শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মহামারি মোকাবিলায় পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা আমরা কতটুকু প্রস্তুত?

এখনই সময় নিজে সচেতন হওয়ার এবং অন্যকে সচেতন করার। তাই আসুন পৃথিবী নামক এই আবাসভূমিকে শাসন বা শোষণ করার মনোভাব থেকে বেরিয়ে এসে প্রকৃতিনির্ভর একটি যত্নশীল পৃথিবীর জন্য সবাই মিলে একযোগে কাজ করি, যেখানে মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যে থাকবে না কোনো বৈরিতা, নিশ্চিত হবে এক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক।
এস এম খালিদ হোসেন
  ২৪ জুন ২০২০, ০০:০০

বিশ্ব মহামারির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যুগে যুগে ভাইরাস ভিন্ন ভিন্ন নামে ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়ে মানবসভ্যতায় সময়ে সময়ে চরম আঘাত করেছে। ঘটিয়েছে রাশিয়ান ফ্লু, স্প্যানিস ফ্লু, কলেরা, এইডস ও পেস্নগের মতো মারাত্মক সব মহামারি। প্রাণ কেড়ে নিয়েছে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের। বিপর্যস্ত হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন জনপদগুলো। কালের ব্যবধানে তা আবার হারিয়েও গেছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় কেন এই মহামারিগুলো একের পর এক আবির্ভূত হচ্ছে পৃথিবীতে। এগুলো প্রকৃতির প্রতি আমাদের অবিচারের প্রতিশোধ নয় তো? সত্যিই ভেবে দেখার বিষয়।

প্রকৃতি আমাদের জন্য ধরণিতে অনেক নিয়ামত দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমরা প্রকৃতির নিয়ামতগুলো ভোগ করছি অবিরতভাবে। প্রকৃতি তার আলো-বাতাস, নদী-নালা, খাল-বিল, পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গল আমাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য অকৃত্রিমভাবে উজাড় করে দিয়েছে। কিন্তু এই আমরাই আবার অকৃতজ্ঞের মতো নির্বিচারে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ ধ্বংস করছি। হিংস্র হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ছি প্রকৃতির ওপর নিজেদের ভোগ-বিলাস মত্ত করার নেশা থেকে। আমরা একবারও ভেবে দেখছি না যে, প্রকৃতির ক্ষতি করলে প্রকৃতি হয়তো চুপচাপ বসে নাও থাকতে পারে। প্রতিশোধ নেওয়া শুরু করে দিতে পারে আমাদের মানবসভ্যতার ওপর। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা ইঙ্গিত দিয়ে আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করছেন, কোভিড-১৯ হয়তো প্রকৃতির নেওয়া এক প্রতিশোধ।

ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দ্য কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন), ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার বিশেষজ্ঞ ড. ক্রিস্টিন জনসন এবং অন্যান্য পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, শিকার এবং বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে পশু-পাখির সঙ্গে মানুষের ঘনিষ্ঠ সাহচর্য এবং তাদের আবাসস্থল ধ্বংস নিত্য-নতুন রোগ সৃষ্টির সম্ভাবনাকে অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে, দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকাতেও উলেস্নখ করা হয়েছে, সব সংক্রামক রোগের প্রায় ৭৫ ভাগ আসে পশু-পাখিজাতীয় প্রাণী থেকে। ইঞ্জার অ্যান্ডারসন বলেন, করোনাভাইরাস মহামারি ও জলবায়ু সংকট আমাদের একটি সতর্কবার্তা দিচ্ছে। আর এই সতর্কবার্তা আমাদের নিজেদের প্রতি যত্নবান হওয়ার জন্য নয় বরং পৃথিবী নামক গ্রহের প্রতি যত্নবান হওয়ার কথা বলছে। অ্যান্ডারসনের বক্তব্যকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করলে এটা বলা যায়, একটি সংক্রামক রোগ বা মহামারির সময়ে প্রতিষেধক বা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার চেয়ে আগ থেকেই মহামারি সৃষ্টির সম্ভাব্য মূল উৎসগুলোকে বা কারণগুলোকে যথাসম্ভব চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করাটাই প্রকৃত বুদ্ধিমানের পরিচায়ক।

অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, ক্রমাগত বনাঞ্চল হ্রাস প্রভৃতি বিষয় বৈশ্বিক জলবায়ুর ওপর এক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে যা আমাদের তথা পুরো পৃথিবীর জন্য হুমকিস্বরূপ। কারণ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো দীর্ঘমেয়াদে ধীরে ধীরে পরিবেশের ওপর পড়তে থাকে যা আস্তে আস্তে মারাত্মক প্রকৃতিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে। তাই প্রকৃতিতে থাকা সব উদ্ভিদ এবং প্রাণিকুলকে নিজ নিজ আবাসস্থলে বেড়ে ওঠার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার মাধ্যমে পৃথিবী নামক গ্রহের প্রতি যত্নবান হওয়ার বিকল্প কোনো পথ খোলা নেই বলে পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, সামাজিক এবং পরিবেশগত ঝুঁকির কারণগুলোকে হ্রাস করা গেলে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে অসুস্থতা, মৃতু্যহার এবং অর্থনৈতিক ব্যয় মোট ক্ষতির এক-তৃতীয়াংশ কমানো সম্ভব হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও এটা সত্যি যে, ভয়াবহ পরিবেশ দূষণের কবলে পড়ে আজ বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ শঙ্কায় ধুঁকছে। বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণের চিত্রটা আরও ভয়াবহ। আমাদের বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে পরিবেশ দূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে এখনো পর্যন্ত কোনো ধারণা সৃষ্টি হয়নি।.

ভাওয়ালের বনসহ দেশের অজস্র বন উজাড় করে কারখানা তৈরি করা হচ্ছে। গণদাবি উপেক্ষা করে রামপাল কয়লা বিদু্যৎকেন্দ্র তৈরির মাধ্যমে প্রকৃতির প্রাচীর সুন্দরবনকে হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। অথচ এই সুন্দরবনই বারবার সামুদ্রিক ঝড়-জলোচ্ছ্বাস মোকাবিলায় বুক চিতিয়ে আমাদের রক্ষা করছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ করতে গিয়ে উজাড় করে ফেলা হচ্ছে ফসলের জমি, মাঠের পর মাঠ। শিল্প-কারখানার কালো ধোঁয়া দিয়ে বিষাক্ত করা হচ্ছে বাতাসকে। মানুষ হারিয়ে ফেলছে স্বস্তিতে নিশ্বাস নেওয়ার অধিকারটুকু। যে জীববৈচিত্র্য ও প্রকৃতি আমাদের জন্য, সেই প্রকৃতিকেই নির্বিচারে ধ্বংস করা হচ্ছে। বিলীন করা হচ্ছে তাদের আবাসভূমি। এদিকে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে দ্রম্নত গলে যাচ্ছে বরফ। বঙ্গোপসাগরের পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাগরে তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে সাগর তীরবর্তী অঞ্চলগুলো। শিল্পায়নের কারণে বাতাসে কার্বনের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রকৃতি অত্যাচারিত হতে হতে আজ মনে হয় নিজেই প্রতিবাদ ও প্রতিশোধ নিতে শুরু করে দিয়েছে।

পরিশেষে বলতে চাই, সমগ্র বিশ্বের উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিশ্চিত করতে শুধু প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধনই নয়; বরং প্রয়োজন পরিবেশ এবং সামাজিক ক্ষেত্রের ঝুঁকিগুলোকে হ্রাস করার ক্ষেত্রে কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন। মনে রাখতে হবে, পরিবেশ ভালো থাকলে ভালো থাকবে এই পৃথিবীটা। বড় মাপের উদ্যোগ বা ব্যক্তিগত পর্যায়ে ছোট ছোট পরিবর্তন উভয়ই দরকার সুস্থ পরিবেশ গড়ার জন্য।

এখনই সময় নিজে সচেতন হওয়ার এবং অন্যকে সচেতন করার। তাই আসুন পৃথিবী নামক এই আবাসভূমিকে শাসন বা শোষণ করার মনোভাব থেকে বেরিয়ে এসে প্রকৃতিনির্ভর একটি যত্নশীল পৃথিবীর জন্য সবাই মিলে একযোগে কাজ করি, যেখানে মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যে থাকবে না কোনো বৈরিতা, নিশ্চিত হবে এক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক।

এস এম খালিদ হোসেন : শিক্ষক ও গবেষক, আর্মি আইবিএ সাভার (বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস)

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<103485 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1