শিক্ষার মান, শূন্য পাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বাস্তবতা

শিক্ষার্থীদের বিচার করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। এটি তিন বছর বা পাঁচ বছর পর হঠাৎ একটি দুই বা তিন ঘণ্টার পরীক্ষার মধ্যদিয়ে বিচার করা সবসময়ই যুক্তিযুক্ত হয় না। তারপরও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমাদের এর ওপরই নির্ভর করতে হয়। তবে রাষ্ট্রীয় পরীক্ষা যাই হোক, যেভাবেই হোক একজন প্রকৃত শিক্ষক কিন্তু তার শিক্ষার্থীদের গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তাদের লুক্কায়িত প্রতিভা আবিষ্কার করতে পারেন, যেটি হচ্ছে প্রকৃত মূল্যায়ন।

প্রকাশ | ২৭ জুন ২০২০, ০০:০০

মাছুম বিলস্নাহ
পরীক্ষায় পাস করা মেধা ও প্রকৃত জ্ঞানচর্চার মধ্যে যে আসলেই বড় পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় তার প্রমাণ আমরা দেশে এবং পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই দেখতে পাই, যারা জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত তাদের অনেকেরই একাডেমিক রেকর্ড খুব একটা উজ্জ্বল নয়। তারা জীবনে কিছু করতে চেয়েছিলেন, করতে চেয়েছেন এবং করতে পেরেছেন। বহু মানুষের জন্য এবং দেশের জন্য তারা কিছু একটা করেছেন। কিন্তু যারা প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য ভালো ছাত্র হিসেবে, নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছিলেন তারা শুধু জীবনধারণের জন্য একটু চাকরির ব্যবস্থা করেছেন, চারদিকের মানুষের জন্য খুব বেশি কিছু করতে পারেননি।। এটি থাকবে, আছে। সবাই সবকিছু করবেন না। এটিই নিয়ম। কিন্তু তাই বলে যারা প্রচলিত পদ্ধতিতে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছে তাদের মেধা নেই এটি কি বলা যাবে? আমরা আমাদের দেশসহ বিশ্বের বহু দেশের রাজনীতিবিদদের দিকে তাকালে কি দেখতে পাই? কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া কোনো রাজনীতিবিদদেরই একাডেমিক ট্রাকরেকর্ড নেই, অথচ তারা দেশ পরিচালনা করেন। মন্ত্রণালয়ের সবস্তরের বাঘা বাঘা কর্মকর্তা, পাবলিক সার্ভেন্ট তারই নেতৃত্বে, তারই গাইডেন্সে কাজ করেন। তাই বলে, শ্রেণিকক্ষে নিয়মিত ক্লাস হবে না, বা যারা ক্লাস করবে না তাদের নেতা হিসেবে গণ্য করা হবে আমি সেটি বলছি না। শিক্ষার্থীদের ভেতরকার মেধার খবর জানা এবং সেটি কোনদিকে ধাবিত হতে চায় সেটি জানা হচ্ছে মেধার প্রকৃত মূল্যায়ন। এটি অত্যন্ত কঠিন কাজ। কিন্তু সফল একজন শিক্ষকের সেটি পারা প্রয়োজন। ২০২০ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় সারা দেশে গড় পাসের হার ৮২.৮৭ শতাংশ, যা ২০১৯ সালে ছিল ৮২.২০ শতাংশ। এ বছর মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৯৮ জন, যা গত বছর ছিল ১ লাখ ৫ হাজার ৫৯৪ জন। এত ভালো ফলের পরও ১০৪টি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের কেউ পাস করেনি। এর মধ্যে ছয়টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৪৮টি দাখিল মাদ্রাসা ও ৫০টি ভোকেশনাল স্কুল। এসব প্রতিষ্ঠানে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ৮১৯ জন। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ৪৮টি মাদ্রাসায় একজন পরীক্ষার্থীও পাস করতে পারেনি তার মধ্যে অন্তত নয়টি মাদ্রাসা ছিল যেগুলোর পরীক্ষার্থী ছিল মাত্র একজন করে। অথচ শিক্ষক ছিল ১১ জন। এমপিওভুক্তির জনবল কাঠামো অনুসারে মাধ্যমিক স্তরের প্রতিটি বিদ্যালয় ও মাদ্রাসায় একজন প্রধান শিক্ষক/সুপারসহ মোট ১২ জন শিক্ষক সরকার থেকে এমপিওভুক্ত হয়ে বেতন পেয়ে থাকেন। এর সঙ্গে আরও চারজন কর্মচারীও এমপিওভুক্ত হন। এমপিওভুক্তির নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন,' শতভাগ ফেল করা এসব শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শাও নোটিশ দেওয়া হবে। জবাব সন্তোষজনক না হলে এমপিও বন্ধ থাকবে।' যদি শিক্ষকদের কথায় আসি তাহলে বলা যায়, শিক্ষকরা যদি গল্প করেও বিভিন্ন বিষয়ের তথ্যগুলো শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের জানাতেন তাহলে তো একেবারে ৩৩ না পাওয়ার কথা নয়। প্রতিটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে একটি করে কমিটি থাকে। তাদের দায়িত্ব বা কর্তব্য কি? যখন অর্থের ভাগাভাগির বিষয় থাকে তখন তো বিদ্যালয়ের/মাদ্রাসার আঙিনা তারা ছাড়তে চান না। কিন্তু একটি শিক্ষার্থীও যেখানে পাস করল না সেখানে তাদের তো কোনো কথা শোনা যাচ্ছে না, তাদের কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। তাহলে বেসরকারি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোতে এলাকার তথাকথিত গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে কমিটি গঠন করার প্রয়োজন আছে কী? আমি এবার ফেব্রম্নয়ারি মাসে একটি বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম অতিথি হয়ে। সেখানে দেখলাম এলাকার যত পাতি নেতা আছে সবাই বিদ্যালয়ের স্টেজে, মাঠে, প্রধান শিক্ষকের রুমে। প্রধান শিক্ষককে সবাই নির্দেশ দিচ্ছেন। আমি অবাক হলাম। বারবার হস্তক্ষেপ করে বলেছি, ওনাকে সিদ্ধান্ত নিতে দিন। উনি কার কথা শুনবেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর যে অবস্থা তাতে প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে যাওয়ার পথ সরু হয়ে আসছে। প্রশ্ন হচ্ছে কে দেখবে এসব? আমাদের বেসরকারি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোর কিছু চিত্র দেখা যাক। সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার শহিদ সত্য সমিতি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল মাত্র একজন শিক্ষার্থী। সে ইংরেজিতে ফেল করেছে। উলেস্নখ্য, ওই বিদ্যালয়ে ইংরেজি ও গণিতের কোনো শিক্ষকই নেই। রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার আল হুদা আদর্শ দাখিল মাদ্রাসায় চলতি বছরে ২০ জন দাখিল পরীক্ষার্থী ছিল। তাদের সবাই গণিত, আরবি বা উভয় বিষয়েই ফেল করেছে। প্রতিষ্ঠানটিতে গণিত ও আরবি বিষয়ের কোনো শিক্ষক নেই। এবার মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ৯ হাজার ১০০টি মাদ্রাসা দাখিল পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। গতবার মাদ্রাসাগুলোতে ৮৩ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ পাস করলেও এবার পাস করেছে ৮২ দশমিক ৫১ শতাংশ। অতীতে প্রায় প্রতিবছরই মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের পাসের হার তুলনামূলক অন্য বছরের চেয়ে বেশি ছিল। এটি কীভাবে হয় আমার বোধগম্য নয়। ২০১৫ সালে এই বোর্ডে পাসের হার ছিল ৮৮ দশমিক ২২ শতাংশ। মাদ্রাসাগুলোর প্রতি মাদ্রাসা বোর্ড ও মাদ্রাসা অধিদপ্তরের নজরদারির অভাবে এমনটি হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ঠাকুরগাঁওয়ের গেদুরা ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় দাখিল মাদ্রাস, একই জেলার রাণীশংকৈলের সিএস দাখিল মাদ্রাসা, দিনাজপুরের খানসামার মারগাঁও ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা, জামালপুরের সূর্যনগর বসুন্ধরা আদর্শ মাদ্রাসা, মুক্তাগাছা বিন্যাকুড়ি দাখিল মাদ্রাসা, পটুয়াখালীর বেগম রাবেয়া ইয়াছিন বালিকা দাখিল মাদ্রাসা, নাটোরের শেখরপাড়া দাখিল মাদ্রাসা, বাগাতিপাড়া থেকে মাত্র একজন করে পরীক্ষার্থী দাখিল পরীক্ষায় অংশ নিয়েও অকৃতকার্য হয়েছে। এ ছাড়া ২২ পরীক্ষার্থী অংশ নিয়ে সবাই ফেল করেছে ভোলার দৌলতখানের জয়নগর আদর্শ দাখিল মাদ্রাসা থেকে। একই সংখ্যক পরীক্ষার্থী সবাই ফেল করেছে যশোরের চৌগাছার মাকাপুর দাখিল মাদ্রাসা থেকে। ২০ পরীক্ষার্থী নিয়ে ফেল করেছে রাজশাহী ও রংপুরের আরও দুটি মাদ্রাসা। দুই পরীক্ষার্থীর মধ্যে দুজনই ফেল করেছে চারটি মাদ্রাসায়। আর তিন পরীক্ষার্থী নিয়ে সবাই ফেল করেছে পাঁচটি মাদ্রাসায়। দিনাজপুর জেলার খানসামা উপজেলার চকরামপুর হাই স্কুলটি ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ বিদ্যালয়ের ১১ জন এমপিওভুক্ত শিক্ষক প্রতিমাসে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন-ভাতা পান। এ বছরের এসএসসি পরীক্ষায় দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এ বিদ্যালয় থেকে অংশ নিয়েছিল মাত্র সাতজন শিক্ষার্থী। তাদের সবাই ফেল করেছে। একজন শিক্ষার্থীও পাস না করার ঘটনা নতুন নয়। ২০১৯ সালেও ১০৭টি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের কেউ পাস করতে পারেনি। এবার দেখা গেছে দিনাজপুরের একটি বিদ্যালয়ে মাত্র সাতজন শিক্ষার্থীর কেউই পাস করতে পারেনি, অথচ সেখানে শিক্ষক রয়েছেন ১১ জন। মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের অধীনে সে ৪৮টি মাদ্রাসার একজন পরীক্ষার্থীও পাস করতে পারেনি, তার মধ্যে অন্তত ৯টি মাদ্রাসার পরীক্ষার্থী সংখ্যা ছিল মাত্র একজন করে। বেসরকারি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের এমপিও নীতিমালা ও জনবল কাঠামো ২০১৮-এর ৭ নম্বর ধারায় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, বেতন-ভাতার সরকারি অংশপ্রাপ্তির শর্তাবলি মানতে হবে। সে শর্তাবলিতে বলা হয়েছে, পাবলিক পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীদের নূ্যনতম সংখ্যা প্রতিটি ট্রেড হতে ৩০ জন এবং পাসের নূ্যনতম হার হতে হবে ৭০ শতাংশ। এই শর্ত পূরণ না হলে ২৯ নম্বর ধারা অনুযায়ী এমপিও স্থগিত, কর্তন ও বাতিলকরণ হবে। যে ৪৮টি মাদ্রাসা থেকে একজন পরীক্ষার্থীও দাখিল পরীক্ষায় পাস করতে পারেনি সেগুলোর স্বীকৃতি বাতিল, পাঠদানের অনুমতি স্থগিত এবং ইআইএন নম্বর বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড। প্রাথমিকভাবে মাদ্রাসাগুলোকে শোকজ করা হয়েছে। মাদ্রাসাগুলোকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ডাকযোগে মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডে পাঠাতে বলা হয়েছে। যে ছয়টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ৫০টি কারিগরি বিদ্যালয় থেকে একজনও পাস করেনি সেগুলোর বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বা হচ্ছে তাও দেখার বিষয়। দীর্ঘ সাড়ে নয় বছর অপেক্ষার পর ২০১৯ সালে চার শর্তে ২ হাজার ৭৩০টি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হয়েছে, যদিও কিছু প্রতিষ্ঠান এখনো এমপিওর অর্থ পায়নি। প্রায় নয় হাজার প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য আবেদন করেছিল। নতুন ঘোষিত প্রতিষ্ঠানগুলো বাদে বর্তমানে ২৬ হাজারের কিছু বেশি এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে পাঁচ লক্ষাধিক শিক্ষক ও কর্মচারী কর্মরত। যেসব প্রতিষ্ঠানের কেউ পাস করেনি সেগুলোর তুলনায় অনেক নন-এমপিও প্রতিষ্ঠান এবারও অনেক ভালো ফল করেছে। কাজেই এমপিওভুক্তকরণ বিষয়টি যে সঠিক কারণ মেনে করা হচ্ছে না তাও এখান থেকে বোঝা যায়। যারা ভালো গ্রেড নিয়ে পাস করেছে আমরা কিন্তু তাদের সবার থেকে আশা করতে পারি না, তারা বাংলায় সুন্দর করে কিছু একটা লিখতে পারবে, ইংরেজিতে নিজ সম্পর্কে শুদ্ধ করে দু'চারটি বাক্য লিখতে পারবে, গণিতের ফিগার পরিবর্তন করে দিলে সহজে সমাধানটি করতে পারবে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষায় প্রায় চব্বিশ লাখ গ্র্যাজুয়েট ও মাস্টার্স ডিগ্রিধারী পরীক্ষা দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে লিখিত পরীক্ষায় পাস করেছেন ২.৩ শতাংশ প্রার্থী। আমরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখলাম কিছু কিছু এলাকায় ফল পুরোপুরি নেমে গেছে। কারণ হিসেবে জানলাম, গণিত পরীক্ষার দিন কিংবা ইংরেজি পরীক্ষার দিন ম্যাজিস্ট্রেট এসে কিংবা ইউএনও এসে হঠাৎ করে কড়াকড়ি করায় এই অবস্থা হয়েছে। তার মানে কি? যে ফল আমরা দেখি তা প্রকৃত ফল নয়। আর তা তো প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা থেকেই দেখতে পাচ্ছি। শিক্ষার্থীদের বিচার করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। এটি তিন বছর বা পাঁচ বছর পর হঠাৎ একটি দুই বা তিন ঘণ্টার পরীক্ষার মধ্যদিয়ে বিচার করা সবসময়ই যুক্তিযুক্ত হয় না। তারপরও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমাদের এর ওপরই নির্ভর করতে হয়। তবে রাষ্ট্রীয় পরীক্ষা যাই হোক, যেভাবেই হোক একজন প্রকৃত শিক্ষক কিন্তু তার শিক্ষার্থীদের গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তাদের লুক্কায়িত প্রতিভা আবিষ্কার করতে পারেন, যেটি হচ্ছে প্রকৃত মূল্যায়ন। মাছুম বিলস্নাহ : কলাম লেখক