সংস্কৃতি বাজেট: উপেক্ষার শেষ কোথায়?

প্রায় সব মন্ত্রণালয়ের উপজেলা পর্যায়ে কর্মকর্তা থাকলেও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কোনো প্রতিনিধি নেই। বিগত ৪ বছর ধরে উপজেলা শিল্পকলা অফিসার নিয়োগের ফাইল আটকে আছে। সেখানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সভাপতি করে তার নেতৃত্বে ৫ সদস্যের একটা কমিটি করা আছে। যাদের বছরে ৫০ হাজার টাকা পাঠানো হয় এবং তাদের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বিভিন্ন সভা-সামবেশে সংস্কৃতিকে এগিয়ে নেওয়ার কথা বললেও এই হচ্ছে তার নমুনা।

প্রকাশ | ২৫ জুন ২০২০, ০০:০০

অমিত রঞ্জন দে
অনেকের কাছে সংস্কৃতি মানে 'গীত-বাদ্য-নৃত্য-অভিনয়-চারুশিল্পের মতো নন্দনকলা'- যা কেবল মানুষের মনোরঞ্জন করবে, আনন্দ দেবে। সুতরাং দেশের এই ক্রান্তিকালে এ খাতে বাজেটে এত বরাদ্দ দেওয়ার কী আছে? এখন কি আনন্দ-বিনোদনের সময়? কিন্তু সংস্কৃতি শুধু গীত-বাদ্য-নৃত্য-অভিনয়-চারুশিল্পের দেওয়ালে আবদ্ধ কোনো স্থবির শক্তি? সংস্কৃতি শুধু মনের বিলাস বা মনের সৃষ্ট সম্পদ? এটি বাস্তব প্রয়োজনে জন্মে, মানুষের জীবনসংগ্রামে শক্তি জোগায় এবং জীবনযাত্রার বাস্তব উদ্দেশ্য স্থির করে। এটা সামাজিক সক্রিয়তার একটি ক্ষেত্রও বটে। মানুষকে মানুষের মতো বেঁচে থাকার ও প্রতিনিয়ত বিকশিত হয়ে ওঠার বড় হাতিয়ার সংস্কৃতি। সংস্কৃতির পরিবর্তন না ঘটলে কোনো ক্ষেত্রেই সে রকম কিছু ঘটতে পারে না। পরিবর্তন হলো অবিরাম প্রক্রিয়া এবং চিরন্তন ঘটনা। সাংস্কৃতিক সংগ্রাম ছাড়া সমাজ পরিবর্তন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বাংলাদেশের অভু্যদয়ও এরকম এক সাংস্কৃতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত। আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে পদার্পণ করতে যাচ্ছি। এ সময়েও জাতীয় বাজেটের ১ শতাংশও সংস্কৃতি খাতে বরাদ্দ দিতে পারছি না। বরাদ্দ ০.৯ শতাংশ। তাও আবার তথ্য, সংস্কৃতি, ধর্ম, যুব ও ক্রীড়া এই চারটি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে গঠিত 'বিনোদন, সংস্কৃতি ও ধর্ম' খাতে। যেখানে টাকার অংকে মোট বরাদ্দ ৪,৭৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের জন্য ১,৬৯৩ কোটি, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের জন্য ১,৪৭৮ কোটি, তথ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য ১,০৪০ কোটি এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে মাত্র ৫৭৯ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটের মন্ত্রণালয়ভিত্তিক আকারের দিকে তাকালেও সংস্কৃতি খাতকে কতটুকু গুরুত্ব দেয়া হয়েছে তা সহজেই অনুমেয়। চারটি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ সবচেয়ে কম এবং তা আসলে মোট বাজেটের ০.১০ শতাংশ। বলা হয়ে থাকে, 'একটা জাতি কতটা উন্নত, সেটা বোঝা যায় সে জাতির সংস্কৃতির মান কতটা উন্নত- তা থেকে।' যে দেশে ১৭ কোটি মানুষের বাস সে দেশে উন্নত সংস্কৃতি বিনির্মাণের বাজেট ৫৭৯ কোটি টাকা। যার মধ্যে ৩৫৮ কোটি টাকা পরিচালন ব্যয় এবং মাত্র ২২১ কোটি টাকা উন্নয়ন ব্যয়। এই ২২১ কোটি টাকায় সাংস্কৃতিক সক্রিয়তার কি নিদর্শন তৈরি করা সম্ভব? যখন করোনাভাইরাসের মহামারিতে সারাদেশের মানুষের মধ্যে বিরাজ করছে চরম হতাশা। এরই মধ্যে ঘূর্ণিঝড় 'আম্ফান' দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের মনে আরেক ক্ষত সৃষ্টি করেছে। করোনা-আম্ফান শুধু অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক বা রাজনৈতিক কর্মকান্ডের ওপর আঘাত হেনেছে তা নয়, থেমে গেছে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডও। মধ্য মার্চ থেকে বাংলাদেশে শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা হয় এমন মিলনায়তনসমূহ বন্ধ। উন্মুক্তস্থানে কোনো অনুষ্ঠান হচ্ছে না। এমন কি সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহের অভ্যন্তরে যে ঘরোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়ে থাকে সেগুলোও এখন বন্ধ। চলচিত্র শিল্প বন্ধ, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে যে নাটক, নৃত্য, গান বা অন্যান্য অনুষ্ঠান রেকর্ডিং হয় সেটিও বন্ধ। চারুশিল্পীরা কাজ করতে পারছেন না, যাত্রাশিল্প, পাপেট শিল্পীদের কার্যক্রম বন্ধ। এই সমস্ত অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে যেসমস্ত শিল্পী-কর্মী বা শিল্পশ্রমিকরা জীবন নির্বাহ করে থাকেন- বিশেষ করে, থিয়েটার কর্মী, নৃত্যশিল্পী, চারুশিল্পী, ঢোলবাদক, যন্ত্রশিল্পী, মেকাপ আর্টিস্ট, সেট নির্মাণকারী, মঞ্চের পোশাক নির্মাতা, লাইট সহকারী, সাউন্ড অপারেটর, ক্যামেরার পেছনে ট্রলি ঠেলা মানুষটি, ফ্রিলাঞ্চিং শিল্পী যারা গানের টিউশনি করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে তারা এক দুর্বিষহ জীবন অতিবাহিত করছেন। কিছু কিছু শিল্পীদের খবর জেনেছি তাদের ঘরে চুলা জ্বলে না। যন্ত্রশিল্পীদের কেউ কেউ ফোন করে বলেছেন, 'কোনো কাজ নেই, হাতে কোনো টাকা নেই, ছেলেমেয়ে, পরিবার-পরিজন নিয়ে কী করে বাঁচি।' গত ঈদকে কেন্দ্র করে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সারাদেশের ৫০০০ শিল্পীকে ৫০০০ টাকা করে প্রদান করার কথা জানিয়েছিল। জানিনা, তারা সবাই সে টাকা এখনো পেয়েছেন কিনা? এই পরিস্থিতি আরো কতদিন প্রলম্বিত হবে আমরা জানি না। আসা যাক শিল্পকলা একাডেমি প্রসঙ্গে। সারাদেশে মোট ৬৪টি জেলা। ঢাকার বাইরে ৬৩ জেলার মধ্যে ৪৪টি জেলায় শিল্পকলা একাডেমির নিজস্ব ভবন আছে, ১৫টি নির্মাণাধীন, বাকি ৪টি জেলায় শিল্পকলা একাডেমির কোনো ভবনই নেই। যার মধ্যে কক্সবাজার, বান্দরবন অন্যতম। যে ৪৪টি জেলায় ভবন আছে তার অধিকাংশই জরাজীর্ণ অবস্থায় আছে, সংস্কার প্রয়োজন। প্রায় ১৫টি জেলাতে সংস্কৃতি কর্মকর্তার পদ শূন্য। অন্যান্য পদ আছে, নিয়োগ নেই। একজনকে একাধিক জেলার দায়িত্ব পালন করতে হয়। কোথাও কোথাও জেলা শিল্পকলা একাডেমির অফিস অন্য দপ্তরের দখলে। যেমন লক্ষ্ণীপুর জেলা শিল্পকলা অফিসে এখনর্ যাবের কার্যালয়। এরপর যদি জানতে চাই সারা বছরের কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য বাৎসরিক কত টাকা বরাদ্দ পায় একটি জেলা শিল্পকলা একডেমি? সর্বসাকুল্যে ৪-৫ লাখ টাকা। যেমন অনুষ্ঠান বাবদ ২ লাখ টাকা, বিদু্যৎ বিলসহ অফিস খরচের জন্য ১ লাখ টাকা এবং গুণিজন সংবর্ধনায় ১ লাখ টাকার মতো বরাদ্দ থাকে। গত বাজেটে মুজিববর্ষ উপলক্ষে অতিরিক্ত আরো ১ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। প্রায় সব মন্ত্রণালয়ের উপজেলা পর্যায়ে কর্মকর্তা থাকলেও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কোনো প্রতিনিধি নেই। বিগত ৪ বছর ধরে উপজেলা শিল্পকলা অফিসার নিয়োগের ফাইল আটকে আছে। সেখানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সভাপতি করে তার নেতৃত্বে ৫ সদস্যের একটা কমিটি করা আছে। যাদের বছরে ৫০ হাজার টাকা পাঠানো হয় এবং তাদের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বিভিন্ন সভা-সামবেশে সংস্কৃতিকে এগিয়ে নেওয়ার কথা বললেও এই হচ্ছে তার নমুনা। একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী, ধর্মান্ধ-মৌলবাদী গোষ্ঠী প্রতিনিয়ত শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তাদের প্ররোচণায় সম্প্রতি সুনামগঞ্জে শাহ আব্দুল করিমের শিষ্য বাউল রণেশ ঠাকুরের মতো একজন নির্ভেজাল মানুষের গান ঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এর আগেও জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, রাজবাড়িতে তাদের বিভিন্নভাবে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ভেঙ্গেচুরে তছনছ করে দিয়েছে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত গানের স্কুল, ভেঙে ফেলা হয় এবং ভেঙে ফেলার হুমকি দেয়া হয় ভাস্কর্যসমূহ। সমাজে এক ধরনের বিকৃত চিন্তা ও মানসিকতার জন্ম নিয়েছে, বৃদ্ধি পাচ্ছে নারীর প্রতি সহিংসতা। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এ ধরনের অন্ধত্ব কাটিয়ে একটি মানবিক মূল্যবোধের জায়গায় পৌঁছানো কি আমাদের কাম্য নয়? এরকম একটা হতশ্রী অবস্থার শ্রী ফেরাতে পারে সংস্কৃতি। কিন্তু সেই সংস্কৃতি খাতে সরকারের বাজেট বরাদ্দ ০.১০ শতাংশ। এই বাজেট নিয়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে অসহায় হয়ে পড়া শিল্পীদের পাশে কীভাবে থাকবে? কীভাবে 'দেশজ সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিকাশ ঘটিয়ে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সমকালীন শিল্প-সাহিত্যের গবেষণা এবং উন্নয়নে কাজ করবে? কিভাবে মানুষের মনোজগতে মানবিকতা, বিজ্ঞানমনস্কতা, কল্যাণমুখী বিশ্বমানস, দেশাত্ববোধ ও প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে ভূমিকা রাখবে? কীভাবে চারিদিকে যে হতাশা বিরাজ করছে তা কাটিয়ে তুলতে মানুষকে উজ্জ্বীবিত করবে? অমিত রঞ্জন দে : সংস্কৃতি কর্মী