শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভাড়াটিয়াদের প্রতি মানবিক হোন

একজন শিক্ষার্থীর সারাজীবনের অর্জন তার সনদপত্রগুলো, যা একজন শিক্ষার্থীর কাছে অতি মূল্যবান, আর সেগুলো যখন কোনো বাড়ির মালিক ভাড়া বকেয়া থাকায় ছুড়ে ফেলে দেন তখন অনুভূতিটা কেমন হতে পারে!
ইমরান হুসাইন
  ০৭ জুলাই ২০২০, ০০:০০

গোটা বিশ্ব জুড়ে করোনাভাইরাসের তান্ডবে সব কিছুই এলোমেলোভাবে ধাবিত হচ্ছে। মানুষের জীবন চলছে গতিহীন, অনিয়ম ও অগোছালোভাবে। যেন ছন্দ বা রসকষহীন কাব্যধারা। শুধু তাই নয়, করোনাভাইরাসের প্রভাবে মানুষের জীবনের মোড় নিচ্ছে অন্যদিকে- যা ছিল অপরিকল্পিত এবং অকল্পনীয়। এছাড়াও নানা রকম আতঙ্ক ও হতাশার মধ্যে দিয়ে পার করছে করোনার দিনগুলো। তবে অবস্থান ভেদে সেগুলোর চিত্র ভিন্ন রকম। করোনার এই কঠিন সময়ে কেউ হারাচ্ছেন সব থেকে কাছের মানুষ। কেউ বা কর্মহীন হয়ে পড়ছেন আবার কেউ এমনটা আশঙ্কা করছেন আবার কেউ হারাচ্ছেন তার জীবনের সব থেকে মূল্যবান জিনিসপত্র এবং মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু অতি নির্মমতার সঙ্গে। যা একজন মানুষের কাছে খুবই বেদনাদায়ক।

\হবেকার, ভাগ্যান্বেষী, বিদ্যান্বেষীসহ নানা শ্রেণির মানুষের 'স্বপ্ন গড়ার শহর' 'ঢাকা।' আর এজন্যই দিন দিন এই নগরে মানুষের বাস বাড়ছিল জ্যামিতিক হারে। কিন্তু গত মার্চ মাসের ৮ তারিখে দেশে প্রথম করোনাভাইরাস হানা দেয়ার পর সেই মানুষের স্বপ্ন যেন ভাঙতে শুরু করেছে। গত কয়েক মাসে আয় রোজগার কমে এমনকি কর্মস্থান হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষ। হতদরিদ্ররা হয়ে পড়েছে আরও অসহায়। জীবিকার এমন সংকট দেখা দেয়ায় নানা প্রতিবন্ধকতার; কারণে ঢাকা শহর ছাড়তে শুরু করেছে অনেক মানুষ। এরই মধ্যে ঢাকায় অবস্থানরত সব ভাড়াটিয়ারা পড়েছে চরম বিপাকে। আয়-রোজগারহীন ও নিম্নআয়ের মানুষ এমন সমস্যার শিকার হচ্ছে বেশি। দেশের কর্মসংস্থানের সিংহভাগ রাজধানী ঢাকা কেন্দ্রিক হওয়ায় বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজন কাজের সন্ধানে রাজধানীমুখী হতেন। প্রতিদিনই কর্মসংস্থান বা ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় ঢাকায় আসত মানুষ। এভাবে দেড় হাজার বর্গকিলোমিটারের এ নগরীর বাসিন্দার সংখ্যা দাঁড়িয়ে যায় প্রায় দুই কোটি, যাদের প্রায় ৮০ শতাংশই ভাড়া বাসার বাসিন্দা।

এ ভাড়াটিয়ারা বছরের পর বছর বাসার উচ্চ ভাড়া দিয়ে আসছেন। কিন্তু করোনাভাইরাস পরবর্তী পরিস্থিতি বদলে দিয়েছে বাসাভাড়ার চিত্রও। করোনার কারণে অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছেন। আবার অনেক মানুষের শ্রেণি কাঠামোর পরিবর্তন হয়েছে। নতুন করে অনেক মানুষ হতদরিদ্র হয়েছেন, ফলে আগের ভাড়ার ভার বইতে পারছেন না তারা, ফলে ছেড়ে দিচ্ছেন বাসা। ছেড়ে দিচ্ছেন ঢাকা শহরও। নির্মমতার এই চিত্র যেন ঢাকা শহরেই বেশি। কিন্তু বর্তমান সময়ের পেক্ষাপটে বাসা মালিকদের দেশের অবস্থা সম্পর্কে সব কিছু জানা সত্ত্বেও তাদের ভেতর নেই মানবিকতার বিন্দু মাত্র ছাপ। নিরুপায় হয়ে বাসা ছাড়তে হচ্ছে ভাড়াটিয়াদের, কারো কখনো তাদের জোরপূর্বক বাসা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে আবার কখনো তাদের না জানিয়েই সব মালামাল ছুড়ে ফেলা হচ্ছে বাইরে।

সম্প্রতি ঢাকা শহরে নির্মমতার ও অমানবিকতার

\হকিছু ঘটনা ঘটেছে- যা প্রভাবিত করে অতি কঠোর হ্রদয়ে কেউ কিন্তু বাড়িওয়ালার মনকে মানবিকতার ছোঁয়া লাগেনি সামান্যতম। নিম্নবিত্ত ও স্বল্পআয়ী মানুষের সঙ্গে ঘটে যাওয়া এমন দুইটা চিত্র তুলে ধরছি

(১) বাসাভাড়া দিতে না পারায় এক দিনমজুরকে বাসা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে কেয়ারটেকার। সে বিভিন্ন স্থানে মাটি কাটার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। ১৪ এপ্রিল বাসার কেয়ার টেকার ইনসান আলীর স্ত্রী ভাড়াটিয়া করিমের কাছে ভাড়া চাইতে আসে। আবদুল করিম এ সময় সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে বিষয়টি বিবেচনার জন্য বললে বাড়িওয়ালা ক্ষেপে যান বলে অভিযোগ করেন। পরে বাধ্য হয়ে ভাড়াটিয়া ১ হাজার টাকা বাড়িওয়ালার হাতে তুলে দিলেও তিনি নিতে অপরাগতা প্রকাশ করেন এবং ঘাড় ধাক্কা দিয়ে আবদুল করিমকে বাসা থেকে বের করে দেন।

(২) সঠিক সময়ে ভাড়া দিতে না পারায়, ৩ সন্তানসহ একটি পরিবারকে বাসা থেকে বের করে দেন রাজধানী ঢাকার কাঁঠালবাগানের এক বাড়িওয়ালা। পুলিশের হস্তক্ষেপে রাতভর চেষ্টার পরও পরিবারটির স্থান হয়নি বাসায়। সর্বশেষ বাড্ডায় মায়ের বাসায় ঠাঁই হয় তাদের।

অন্যদিকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এর একটা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত দুই মাসে বেতন হয়নি বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। কিছু প্রতিষ্ঠানে বেতনের অর্ধেক দিলেও অনেক প্রতিষ্ঠান তা-ও দেয়নি। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাধ্যতামূলক অবৈতনিক ছয় মাসের ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মৌখিকভাবে অফিসে আসতে নিষেধ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে কর্মহীন হয়ে পড়েছে বিপুলসংখ্যক মানুষ। রাজধানীতে বাসাভাড়া দিয়ে থাকার মতো সক্ষমতা নেই এদের। ফলে অনেকটা বাধ্য হয়ে ঢাকা ছাড়তে হচ্ছে তাদের। করোনা মহামারির কারণে এই বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে এসে আগামী তিন মাসের মধ্যে সাড়ে ১৯ কোটি মানুষ চাকরি হারাতে যাচ্ছে। এদের মধ্যে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতেই চাকরি হারাচ্ছে সাড়ে ১২ কোটি মানুষ। বর্তমানে বিশ্বের পূর্ণ বা খন্ডকালীন মোট কর্মশক্তির প্রতি পাঁচজনের মধ্যে চারজনের পেশা কোনো না কোনোভাবে করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আইএলও বলছে, বিভিন্ন আয়ের মানুষ এর ফলে ক্ষতির শিকার হবে; কিন্তু সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণি। (২০০৮-২০০৯)সালের বিশ্বমন্দার সময় যত মানুষ চাকরি হারিয়েছে, এই হার তার চেয়েও বেশি। আইএলওর তথ্য অনুযায়ী আবাসন ও খাদ্যের পাশাপাশি নির্মাণ, খুচরা বিক্রি, ব্যবসা এবং প্রশাসনিক খাতগুলো বিশেষ ঝুঁকিতে রয়েছে।

গবেষণা সংস্থা পিপিআরসি ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের 'কোভিড-১৯ এর সময় জীবিকা, ক্ষতি ও সহায়তা' শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার কারণে সবচেয়ে বেশি আয় কমেছে রেস্তোরাঁর কর্মীদের। তাদের রোজগার কমেছে ৯৯ শতাংশ। রোজগার কমার ক্ষেত্রে এর পরের অবস্থানে আছেন ভাঙ্গারির কর্মীরা। তাদের রোজগার কমেছে ৮৮ শতাংশ। রিকশাচালকদের আয় কমেছে ৮৪ শতাংশ। দিনমজুরের আয় কমেছে ৮৩ শতাংশ। শিল্পীসমাজের আয়ও কমেছে ৮৩ শতাংশ। মালি ও কারখানার কর্মীদের আয় কমেছে ৮০ শতাংশ। এছাড়া দক্ষ শ্রমিকদের ৭৯ শতাংশ, কৃষিশ্রমিকদের ৭৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ৭৩ শতাংশ, দোকান, সেলুন, পার্লারের রোজগার কমেছে ৭২ শতাংশ। পোশাককর্মীদের আয় কমেছে ৪৯ শতাংশ, কৃষকের ৪৪ শতাংশ, পিয়ন ও নিরাপত্তারক্ষীদের ৪৩ শতাংশ, অফিসের আনুষ্ঠানিক কর্মীদের কমেছে ৩৩ শতাংশ এবং পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের আয় কমেছে ২৭ শতাংশ। অপর এক জরিপে দেখা যায়, কোভিড-১৯ এর কারণে নিম্নআয়ের মানুষের ওপর বহুবিধ নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। জরিপে অংশ নেওয়া ৩৪ দশমিক ৮ শতাংশ পরিবারের কমপক্ষে এক সদস্য চাকরি হারিয়েছেন। মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে গড় পারিবারিক উপার্জন কমেছে প্রায় ৭৪ শতাংশ। আর রোজগার কমার ফলে সেখান থেকে বড় অংকের একটা টাকা দিতে হচ্ছে বাসাভাড়ায়। নিরুপায় হয়ে বাসা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে তারা।

এত গেল শুধু নিম্নবিত্তের বা স্বল্পআয়ের মানুষের চিত্র। এবার শিক্ষার্থীদের কথা ভাবুন। রাজধানীতে বসবাস লাখ লাখ শিক্ষার্থীর এদের কেউ চলমান আবার অনেকেই পড়ালেখা শেষে বেকার অবস্থায় চাকরি সন্ধানী। তাদের দুরবস্থার চিত্রগুলো আরো বেশি ভয়ংকর- যারা মেস বা কয়েজন মিলে বাসাভাড়া করে থাকেন। গত ১৫ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা হওয়াতে শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেয় গ্রামের বাড়িতে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন মাসের অধিক সময় তারা বাড়িতেই অবস্থান করছেন। কিন্তু তাদের মেসে বা বাসার ভাড়া ঠিকই দিতে হচ্ছে। যা তাদের জন্য খুবই দুরূহ ব্যাপার। কেননা, অনেক শিক্ষার্থীই ছিল যারা তাদের নিজেদের খরচ টিউশনি বা অন্য কোনোভাবে নিজেরাই বহন করে চলত। কিন্তু করোনার কারণে তাদের সেসব আয়-উপার্জন বন্ধ; এমতাবস্থায় বাসা মালিকরাও তাদের ওপর অমানবিক ব্যবহার করছে। বাসাভাড়া বাকি থাকাতে নানা রকম হুমকি-ধমকি দিয়েই চলেছে অনাবরত এবং ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং মূল্যবান কাগজপত্রগুলোও- যা বাড়িওয়ালাদের অমানবিক আচারণের নিকৃষ্টতম দৃষ্টান্ত।

সম্প্রতি, রাজধানীর কলাবাগানের ওয়েস্টার্ন স্ট্রিটের একটি বাড়ির নিচতলায়মেসে থাকা আট শিক্ষার্থীর তিনটি কক্ষের তালা ভেঙে তাদের শিক্ষা সনদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিবন্ধনপত্র, বই খাতাসহ যাবতীয় মালামাল ময়লায় ফেলে দিয়েছেন বাড়িওয়ালা এবং রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫০ শিক্ষার্থী তিন মাসের ভাড়া না দেওয়ায় তাদের শিক্ষা সনদ ও মালামাল গায়েব করে দিয়েছে পূর্ব রাজাবাজারে একটি ছাত্রাবাসের মালিক।

একজন শিক্ষার্থীর সারাজীবনের অর্জন তার সনদপত্রগুলো, যা একজন শিক্ষার্থীর কাছে অতি মূল্যবান, আর সেগুলো যখন কোনো বাড়ির মালিক ভাড়া বকেয়া থাকায় ছুড়ে ফেলে দেন তখন অনুভূতিটা কেমন হতে পারে!

]আর এমন ভয়ের আশঙ্কা করে অনেক কষ্টে বকেয়া শোধ করে নিজেদের প্রয়োজনীয় মূল্যবান জিনিসপত্র সংরক্ষণ করতে প্রতিনিয়তই ছুটে চলেছে করোনার আঁতুড়ঘর রাজধানীতে। যার রূপ হতে পারে অত্যন্ত ভয়াবহ। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে সার্বিক দিক বিবেচনা করে বাড়িওয়ালাদের উচিত ভাড়াটিয়াদের প্রতি মানবিক হওয়া।

\হইমরান হুসাইন : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<105014 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1