শান্তিতে ঘুমাও কামাল লোহানী

বাল্যকাল থেকে বামপন্থি মতবাদের দীক্ষিত কামাল লোহানী ঢাকায় একটি সংগঠনের নাচের শিক্ষা নেন- হন সাময়িকভাবে অভিনয় শিল্পীও। অতঃপর তার হাতে গড়া সাংস্কৃতিক সংগঠন 'ক্রান্তি' বেশ কিছুকাল ধরে পরিচালনা করেন। ক্রান্তিও ছিল অনেকটা মাওবাদ সমর্থক। এলো একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধ। লোহানী চলে গেলেন কলকাতায়। সেখানে স্বাধীন বাংলা বেতারের বার্তা সম্পাদক নিযুক্ত হন।

প্রকাশ | ২৫ জুন ২০২০, ০০:০০

রণেশ মৈত্র
শরীরটা খারাপ ছিল। শুয়ে ছিলাম। ঘুমিয়েও পড়েছিলাম। তাই কামাল লোহানী তার ভালোবাসা পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার এক ঘণ্টা পরে নানা চ্যানেলে (টেলিভিশনের) ও ফেসবুকে মর্মান্তিক খবর। গভীর মর্মবেদনা আমার বাকি জীবনটুকু তাড়িয়ে বেড়াবে। লোহানী বলে ডাকতাম- সেই ছোটবেলা থেকে। ১৯৫০ সালের কথা, জনাকয়েক পাবনার তরুণ মিলে 'শিখাসংঘ' নামক বাম প্রগতিশীল চেতনাসমৃদ্ধ একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তুলেছিলাম। তখন পাকিস্তান সবে জন্ম নিয়েছে। প্রয়াত বন্ধু আবদুল মতিন, কামাল লোহানী এবং আরও বেশকিছু সমমনা তরুণ মিলে যেন শ্বাসরোধ করা পাকিস্তানি পরিবেশ পাল্টাতে চেতন-অবচেতনভাবে মার্কসীয় সমাজতান্ত্রিক-সাম্যবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ সমাজ পাল্টানোর নানামুখী কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। পেছন ফিরে দেখি সেই অসাধারণ দিনগুলোকে। বায়ান্নর মিছিলে পাবনার রাস্তায় সবাই মিলে শহরে নেমেছিলাম। লোহানী ছিলেন জেলার স্কুলের ছাত্র। শিখাসংঘের নেতাকর্মীরা মিলে মুসলিম ছাত্রলীগের নেতারাসহ সেদিন আমরা পাবনার সব স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীকে ক্লাস বর্জন করিয়ে মিছিলে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে সমবেত করতে সফল হয়েছিলাম। গভীর উত্তেজনায় ভরা সে মিছিল। স্স্নোগানে স্স্নোগানে উচ্চকিত পাবনার পিচঢালা কালো রাজপথ-পাবনার সমগ্র জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে সে মিছিল। ইতিহাসের বাঁক ঘোরানো এই মিছিলকে বাধাগ্রস্ত করেছিল সেদিনের পুলিশ। সে বাধা মানিনি কেউ বরং আরও দৃপ্ত পদক্ষেপে অধিকতর উচ্চকিত স্স্নোগানে পাবনাকে কাঁপিয়েছিলাম। স্স্নোগান লিড করতে হতো মতি, লোহানী ও আমাকে। প্রচারেও থাকতে হতো আমাদেরই টিনের চোঙা হাতে। আজ আর সেদিনগুলো নেই সঙ্গত কারণেই। কিন্তু স্মৃতি আছে আনন্দময় স্মৃতি-দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের কাজে জীবন-মরণ পণ করা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার স্মৃতি। ১৯৫২ সালের নভেম্বরে আমরা মতিনের বাসায় তার বাবা মুসলিম লীগ নেতা বেলায়েত হোসেন মোক্তারের চেম্বারে বসে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের পাবনা জেলা সাংগঠনিক কমিটি গঠন করি। আমাকে সভাপতির এবং মতিনকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কী প্রবল উদ্দীপনা আজ অনেকটাই অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। এলো ১৯৫৩ সাল। আমি গোপাল চন্দ্র ইন্সটিটিউশনের ছাত্র হিসেবে ১৯৫০ সালে ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের প্রথম ব্যাচে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে পারিবারিক অর্থ সংকটের কারণে কলেজে ভর্তি না হয়ে এডরুক ল্যাবরেটরি নামক ওষুধ প্রস্তুত কারখানায় অফিস সুপারিন্ডেন্ট হিসেবে চাকরি নেই। কামাল লোহানী জেলা স্কুল থেকে, আবদুল মতিন পাবনা গোপাল চন্দ্র ইন্সটিটিউশন থেকে (আমিও জিসি ইন্সটিটিউশনের ছাত্র ছিলাম) ১৯৫২ সালে ম্যাট্রিক পাস করে এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হয়। আমিও ভর্তি হলাম চাকরিতে ইতি দিয়ে। এবারে ছাত্র ইউনিয়নের শাখা-প্রশাখা জেলাব্যাপী (তখন সিরাজগঞ্জ ছিল পাবনা জেলার অন্তর্গত একমাত্র মহকুমা) ছড়ালো ও সংগঠনকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার পালা। মাস কয়েকের মধ্যেই ছাত্র ইউনিয়নকে আমরা সবাই মিলে পাবনা জেলার বৃহত্তম ছাত্র সংগঠন হিসেবে দাঁড় করাতে সক্ষম হই। এলো এডওয়ার্ড কলেজ ছাত্র সংসদের ৫৩-৫৪ শিক্ষাবর্ষের নির্বাচন। ছাত্র ইউনিয়নের মনোনয়নে আমরা ভিপিজেএসসহ গোটা ক্যাবিনেট (মাত্র একজন বাদে) বিপুল ভোটাধিক্যে জয়লাভ করি। তখন পর্যন্ত এডওয়ার্ড কলেজে মুসলিম ছাত্রলীগ ছিল শক্তিশালী অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্র সংগঠন। ১৯৫৩ সালের জুলাইয়ে পাবনা জেলা ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম জেলা সম্মেলন। কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে এলেন ভাষা-মতিন নামে খ্যাত আবদুল মতিন। গাজীউল হক, সহ-সম্পাদাক আবদুস সাত্তার ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইলিয়াস। পাবনা টাউন হলে অনুষ্ঠিত দুদিনব্যাপী সম্মেলন, কাউন্সিল অধিবেশন, গণসংগীতের আসর। তার আগে নবনির্বাচিত কমিটির পরিস্থিতি এবং গণসংগীতের আসর প্রচন্ড আলোড়ন তুলেছিল পাবনায়। ১৯৫৪-তে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন। ছাত্র ইউনিয়ন ছাত্রলীগ মিলে যৌথভাবে ছাত্রকর্মী শিবির পড়ে সবাই নির্বাচনী প্রচারণায় নেমে পড়ি। ৪ ফেব্রম্নয়ারি আমার বাবা মারা যান। নির্বাচনী এলাকা থেকে ফিরে এসে ১১ দিনে অশৌচ পালন করে আবার নির্বাচনী এলাকা সুজানগর ফিরে যেতে চাইলে রাজনৈতিক নেতৃত্ব বাধা দেয়। লোহানী আগে থেকেই পাবনায় ছিলেন। নেতাদের অভিমত অনুযায়ী সেবার অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ রেখে পাবনায় একুশে ফেব্রম্নয়ারি উদযাপনের দিনব্যাপী ব্যাপক কর্মসূচি নেওয়া হয়। সেদিন বিশাল জনসমাবেশে পাবনা টাউন হলে মুসলিম লীগের ভোটে পরাজিত করে যুক্তফ্রন্টের সব প্রার্থীকে বিজয়ী করার আহ্বান জানানো হয়। ২২ ফেব্রম্নয়ারি ভোর ৪টা থেকে অজস্র পুলিশ এসে বাড়ি ঘেরাও করে ফেলে। সকালে গ্রেপ্তার। থানায় যাওয়ার পরপরই গ্রেপ্তার হয়ে এলেন কামাল লোহানী এবং আরও অনেকে। জেল খানায় বাস করতে হয় এক মাস। নির্বাচনী ফলাফল বেরোচ্ছিল প্রতি সন্ধ্যায়। খবর পাওয়া যাচ্ছিল মুসলিম লীগ প্রার্থীদের পরাজয়ের। কারাবাসের ঠিক ৩০ দিনের দিন নূরুল আমিনের পরাজয়ের খবর বেতারে প্রচারের সঙ্গে সঙ্গেই পাবনা শহরের আনন্দের জোয়ার বইতে শুরু করে- সন্ধ্যায়ই বেরোয় বিজয় মিছিল। পর দিনই আমরা মুক্তিলাভ করি জেল গেটে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাজার হাজার লোকের সমাগম। মেইন গেট দিয়ে বেরোতেই মানুষের কাঁধে কাঁধে হলো আমাদের (ছাত্রনেতাদের স্থান) পরে এলো বিপুলসংখ্যক মালা। কারামুক্তদের মাল্যভূষিত করে আবার মিছিল করে যুক্তফ্রন্ট অফিসে চায়ের আয়োজন- অতঃপর বাসায় প্রত্যাবর্তন। গঠিত হলো শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট সরকার। ৫৮ দিনের মাথায় ওই সরকারকে করাচির কেন্দ্রীয় সরকার বাতিল ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে আবার সবাই গ্রেপ্তার হই। রাজশাহীর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে পাবনায় আটকের ১৭ মাস পরে লোহানীসহ আমরা মুক্তি পেয়ে চলে যাই রাজশাহী জেলা ছাত্র ইউনিয়ন কার্যালয়ে। দ্রম্নতই ছাত্র ইউনিয়ন ভুবন মোহন পার্কে আয়োজিত বিশাল গণসংবর্ধনা শেষে ছাত্র ইউনিয়ন কার্যালয়ে সংক্ষিপ্ত নৈশভোজ শেষে রাহের ট্রেনে ঈশ্বরদী এসে বাসে পাবনা। সেটা ১৯৫৫ সাল। লোহানী ভালোবাসতেন এডওয়ার্ড কলেজে আমাদের সহপাঠী দীপ্তিকে। পরিবারের আপত্তি অগ্রাহ্য করে তারা বিবাহপর্ব অনাড়ম্বরভাবে শেষ করে উভয়ে ঢাকা চলে যান। কামাল লোহানী যোগ দেন দৈনিক মিলস্নাতে। অতঃপর সংবাদে। তারপর রাজশাহীর দৈনিক বার্তা প্রভৃতি। বাল্যকাল থেকে বামপন্থি মতবাদের দীক্ষিত কামাল লোহানী ঢাকায় একটি সংগঠনের নাচের শিক্ষা নেন- হন সাময়িকভাবে অভিনয় শিল্পীও। অতঃপর তার হাতে গড়া সাংস্কৃতিক সংগঠন 'ক্রান্তি' বেশ কিছুকাল ধরে পরিচালনা করেন। ক্রান্তিও ছিল অনেকটা মাওবাদ সমর্থক। এলো একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধ। লোহানী চলে গেলেন কলকাতায়। সেখানে স্বাধীন বাংলা বেতারের বার্তা সম্পাদক নিযুক্ত হন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে এসে ১০ জানুয়ারি-৭২ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে অন্যতম ধারা বিবরণী পাঠ করেন- যা বেতারে সরাসরি প্রচারিত হয়। অতঃপর গড়ে তোলেন বামধারার সাংস্কৃতিক সংগঠন গণশিল্পী সংস্থা। অল্প কয়েক বছর আগে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করেন। দুই দফায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ডিরেক্টর জেনারেল পদের দায়িত্ব পালন করেন। বছর কয়েক আগে দৃপ্ত লোহানী মারা যান। মার্কসীয় মতবাদে বিশ্বাসী হলেও তিনি কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দেননি। নিখাদ অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক বাহাত্তরের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী দেখে ক্ষুব্ধ হন। সেদিন আমরা যারা বিপস্নবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নতুন ধারায় বন্ধুত্ববন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলাম- লোহানী আর আমি বেঁচে ছিলাম। বাকিরা হারিয়ে গেছেন অনেক আগেই। সেদিন গেলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামন। আর আজ ২০ জুন কামাল লোহানীও সবাইকে ছেড়ে পরপারে স্থান করে নিলেন। হয়ে পড়েছি নিঃসঙ্গ-অতীতের সব বিপস্নবী বন্ধুকে হারিয়ে। বিদায় লোহানী। স্যালিউট। মনে রাখবো তোমাকে আমৃতু্য রণেশ মৈত্র : সাংবাদিক, রাজনীতিক ও কলাম লেখক