিকদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য। অপ্রিয় হলেও সত্য আমাদের দেশের শ্রমিকরা নানা দিক দিয়ে শোষিত ও বঞ্চিত। শুধু কর্মঘণ্টার দিক দিয়েই নয়। তারা বঞ্চিত আরও অনেক দিক দিয়ে। বিশেষ করে শ্রমবাজারে নারী শ্রমিকরা তাদের প্রাপ্য শ্রমের ন্যায্য মজুরি পান না। কর্ম ক্ষেত্রে শিকার হন নানা বৈষম্যের। এছাড়া রয়েছে যখন তখন চাকরি হারানোর নিত্যদিনের আতঙ্ক। এ কারণে শ্রমিকরা অনেক সময় তাদের সর্বোচ্চটা দিতে ব্যর্থ হন। বিরূপ প্রভাব পড়ে উৎপাদন ব্যবস্থায়। দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশ হিসেবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আলোচনা করলে দেখা যায়, এখানে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু এসব শ্রমজীবী মানুষরা নানা কারণে তাদের নায্য অধিকারের বিষয়ে সেভাবে এখনো সচেতন হয়ে উঠেননি। একটি দেশের উন্নয়ন কখনো সম্ভব নয়, যদি সে দেশের শ্রমজীবী মানুষ তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকে। তাই একটা বিষয় সবার মনে রাখতে হবে- শ্রমিকরা শুধু মালিকদের কারখানার উৎপাদন ব্যবস্থার অংশ না। বরং তারা দেশের দক্ষ নাগরিক ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের অন্যতম কারিগরও। কারণ তাদের কেন্দ্র করেই শ্রমবাজারের অর্থনীতির চাকা গতিশীল হয়। এগিয়ে যায় দেশ। তাই শ্রমজীবী মানুষরা তাদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে যত শক্তিশালী করবে ততই সুদৃঢ় হবে দেশের উন্নয়ন। তাই করোনাভাইরাসের এমন কঠিন সময়ে বিশ্বের সব শ্রমিকদের সঙ্গে মালিক পক্ষের দৃঢ় বন্ধনও জরুরি। শুধু তৈরি পোশাক শিল্পে নয়, বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বিপুলসংখ্যক মানুষ চাকরি হারানোর আতঙ্কে ভুগছে। করোনার এমন কঠিন সময়ে যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সবার এখন প্রত্যাশা এমন পরিস্থিতিতে কারো চাকরি যাবে না। বিরূপ পরিস্থিতির কারণে যদি শ্রমিক ছাঁটাই করতে হয় তবে অবশ্যই শ্রম আইন অনুযায়ী করতে হবে। যেন কোনো শ্রমিক বঞ্চিত না হয়। তাদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা বুঝিয়ে দিতে হবে। কিন্তু দুখের বিষয় এসব কোনো কিছুই মানছেন না বেশিরভাগ মালিকপক্ষ। নিজেদের ইচ্ছে মতো তারা ছাঁটাই করছেন শ্রমিক। কিন্তু এটা হতে দেয়া যাবে না। এর জন্য যার যার জায়গা থেকে প্রতিবাদ করতে হবে। অন্যায়ভাবে চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হলে অবশ্যই আইনের আশ্রয় নিতে হবে। সাহাদাৎ রানা : সাংবাদিকও কলামিস্ট