পাঠক মত

লিবিয়া সংকট এবং বাংলাদেশি হত্যা

প্রকাশ | ২১ জুন ২০২০, ০০:০০

মো. বিপস্নব আলী শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
লিবিয়া ভূ-রাজনৈতিকভাবে উত্তর আফ্রিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। দেশটি প্রাচীনকালে রোমান ও ফিনিসীয় সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র ছিল। লিবিয়ার উত্তরদিকে ভূমধ্যসাগর, দক্ষিণে চাঁদ ও নাইজার, পশ্চিম দিকে আলজেরিয়া ও তিউনিসয়া এবং পূর্বদিকে মিশর অবস্থিত। আর ভূমধ্যসাগর কেন্দ্র করে ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্য পথে যোগাযোগব্যবস্থা খুব সহজে করা যায়। এই নৌপথ প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত ইউরোপ ও আফ্রিকার মধ্য যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হিসেবে সুপরিচিত। ঔপনিবেশিক শাসনামলে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইরোপীয়নরা ত্রিপোলিসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য নামে কৃষ্ণঙ্গদের দাস হিসেবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাজারজাত করতেন। ঔপনিবেশিক শাসন অবসানের পর লিবিয়ায় ১৯৫১ সালে একটি স্বাধীন রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে তরুণ সামরিক অফিসার মুয়াম্মদ আল-গাদ্দাফি সেনা অভু্যত্থানের মধ্যদিয়ে ১৯৬৯ সালে দেশটির রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেন। গাদ্দাফি তার সমাজতন্ত্র ও আরব জাতীয়তাবাদের তত্ত্ব অনুযায়ী একটি নতুন সমাজতান্ত্রিক আরব গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র আখ্যা দিয়ে লিবিয়া গঠন করেন। দীর্ঘ চলিস্নশ বছর ত্রিপোলি শাসনের পর ২০১১ সালে আরব বসন্ত মধ্যদিয়ে কর্নেল গাদ্দাফির জামানা অবসান হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ন্যাটোভুক্ত সহচর রাষ্ট্রগুলো অস্ত্র ও অন্যান্য সামগ্রী সরবরাহ করে এবং সরাসরি জঙ্গি বিমান দিয়ে হামলা করে ক্ষমাতাসীন রাষ্ট্রনায়ক গাদ্দাফিকে উৎখাত করে। এরপর থেকেই লিবিয়া রাষ্ট্র ক্ষমতার দ্বন্দ্ব তথা গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়। কয়েক বছর অভ্যন্তরীণ সংঘাতের পর জাতিসংঘ সমর্থনে সরকার গঠন করেন প্রধানমন্ত্রী ফয়েজ আল সেরাজ। রাজধানী ত্রিপোলিভিত্তিক তার জাতীয় ঐক্যের সরকারের লক্ষ্য ছিল লিবিয়াকে এক করা। কিন্তু দেশটির বিভিন্ন গোত্র, গোষ্ঠী, বর্ণজাতি, মিলিশিয়া বাহিনী ইত্যাদি মতাদর্শের মানুষ বসবাস করেন এবং তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ বৈসাদৃশ্য। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠাকারী সংস্থা, জাতিসংঘ সমর্থিত সরকার ফয়েজ আল-সেরাজকে লিবিয়ার সব সম্প্রদায় গ্রহণ করতে পারেনি। যার পেক্ষাপটে মিলিশিয়া বাহিনী নিয়ে জেনারেল হাফতার দেশটির রাষ্ট্রক্ষমতা দাবি করেন। তিনি লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (এলএনএ) গঠন করেন তবরুক ও বেনগাজি শহরকে ভিত্তি করে। জেনারেল হাফতার দাবি করেন, তিনিই লিবিয়াতে শান্তি পুনর্প্রতিষ্ঠা, গোত্র দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক অরাজকতা এবং ইসলামী সন্ত্রাস দূর করতে পারেন। এমন অরাজকতা অবস্থায় বর্তমানে ত্রিপোলি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও অন্যান্য সংকট বিরাজ করছে। প্রায় এক দশকে গৃহযুদ্ধে ও বর্তমান মহামারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব লিবিয়া, আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে ভঙ্গুর অর্থ, যুদ্ধঘটিত মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। তবে সবকিছু উপেক্ষা করে সম্প্রতি একটি ঘটনা বিশ্ববাসীর মনে বিশেষভাবে দাগ কেটেছে। রাষ্ট্রটির মিজদা শহরে ত্রিশজন অভিবাসী নৃশংসভাবে হত্যার শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে ২৬ জন বাংলাদেশের নাগরিক ও অন্যরা আফ্রিকান নাগরিক। আবার অনেকে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছরই হাজার হাজার যুবক ভাগ্যের চাকা পরিবর্তনের উদ্দেশে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমায়। কেউ কেউ নিজের সহয়সম্ল বিক্রি করে ভাগ্যদেবী পাওয়ার লক্ষ্য দেশ ত্যাগ করেন। আবার অনেক স্বপ্নবাজ যুবক মানব পাচারকারীর সহায়তায় অবৈধভাবে বিদেশ গমন করেন। আর অবৈধ পথে লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের কোন দেশে প্রবেশ করা খুব সহজ। লিবিয়ার মিজদা শহরে এই স্বপ্নবাজ যুবকদের মানব পাচারকারী চক্র জিম্মি করে মুক্তিপণ দাবি করলে হতভাগ্যরা একজন পাচারকারীকে হত্যা করেন। তখন প্রতিশোধ হিসেবে ত্রিশজন অভিবাসীকে হত্যা করে পাচারকারীর স্বজনরা। তবে প্রতিবছর ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার সময় নৌকাডুবি ঘটনায় অনেক বাংলাদেশি প্রাণ হারান কিন্তু পাচারকারীদের হাতে হত্যা এটি আশ্চার্য। পরবর্তী এরূপ মর্মান্তিক হত্যাকান্ড যদি না ঘটে, তার জন্য দেশে ও দেশের বাইরে এই অশুভ চক্রকে আইনের আওতাধীনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। তাহলে বন্ধ করা সম্ভব অবৈধ পথে বিদেশযাত্রা।