শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

হীরাঝিল থেকে রোজ গার্ডেন : একটি রাজনৈতিক আখ্যান

বহু বছরের সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবতাবাদে বিশ্বাসের প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকার এই মানুষটিকে বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা, বাংলাদেশের প্রতীক এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালিতে পরিণত করেছে। বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক অতুলনীয় নেতৃত্বের মানবতাবাদী 'সম্মোহনী' শক্তি এবং তার হাতে গড়া সংগঠন আওয়ামী লীগের দ্বারা নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণভাবে জনগণকে সংগঠিত করে রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বিাঙালি জাতির জন্য একটি স্বাধীন স্বদেশ দিয়েছেন।
ড. অরুণ কুমার গোস্বামী
  ২২ জুন ২০২০, ০০:০০

নবাব সিরাজ-উদ্‌-দৌলার সিংহাসন ছিল মুর্শিদাবাদের হীরাঝিল (মনসুরগঞ্জ) প্রাসাদে। এখান থেকেই সৈন্য নিয়ে ইংরেজ বাহিনীকে দমন করার উদ্দেশ্যে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব পলাশি অভিমুখে অগ্রসর হয়েছিলেন। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন সকাল ৭টার দিকে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল এবং বিকাল ৫টার মধ্যেই সব শেষ হয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধে পরাজয় নিশ্চিত বুঝতে পেরে সিরাজ হীরাঝিল মনসুরগঞ্জ প্রাসাদে ফিরে এসেছিলেন। প্রাসাদে কিছুক্ষণ অবস্থানের পর জীবন বাঁচানোর জন্য প্রাসাদ থেকে পালিয়েছিলেন। প্রাসাদ থেকে সিরাজের পালিয়ে যাওয়ার ৬ ঘণ্টা পর ২৪ জুন মীর জাফর প্রাসাদের দখল নিয়েছিল। পরে লর্ড ক্লাইভ সেখানে উপস্থিত হয়ে মীর জাফরকে উপহার দিয়ে হাত ধরে সিংহাসনে বসিয়েছিল। অন্যান্য অনেকের পাশাপাশি প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খানের সঙ্গে 'ক্ষমতাসীন' নবাবের নেতিবাচক 'ক্ষমতা সম্পর্ক' এবং বাণিজ্যিক সুবিধার্থে 'ক্ষমতা সম্পর্ক' নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসার জন্য ইংরেজ বেনিয়াদের সর্বব্যাপী ষড়যন্ত্র, মাত্র তিন হাজার পঞ্চাশ জন সৈন্য নিয়ে গঠিত লর্ড ক্লাইভের বাহিনীর বিরুদ্ধে পলাশির প্রান্তরে সংঘটিত মাত্র প্রায় ৮ ঘণ্টার সম্মুখ সমরে, তৎকালীন মুঘল সম্রাটের অপছন্দনীয় বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব সিরাজ-উদ্‌-দৌলার পঞ্চাশ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনীর পরাজয় অনিবার্য করে তুলেছিল। মাত্র অল্প কয়েকটি কথার দ্বারা কাহিনীটি বলা হলেও, এর অতীত ও বর্তমান কারণ এবং ভবিষ্যৎ অভিঘাত খুবই সুদূরপ্রসারী এবং স্থায়ী।

পলাশির যুদ্ধে পরাজিত এবং হীরাঝিল প্রাসাদ থেকে নবাবের পলায়নের ১৯২ বছর পর 'রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার' সঙ্গে 'বাঙালিদের' সম্পর্কের ক্ষেত্রে বৈপস্নবিক পরিবর্তন ঘটানোর লক্ষ্যে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলীর কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেন প্যালেসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একটি রাজনৈতিক দল, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'র ১২০ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু তৎকালীন শাসক 'মুসলিম লীগের গণবিচ্ছিন্নতা', ক্ষমতাকে 'কোটারি করে ফেলা' এবং শাসন ক্ষমতা পরিচালনার জন্য 'কোনো কর্মপন্থা' না থাকার পরিপ্রেক্ষিতে 'নতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করার' প্রয়োজনে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা বলেছেন। বঙ্গবন্ধুর লেখনির মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে তৎকালীন পাকিস্তানের 'ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী' রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি নির্ধারণ, সিদ্ধান্ত প্রণয়ন, কর্মপন্থা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন প্রভৃতি সব পর্যায় থেকে পূর্ব বাংলার 'জনগণ' এবং জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল 'রাজনীতিকদের' বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলেন। ফলে, (পূর্ব) বাংলার 'জনগণ' ও প্রতিনিধিত্বশীল 'রাজনীতিকদের' সঙ্গে 'শাসকগোষ্ঠীর' 'ক্ষমতা সম্পর্ক' হয়ে উঠেছিল 'শত্রম্নতামূলক'। এই ধরনের 'ক্ষমতা সম্পর্কে' বাঙালিদের পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার দল আওয়ামী লীগ। 'শত্রম্নতামূলক' এই 'ক্ষমতা সম্পর্কই' বিভিন্ন ঘটনাবহুল ও বিয়োগান্তক আবর্তনের মাধ্যমে চূড়ান্ত পর্বে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ ও ত্রিশ লক্ষাধিক প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভু্যদয়কে অনিবার্য করে তোলে।

সুপ্রাচীন কাল থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে বা বিশ্বের যে কোনো স্থানে বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে শাসিতদের 'ক্ষমতা সম্পর্ক' কেমন ছিল? কোন শাসনামলে কোন কোন গোষ্ঠীর বা ব্যক্তিবর্গের মধ্যে 'ক্ষমতার সম্পর্ক' কেমন (?) তাই নিয়ে গড়ে উঠে রাজনীতির ব্যাখ্যা। এভাবে 'ক্ষমতা সম্পর্ক' বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করার জন্য গড়ে উঠেছে বিভিন্ন 'অ্যাপ্রোচ' বা 'দৃষ্টিভঙ্গি' বা 'পদ্ধতি'। আমেরিকার সাউথ ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক মাইকেল টি. গিবন্‌স আমেরিকান পলিটিক্যাল সায়েন্স রিভিউ জার্নালের ২০০৬ সালের নভেম্বরের এক সংখ্যায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলছেন, 'রাজনীতির ব্যাখ্যামূলক পদ্ধতির বিকাশে বিগত শতাব্দীব্যাপী বিবর্তনের ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে মূলধারা রাষ্ট্রবিজ্ঞান তা অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছে।'

আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের মধ্যে বাঙালিদের প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জিত না হওয়ার বিষয়টি প্রথম থেকে গুরুত্ব সহকারে উপস্থাপন করেছে। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব বাঙালিকে বোঝানোর প্রয়োজনে পরবর্তীকালে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দেয়া হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই দলটি প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ওপর বিশেষ গুরুত্বসহ ৪২ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে। শুরুর দিকে দলটির প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে ছিল রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি, একব্যক্তির এক ভোট, গণতন্ত্র, সংবিধান প্রণয়ন, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং তৎকালীন পাকিস্তানের দু'অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণ। প্রথম থেকেই এই দলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব সমাদৃত। বাংলাদেশের প্রথিতযশা লেখক মহিউদ্দিন আহমদ (২০১৬) তার আওয়ামী লীগ, উত্থানপর্ব ১৯৪৮-১৯৭০ এর ভূমিকায় লিখেছেন,

"জন্মলগ্ন থেকেই আওয়ামী লীগের প্রাণভোমরা ছিলেন দলের তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। দলের জন্মের ক্ষণটিতে তিনি উপস্থিত ছিলেন না, কারাগারে বন্দি ছিলেন। ধারণা করা হয়, তাকে দলের নির্বাহী কমিটিতে জায়গা করে দিতেই যুগ্ম সম্পাদক পদটি তৈরি হয়েছিল। আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় কাউন্সিল সভা হয় ১৯৫৩ সালে। ওই কাউন্সিলে শেখ মুজিব পুরোপুরি সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। সঙ্গে সঙ্গে যুগ্ম সম্পাদক পদটি লোপ পায়। এর পর শেখ মুজিব আর পেছন ফিরে তাকাননি। এক সময় তিনি হয়ে ওঠেন 'বঙ্গবন্ধু'।

আওয়ামী লীগের ইতিহাস আলোচনা করতে গেলে অবধারিতভাবে চলে আসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। এক ব্যক্তি, একটা রাজনৈতিক দল ও একটা দেশ যখন এক মোহনায় মিশে যায়, তখন তাদের আলাদা করে দেখা বা বোঝা কঠিন একটা কাজ। ........ এ জন্যই আওয়ামী লীগ আর শেখ মুজিব সমার্থক হয়ে উঠেছে বারবার এবং ধীরে ধীরে নেপথ্য থেকে উঠে এসেছে একটা জাতিরাষ্ট্রের জন্ম কথা। (পৃ.১০-১১)'

বহু বছরের সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবতাবাদে বিশ্বাসের প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকার এই মানুষটিকে বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা, বাংলাদেশের প্রতীক এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালিতে পরিণত করেছে। বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক অতুলনীয় নেতৃত্বের মানবতাবাদী 'সম্মোহনী' শক্তি এবং তার হাতে গড়া সংগঠন আওয়ামী লীগের দ্বারা নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণভাবে জনগণকে সংগঠিত করে রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বিাঙালি জাতির জন্য একটি স্বাধীন স্বদেশ দিয়েছেন।

অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে 'বাংলাদেশের প্রতীক' হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলছেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একমাত্র বঙ্গবন্ধুই বাঙালি জাতির প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হয়ে একটি লক্ষ্যে তার সব সমর্থককে একত্রিত করেছিলেন। পাকিস্তানের মৃতু্যগহ্বর থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন স্বদেশের মাটিতে পা রেখেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, 'আজ আমার বাংলাদেশ স্বাধীন, আমার জীবনের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে, আমার বাংলার জনগণ মুক্ত।' প্রশ্ন হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু কখন অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তা করেছিলেন? স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে অন্নদাশঙ্কর রায়ের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু ১৯৪৭ সালে এপ্রিল-মে মাসের দিকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শরৎ বোস, কিরণ শঙ্কও রায়, সত্যরঞ্জন বখশী, আবুল হাশিম, ফজলুর রহমান, মুহম্মদ আলী প্রমুখ কর্তৃক পেশকৃত অবিভক্ত বাংলার পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার প্রেক্ষাপটে স্বাধীন বাংলাদেশের চিন্তা তার মাথায় আসার কথা বলেছিলেন।

এ বছর ২০২০ সালের ৭ জুন ছয় দফা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত ফেসবুক লাইভ প্রোগ্রামে দেশের একজন খ্যাতনামা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, 'অনেকে বলে থাকেন যে পাকিস্তান হওয়ার পরে তারপর আমাদের চেতনার উন্মেষ ঘটে আমরা বুঝলাম যে এই পাকিস্তানতো আমাদের কাঙ্ক্ষিত পাকিস্তান না। এটাও ঠিক নয়। পাকিস্তান হওয়ার আগেই আমাদের নেতৃবৃন্দের একটা অংশ ভালো করে বুঝতে পারছিলেন পাকিস্তান যদি হয় বা আমরা যদি পাকিস্তানের অংশ হই তাহলে আমাদের অবস্থাটা কী হবে?' এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর যুক্ত থাকার কথা উলেস্নখ করে এসবের ভিত্তি ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব হিসেবে উলেস্নখ করেন। হঁ্যা ছয় দফার মধ্যে লাহোর প্রস্তাবের কথা বলা আছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর চেতনায় বাঙালিদের জন্য স্বাধীন আবাসভূমির চিন্তা শুধু লাহোর প্রস্তাব থেকে এসেছে এটিও কিন্তু ঠিক নয়। শোষিত নিপীড়িত বাঙালির জন্য অসাম্প্রদায়িক দেশ ও সমাজ এবং তাদের মুক্তির চিন্তা বঙ্গবন্ধু শৈশব কাল থেকেই পোষণ করতেন। 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' থেকেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

তবে প্রসঙ্গ যখন উঠেছে তখন লাহোর প্রস্তাব সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা করা যেতে পারে। পাকিস্তানের রাজনীতিক ওয়ালি খান তার 'ফ্যাক্টস আর ফ্যাক্টস, অ্যান আনটোল্ড স্টোরি অব ইন্ডিয়া'স পার্টিশন'-এ বলছেন, (অধুনালুপ্ত) সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপস্নবের প্রভাবকে বাধাগ্রস্ত, কংগ্রেসের প্রভাব খর্ব করার লক্ষ্যে ব্রিটিশ সরকার মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করেছে। এ জন্য তারা জিন্নাহ ও মুসলিম লীগকে প্রচুর অর্থ দিয়েছে। এতকিছুর পরেও ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত ৪৮২টি আসনের মধ্যে মাত্র ১০৯টিতে জয়লাভ করতে পেরেছিল। ওয়ালি খান তার এই বইতে ১৯৩৬ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড লিন লিথগোর পত্র দলিল হিসেবে দেখিয়েছেন। সেই পত্রে লিন লিথগো বলছেন, 'আপন মাই ইনসট্রাকশন জাফরউলস্নাহ্‌ রোট অ্যা মেমোরেন্ডাম অন দ্যা সাবজেক্ট। ...আই হ্যাভ অলরেডি সেন্ট ইট টু ইওর অ্যাটেনশন। আই হ্যাভ অলসো আসকড হিম ফর ফার্দার ক্লারিফিকেশন, হুইচ, হি ছেইচ, ইজ ফোর্ত কামিং। হি ইজ অ্যাংসাচ, হাউএভার, দ্যাট নো ওয়ান শুড ফাইন্ড আউট দ্যাট হি হ্যাজ প্রিপেয়ার্ড দিস পস্নান। হি হ্যাজ, হাউএভার, গিভেন মি দ্যা রাইট টু ডু উইথ ইট হোয়াট আই লাইক, ইনক্লুডিং অ্যা কপি টু ইউ। কপিজ হ্যাভ বিন পাসড অন টু জিন্নাহ, অ্যান্ড, আই থিংক, টু স্যার আকবর হায়দারি। হোয়াইল হি, জাফরউলস্নাহ, ক্যাননট অ্যাডমিট ইঁস অথোরশিপ, হিজ ডকুমেন্ট হ্যাজ বিন প্রিপেয়ার্ড ফর অ্যাডাপশন বাই দ্যা মুসলিম লীগ, উইথ অ্যা ভিউ টু গিভিং ইট দ্যা ফুলেস্ট পাবলিসিটি।' অর্থাৎ লর্ড লিন লিথগো'র নির্দেশনা মোতাবেক জাফরউলস্নাহ্‌ বিষয়টির ওপর একটি স্মারকলিপি লিখেছেন। আমি মনোযোগ আকর্ষণ করে এর একটি কপি যথারীতি আপনার নিকট প্রেরণ করেছি। এ ছাড়াও আমি তাকে আরো বিস্তারিত বর্ণনা করতে বলেছি, তিনি বলেছেন, এটি যাচ্ছে। তবে, তিনি কিছুটা উদ্বিগ্ন যে পরিকল্পনাটি তিনি তৈরি করেছেন এটি যেন কেউ জানতে না পারে। তবে, আপনাকে একটি কপি প্রেরণসহ আমার ইচ্ছামত যে কোনো কিছু করার অধিকার তিনি আমাকে দিয়েছেন। জিন্নাহ্‌র নিকট কপি প্রেরণ করা হয়েছে, এবং আমার মনে হয় স্যার আকবর হায়দারির কাছেও তা প্রেরণ করা হয়েছে। জাফরউলস্নাহ্‌ এর রচয়িতা একথা তিনি কখনো স্বীকার করতে পারবেন না, তবে তার দলিলটি পূর্ণ মাত্রায় প্রচার ও মুসলিম লীগ কর্তৃক গৃহীত হওয়ার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে (পৃষ্ঠা ৪০, চ্যাপ্টার ৩)। উলেস্নখ্য, জাফরউলস্নাহ ছিলেন কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের লোক। এ কারণে, মুসলমানদের কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্য জাফরউলস্নাহ্‌ লাহোর প্রস্তাবের রচয়িতা হিসেবে তার নাম প্রকাশে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। যা লিন লিথগোর চিঠিতে উঠে এসছে। এটি হলো লাহোর প্রস্তাবের প্রকৃত ইতিহাস। এহেন লাহোর প্রস্তাবকে বঙ্গবন্ধুর চিন্তার ভিত্তি হিসেবে গণ্য করা ঠিক নয়।

লাহোর প্রস্তাবে ভারতের যেসব মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাসমূহ নিয়ে একাধিক বা কমপক্ষে দু'টি রাষ্ট্র গঠনের কথা বিবেচনা করেই (আলোচিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে) বঙ্গবন্ধু ছয় দফা দাবিতে লাহোর প্রস্তাবের কথা সংযুক্ত করেছিলেন। আওয়ামী লীগের ওই আলোচনা সভায় উলিস্নখিত এই বক্তব্য অনেক আগে দেয়া আবুল মনসুর আহমদের ব্যাখ্যার সঙ্গে সামঞ্জ্যস্যপূর্ণ। আবুল মনসুর আহমদ (১৯৭৫) বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঊহফ ড়ভ ধ নবঃৎধুধষ ধহফ ৎবংঃড়ৎধঃরড়হ ড়ভ খধযড়ৎব জবংড়ষঁঃরড়হ 'এন্ড অব দ্যা বিট্রেয়াল অ্যান্ড রেস্টোরেশন অব লাহোর রেজুলিশন' শীর্ষক নিবন্ধে ঠিক এই কথাটিই বলেছেন। আবুল মনসুর আহমদের মতে 'শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক যে লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন, জিন্নাহ্‌ 'রাষ্ট্রসমূহ' বাদ দিয়ে 'রাষ্ট্র' কথাটি অবৈধভাবে সংযুক্ত করে তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই বিশ্বাসঘাতকতার অবসান ঘটিয়েছেন!' এবারের (২০২০ সালের) ছয় দফা সম্পর্কে আলোচনা সভায় উপরোলিস্নখিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এটুকু বলেননি। কিন্তু তার ব্যাখ্যার অন্তর্নিহিত অর্থ (কনোটেশন) তাই। উপরোলিস্নখিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কর্তৃক উত্থাপিত এবং অনেক আগে আবুল মনসুর আহমদ কর্তৃক ব্যাখ্যাকৃত লাহোর প্রস্তাবের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হিসেবে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার যুক্তি অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। এই প্রশ্নগুলোর অন্যতম হচ্ছে, (১) যে আওয়ামী লীগ 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, সেই আওয়ামী লীগ কী সাম্প্রদায়িক দল 'মুসলিম লীগ'-এর দাবি বাস্তবায়নের জন্য যুদ্ধ করতে পারে? (২) সব ধর্মের অনুসারী বাঙালি জনগণ বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। একটি মাত্র ধর্মের অনুসারীদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমির জন্য মুসলিম লীগের দাবি সংবলিত লাহোর প্রস্তাব-এ পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের জন্য কী অন্য তিন ধর্মাবলম্বীরা রক্ত দিতে পারে? (৩) কংগ্রেসের সংগ্রামের ফসল হিসেবে স্বাধীন হওয়া ধর্মনিরপেক্ষ ভারত কী মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাবের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে সাহায্য সহযোগিতা করতে পারে? (৪) লাহোর প্রস্তাবের কোন স্থানেই পাকিস্তান শব্দটি নেই। যদিও লাহোর প্রস্তাবকে 'পাকিস্তান' প্রস্তাব হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। ইংরেজি 'পাকিস্তান' চঅকওঝঞঅঘ শব্দটি চৌধুরী রহমত আলী ভারতীয় উপমহাদেশের যেসব অঞ্চলের আদ্যাক্ষর নিয়ে গঠন করেছিলেন তার মধ্যে কিন্তু বাংলা ছিল না। তাহলে, স্বাধীন বাংলাদেশ লাহোর প্রস্তাববিষয়ক চিন্তার ফলশ্রম্নতি হিসেবে আখ্যায়িত করার যুক্তি গ্রহণযোগ্য হতে পারে কী? এসব প্রশ্ন নিয়ে গবেষণার অবকাশ আছে। একথা বলে এবারে আমি বঙ্গবন্ধুর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'র ২২, ২৩, ৮১, ১৮৭-১৮৮,১৯১-১৯২ নম্বরের পৃষ্টাগুলোতে উলিস্নখিত ঘটনাবলির প্রতি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করব। এসব পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু যেসব ঘটনার কথা বলেছেন, তা একত্রে বিশ্লেষণ করলে উপরোক্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর এবং আবুল মনসুর আহমদের ব্যাখ্যার অগ্রহণযোগ্যতা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা স্থানাভাবে এখানে সম্ভব নয়। সংক্ষেপে কিছু বলা চেষ্টা করছি। 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'র ২২নং পৃষ্ঠার শুরুতেই দেখা যায় রাত ২টা পর্যন্ত পিতার সঙ্গে রাজনীতির আলাপ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলছেন, "আব্বা আমার আলোচনা শুনে খুশি হলেন। শুধু বললেন, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক সাহেবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যক্তিগত আক্রমণ না করতে।' বঙ্গবন্ধুর মাও এধরনের সাবধান বাণী বঙ্গবন্ধুকে বলেছেন। তবে 'হক সাহেবের বিরুদ্ধে কালো পতাকা দেখাতে' যাওয়ার কথা জেনে এটুকু বলা যেতে পারে যে, লাহোর প্রস্তাবের উত্থাপক শেরে বাংলার রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু সন্তুষ্ট ছিলেন না। অন্যান্য অনেক কিছুর পাশাপাশি শেরে বাংলার রাজনৈতিক দল কৃষক প্রজা পার্টির অস্তিত্বহীনতা শেরে বাংলার রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চিন্তার সঠিকতা প্রমাণ করে। যদিও শেরে বাংলা ফজলুল হক 'গরিবের বন্ধু' একথাও বঙ্গবন্ধু বলেছেন। ২৩ পৃষ্ঠায় বন্ধুর বাড়িতে মুসলমান হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে দেখার কারণে ননীকুমার দাসের ক্ষোভ-এর প্রতি বঙ্গবন্ধুর সহমর্মীতা লক্ষ্য করা যায়। এই পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু বলছেন, 'আমাদের বাড়িতে হিন্দুরা যারা আসত প্রায় সবাই আমাদের শ্রদ্ধা করত। হিন্দুদের কয়েকটা গ্রামও ছিল, যেগুলোর বাসিন্দারা আমাদের বংশের কোনো না কোনো শরিকের প্রজা ছিল।।' হিন্দু মহাজন ও জমিদারদের অত্যাচারে মুসলমানদের অতিষ্ঠ হয়ে ওঠার কথা বলেছেন। এসব সত্ত্বেও কোথাও সামান্যতম সাম্প্রদায়িকতার লেশ বঙ্গবন্ধুর অভিব্যক্তিতে দেখা যায়নি। এ জন্যই তিনি বঙ্গবন্ধু। ৮১ পৃষ্ঠায় ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের 'ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে' তে কোলকাতায় যে সাম্প্রদায়িক হানাহানি হয়েছিল তা থামানের জন্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে মহাত্মা গান্ধীর জনসভায় যেয়ে হিন্দু মুসলিম সব ধর্মাবলম্বী লোকরা মহাত্মার সম্মোহনী ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েছিলেন তা দেখে বঙ্গবন্ধু মহাত্মা গান্ধীর প্রতি শ্রদ্ধাভাব ব্যক্ত করেছেন। সর্বোপরি ১৮৭-১৮৮ এবং ১৯১-১৯২ পৃষ্ঠায় ফরিদপুরের চন্দ্রনাথ বোস এবং ফনি ভূষণ মজুমদার-এর সঙ্গে একত্রে ফরিদপুর জেলে অন্তরীণ ছিলেন। এর এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বলছেন, 'আমি মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিষ্টান বলে কিছু নেই। সবাই মানুষ।" এই মানুষের জন্যই বঙ্গবন্ধু আজীবন লড়াই সংগ্রাম করেছেন, অত্যাচার সহ্য করেছেন, মৃতু্যর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন। এসব কিছু করে তিনি 'ক্ষমতা সম্পর্ক' বাঙালিদের পক্ষে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন করার পর তিনি দেশের সব মানুষকে মুক্তির স্বাদ দেয়া তথা 'ক্ষমতা সম্পর্ক'-এ দেশের সব মানুষকে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে কর্মসূচি দিয়েছিলেন। ফলে, 'ক্ষমতা সম্পর্ক' স্থায়ীভাবে নিজেদের কুক্ষিগত করে যারা রাখতে চায় একাত্তরের সেই পরাজিত শক্তি এবং লোভী স্বার্থবাদীগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। এভাবে বঙ্গবন্ধুর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'র মতো তার 'কর্মসূচি'ও অসমাপ্ত। সমগ্র বাঙালি জাতি এখন তাই বঙ্গবন্ধুর কর্মসূচি, দু:খী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর লক্ষ্যে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য তার সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার দিকে তাকিয়ে আছে।

অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার গোস্বামী : ইনস্টিটিউশনালাইজেশন অব ডেমোক্রেসি ইন বাংলাদেশ গ্রন্থের লেখক এবং পরিচালক, সাউথ এশিয়ান স্টাডি সার্কেল, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<103276 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1