কামাল লোহানীর প্রয়াণ

এ ক্ষতি অপূরণীয়

প্রকাশ | ২১ জুন ২০২০, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
এ দেশের সাংবাদিকতা ও সংস্কৃতির ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল নাম কামাল লোহানী। বাঙালির ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে তার ভূমিকা ও অবদান অবিস্মরণীয়। আজীবন সংগ্রামী কামাল লোহানী দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এক পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তিনি সব সময় ছিলেন সামনের সারির অকুতোভয় লড়াকু সৈনিক। শনিবার ২০ জুন সকাল ১০টার দিকে রাজধানীর মহাখালীতে শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতাও ছিল তার। কামাল লোহানী অনেক দিন ধরেই ফুসফুস ও কিডনি সমস্যায় ভুগছিলেন। তার বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। ১৯৩৪ সালের ২৬ জুন সিরাজগঞ্জের উলস্নাপাড়া থানার খান সনতলা গ্রামে তার জন্ম। বাবা আবু ইউসুফ মোহাম্মদ মুসা খান লোহানী। মা রোকেয়া খান লোহানী। মাকে হারান মাত্র সাত বছর বয়সে। এর পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকার মধ্যে কলকাতার শিশু বিদ্যাপীঠে তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়। দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে চলে আসেন পাবনায়। পাবনা জিলা স্কুল থেকে ভাষা আন্দোলনের বছরে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এ সময় তিনি যুক্ত হন রাজনীতিতে। যোগ দেন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিতে। পাবনায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। এরই মধ্যে পাবনা অ্যাডওয়ার্ড কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পরই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি টানেন তিনি। যুক্ত হন রাজনীতি, সাংবাদিকতা ও সংস্কৃতি চর্চায়। ১৯৬০ সালে চাচাতো বোন সৈয়দা দীপ্তি রানীকে বিয়ে করেন কামাল লোহানী। ২০০৭ সালের ২৪ নভেম্বরে তার দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের অনুপ্রেরণাদাত্রী স্ত্রী দীপ্তি লোহানীর প্রয়াণে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন কামাল লোহানী। এ দম্পতির এক ছেলে ও দুই মেয়ে- সাগর লোহানী, বন্যা লোহানী ও ঊর্মি লোহানী। মুক্তিযুদ্ধের সময় কামাল লোহানী স্বাধীন বাংলা বেতারের সংবাদ বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ ডিসেম্বর তিনি ঢাকা বেতারের দায়িত্ব নেয়ার পর বিধ্বস্ত বেতারকে পুনর্গঠনে মনযোগী হন।? ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে ধারাবিবরণী দিয়েছিলেন কামাল লোহানী। ১৯৭২ সালের ফেব্রম্নয়ারি বঙ্গবন্ধুর কলকাতা সফর উপলক্ষে দমদম বিমানবন্দরেও ধারাবিবরণী দিয়েছিলেন তিনি। কর্মজীবনে কামাল লোহানী দৈনিক মিলস্নাত পত্রিকা দিয়ে সাংবাদিকতার শুরু করেন। এরপর আজাদ, সংবাদ, পূর্বদেশ, দৈনিক বার্তায় গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন। দেশ স্বাধীন হলেও প্রশাসনে পরিবর্তন আসেনি বলে বেতারের চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে ১৯৭৩ সালে সাংবাদিকতায় ফিরে এসে যোগ দেন 'দৈনিক জনপদে'। ১৯৭৪ সালে 'বঙ্গবার্তা', এরপর 'দৈনিক বাংলার বাণী' পত্রিকায় কাজ করেন। সরকার ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন সংবাদপত্র অ্যানালমেন্ট অধ্যাদেশ জারি করে মাত্র চারটি পত্রিকা ছাড়া সব পত্রিকা প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়। নির্মল সেন ও কামাল লোহানী বাকশালে যোগদানে অস্বীকৃতি জানান। ফলে চাকরিহীন অবস্থায় ১৯৭৭ সালে রাজশাহী থেকে প্রকাশিত 'দৈনিক বার্তা'র নির্বাহী সম্পাদক হন। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটেরও উপদেষ্টা কামাল লোহানী বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে দু'বার মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি হিসেবে এবং ছায়ানটের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। তিনি বেশ কয়েকটি বইও লিখেছেন। ২০১৫ সালে সাংবাদিকতায় একুশে পদক লাভ করেন। এছাড়াও তিনি কলকাতা পুরসভার দ্বিশতবর্ষ সম্মাননা, প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক সম্মাননা, রাজশাহী লেখক সংঘ সম্মাননা, ক্রান্তি স্মারক, ঋষিজ সম্মাননা ও স্মারক, জাহানারা ইমাম পদকসহ বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। তিনি আজ দূর আকাশে মিলিয়ে গিয়েছেন, রেখে গেছেন তার কাজ ও চেতনা। যে চেতনা বাঙালিকে ভবিষ্যৎ চলার পথ দেখাবে।