পাঠক মত

এরপর কে?

প্রকাশ | ২৪ জুন ২০২০, ০০:০০

ইকবাল হাসান শিক্ষার্থী, কুমিলস্না বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশে ধর্ষণ ব্যাধির আকার ধারণ করেছে। দিনে দিনে এর উৎপাত বেড়েই চলছে। ধর্ষণ যে কারও জীবনই তছনছ করে দিতে পারে। অনেকে ধর্ষণপরবর্তী সময়ে মানসিক যন্ত্রণায় আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। কঠোর আইন, প্রচার প্রচারণা ও উচ্চ আদালতের নানা ধরনের নির্দেশনার পরও নারীর প্রতি সহিংসতা কমানো যাচ্ছে না? মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন? ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭৩২ জন?অর্থাৎ, ২০১৮ সালের তুলনায় এই বছর ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে দ্বিগুণ যা ভয়াবহ বলে উলেস্নখ করেছে সংস্থাটি ২০১৭ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮১৮ জন নারী। এদিকে ২০১৯ সালে ধর্ষণের পরে হত্যা করা হয়েছে ৭৬ জনকে। আর আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১০ জন নারী্‌ নারীর প্রতি সহিংসতার অন্য চিত্রগুলোও ভয়াবহ। ২০১৯ সালে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ২৫৮ জন নারী। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৭০ জন। ২০১৯ যৌন হয়রানির শিকার ১৮ জন নারী আত্মহত্যা করেছেন। প্রতিবাদ করতে গিয়ে চারজন নারীসহ ১৭ জন হত্যার শিকার হয়েছেন। এরকম আরও বহু পরিসংখ্যানে মত ভারী হয়ে আছে অনেকের হৃদয়। কেউ তার বোন, কেউ তার স্ত্রী কেউবা তার মা হারিয়েছে। প্রতি বছর পালস্না দিয়ে ধর্ষণ বাড়ছে। একটা সময় বাংলাদেশে ইভ টিজিংয়ের ঘটনা অহরহ ঘটত। পরে সেটা আর বিস্তৃত আকারে রূপ নিয়েছে ধর্ষণসহ আরও অন্যান্য অপরাধে। আগেও ধর্ষণের ঘটনা ঘটত কিন্তু তা ততটা প্রকট আকার ধারণ করেনি যতটা বর্তমানে হয়েছে। আমাদের কি পূর্ণিমার কথা মনে আছে? যে ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার শিকার হয়েছিল সিরাজগঞ্জের উলস্নাপাড়ায়। তখন পূর্ণিমা ছিলেন ১৪ বছরের কিশোরী। ২০০১ সালে বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জে ১৪ বছর বয়সে গণধর্ষণের শিকার পূর্ণিমা শীলের খবর বাংলাদেশে শিরোনাম হয়েছিল। পূর্ণিমা রানীর ওপর অত্যাচার নিয়ে সে সময় গণমাধ্যমগুলোতে একের পর এক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। এখনো তার মায়ের আর্তনাদ কারও কারও কানে বেজে ওঠে। সে পূর্ণিমার চাকরি হয়েছে। তারানা হালিম তাকে পার্সোনাল অফিসার নিয়োগ দিয়েছে। সে এখন স্বাবলম্বী। আর মুখ ঢেকে চলে না নতুন উদ্যোমে সে অসহায় ও পিছিয়ে পড়া নারীদের সহায়তা করতে চায়। আমাদের তনুর কথা মনে আছে? কুমিলস্নার ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনু। যার হত্যাকান্ডের চার বছর পূর্ণ হলেও তার হত্যার বিচারের ব্যবস্থা হয়নি। ২০১৬ সালের ২০ মার্চ রাতে তনুর লাশ কুমিলস্নার ময়নামতি সেনানিবাসের পাওয়ার হাউসের অদূরে একটি ঝোপ থেকে উদ্ধার করা হয়। তার লাশ সুন্দর করে গোছল দিয়ে কবর দেওয়া হয়। তার হত্যার বিচারও যে মাটিচাপা থাকবে তা কাম্য নয়। হীরা মণির কথা নিশ্চয়ই মনে আছে! বেশিদিন হয়নি এই ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার। হীরা মণি হারুনুর রশিদের মেয়ে। ক্যান্সারে আক্রান্ত বাবাকে নিয়ে তার মা ও ছোট দুই ভাইবোন ঢাকায় হাসপাতালে ছিলেন। ১২ জুন দুপুরে লক্ষ্ণীপুর সদর উপজেলার দক্ষিণ হামছাদী ইউনিয়নের পশ্চিম গোপীনাথপুর গ্রামে নবম শ্রেণির ছাত্রী হীরা মণিকে ঘরে একা পেয়ে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। প্রতিনিয়ত এরকম ঘটনা আরও ঘটছে। কিছুটা চোখের সামনে আসছে কিছুটা রয়ে যাচ্ছে অন্তরালে। বর্তমান সময়ে করোনার উৎপাতে মানুষের জীবন বিপর্যস্ত আর করোনার সঙ্গে ধর্ষণ রোগে বহু আগে থেকেই নারীর জীবন বিপর্যস্ত। প্রতিদিন পত্রিকা খুললেই দেখা যায় এরকম ঘটনা। কিছুদিন আলাপ-আলোচনা করে আবার সেই আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। ভিকটিমের মা-বাবা, ভাইয়ের চোখের পানিও শুকিয়ে যায়। তারা হয়তো আর কাঁদে না আমরাও আর কথা বলি না। এই নিষ্ঠুর ব্যবস্থা মনে হয় একটা কৌতুকের মতো। যে কৌতুকে এক লোক ম্যানহোলের ঢাকনার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চলিস্নশ, চলিস্নশ চিৎকার করছে! সেই শুনে এক লোক এগিয়ে জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে? চলিস্নশ বলে চিৎকার করতে থাকা লোকটি কিছু না বলে চিৎকার করতেই থাকল। জানতে চাওয়া লোকটি সামনে এগোতেই ধাক্কা দিয়ে একচলিস্নশ, একচলিস্নশ বলে চিৎকার করা শুরু করল লোকটি। এই পাগলের কর্মকান্ডে আমরা হয়তো হেঁসে পেটব্যথা করেছি কিন্তু এই নির্মম কৌতুক হচ্ছে নারীদের সঙ্গে। একটার পর একটা ধর্ষণ, নিপীড়নের ঘটনা হয়েই যাচ্ছে কিন্তু আমাদের দুর্বল বিচারব্যবস্থা শুধু গুনেই যাচ্ছে ধর্ষিতার সংখ্যা। বিচারহীনতার সংস্কৃতিই শুধু দায়ী নয়- তার সঙ্গে দায়ী আমাদের নিজের সংস্কৃতি হটিয়ে পশ্চিমা সংস্কৃতির আমদানিও। অশ্লীলতার সহজলভ্যতা, কুরুচিপূর্ণ চলচ্চিত্র এবং পর্ন আসক্তি দায়ী ধর্ষণের পিছনে। শুধু মৃতু্যদন্ড দিয়ে এরকম সমস্যার প্রতিকার পাওয়া যাবে না। সুষ্ঠু বিচারের সঙ্গে চাই সঠিক পারিবারিক শিক্ষা, ধর্মীয় শিক্ষা, এবং সুন্দর রুচিবোধ তৈরি করতে পারে এরকম শিক্ষাব্যবস্থা। সঠিক, সুষ্ঠু পরিবেশ না পেলে কিংবা সুষ্ঠু বিচার না পেলে পূর্ণিমা, তনু, হীরা মণি চলতেই থাকবে... আমরা চাই না পুনরায় জিজ্ঞেস করতে; এরপর কে? আমরা চাই একটু সুষ্ঠু সমাজ, একটি সুন্দর রাষ্ট্র যেখানে নারী-পুরুষ তার যোগ্যতা নিয়ে এগিয়ে যাবে, আমরা চাই খুন, গুম, ধর্ষণমুক্ত সমাজ। আজ হীরা মণি কাল হয়তো আপনার বোন, আমার বোন। তাই আসুন সচেতন হই, সোচ্চার হই তবেই আমরা এড়াতে পারব এরকম হীন ঘটনা।