কোভিড-১৯: শিশুশ্রমের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে না তো?

আজকের শিশুরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। এরাই একদিন দেশতরীর নাবিক হয়ে কঠিন প্রতিকূলতার বুক চিরে দেশকে নিয়ে পৌঁছাবে আমাদের স্বপ্নের ঠিকানায়। তাই জাতির এ সম্ভাবনাময় কর্ণধারদের উজ্জ্বল ও শঙ্কাহীন ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের দায়িত্ব আমার, আপনার, সর্বোপরি সরকারের।

প্রকাশ | ০৮ জুলাই ২০২০, ০০:০০

এস এম খালিদ হোসেন
নভেল করোনাভাইরাস মানুষের স্বাভাবিক জীবনচক্রকে অনেকটাই ওলটপালট করে দিয়েছে। অদৃশ্য এ অণুজীবের সংক্রমণে জনজীবন আজ বিপর্যস্ত। সবকিছুই স্থবির হয়ে পড়ায় অনেকের জীবনে নেমে এসেছে কঠিন দুর্দিন, তীব্র হতাশা। এ কঠিন পরিস্থিতিতে প্রতিনিয়ত তাদের সময় কাটছে এক ধরনের অনিশ্চয়তা আর উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে। এক রকম বাধ্য হয়েই সিংহভাগ মানুষ বর্তমানে গৃহবন্দি অবস্থায় দিনাতিপাত করছে। এতে করে অনেকে শুধু দিশেহারাই হয়ে পড়েনি, বরং কর্মহীনতার চরম সংকটেও আবর্তিত হচ্ছে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত আর নিম্নশ্রেণির মানুষের জীবন আজ প্রায় বিপন্ন। রুজিরোজগারে এসেছে এক অশনি সংকেত। অনেকে অভাবে থেকেও মুখ ফোটে কারো কাছে কিছু বলতে পারছে না। সমাজে এমন পরিবারের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়, যারা লজ্জায় হাত পাততে না পেরে পরিবার নিয়ে নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। চরম দুর্গতির মধ্যে পরিবার-পরিজনের দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে অনেকে। হতদরিদ্রদের মাঝে প্রতিনিয়তই হানা দিচ্ছে খাদ্য সংকটের মতো জৈবিক ক্ষুধা। যারা দিন এনে দিন খায় তাদের রুজিরোজগার আজ চরম হুমকির মুখে। শুধু তাই নয়, এ কঠিন বৈশ্বিক মহামারির কারণে শিশুশ্রম কমার সফলতা অনেকাংশেই ঝুঁকির মুখে পড়েছে বলে সতর্ক করেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও ইউনিসেফ। বাংলাদেশের গত দুই দশক ধরে শিশুশ্রমের সংখ্যা ৯ কোটি ৪০ লাখ কমিয়ে আনার যে সফলতা ও অর্জন তা এই মহামারিতে রীতিমত ম্স্নান হতে বসেছে। কোভিড-১৯ এর ফলে এ বছরেই ৬ কোটি মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে পড়তে পারে বলে এরই মধ্যে সতর্ক করেছে বিশ্বব্যাংক। ইউনিসেফ ও আইএলও বলছে, দারিদ্র্য বাড়লে শিশুশ্রমও বাড়বে। কারণ বেঁচে থাকার জন্য পরিবারগুলো সম্ভাব্য সব উপায়ে চেষ্টা করবে। বিভিন্ন দেশের গবেষণাকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, দারিদ্র্য এক শতাংশ বাড়লে শিশুশ্রম অন্তত দশমিক সাত শতাংশ বাড়বে। আইএলওর মহাপরিচালক গাই রাইডার বলেন, 'করোনা মহামারিতে যেহেতু পারিবারিক আয়ের ওপর প্রভাব পড়েছে, ফলে অনেকে শিশুশ্রমের আশ্রয় নিতে পারে।' ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর বলেন, 'সংকটের সময়ে কিছু পরিবারের জন্য তা মোকাবিলার অন্যতম উপায় শিশুশ্রম। যেহেতু করোনার কারণে দারিদ্র্য বেড়েছে, স্কুল বন্ধ এবং সামাজিক সেবার সুযোগ হ্রাস পেয়েছে, তাই আরও বেশি শিশুদের কাজের দিকে ঠেলে দেওয়া হতে পারে। করোনা মহামারিজনিত পরিস্থিতির মধ্যে যেসব শিশু মা-বাবার একজনকে অথবা দুজনকেই হারিয়েছে, তারা সবচেয়ে বেশি শ্রমঝুঁকিতে রয়েছে। মেয়ে শিশুদের অনেকে জীবিকার তাগিদে কৃষিকাজ ও গৃহস্থালীর কাজে যুক্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি তোমো হোজুমি বলেন, 'কোভিড-১৯ মহামারি ঝুঁকিপূর্ণ শিশুদের জীবন, প্রত্যাশা এবং ভবিষ্যতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। স্কুল বন্ধ এবং পারিবারিক উপার্জন হ্রাস হওয়ায় অনেক শিশুকে শিশুশ্রম এবং বাণিজ্যিক যৌন নির্যাতনের ঝুঁকির মুখে ফেলে দেবে। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশু দীর্ঘসময় স্কুলের বাইরে থাকে, পরে তাদের স্কুলে ফিরে আসার সম্ভাবনা অনেকাংশে কমে যায়। আমাদের এখন মহামারির সময়কালে শিক্ষা এবং শিশুদের সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দেয়া দরকার।' মহামারির কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় দেশে দেশে শিশুশ্রম বেড়ে যাওয়ার আলামত এরই মধ্যে পাওয়া গেছে। করোনার কারণে বিশ্বের প্রায় ১৩০টি দেশের অন্তত ১০০ কোটি শিশুর স্কুল বন্ধ রয়েছে। স্কুল চালু হলেও কিছু পরিবারের জন্য তার শিশুসন্তানের শিক্ষার খরচ মেটানো কষ্টকর হয়ে পড়বে। সে ক্ষেত্রে এসব পরিবারের শিশুদের স্কুলে যাওয়া নিয়ে সৃষ্টি হবে এক বড় অনিশ্চয়তা। বেড়ে যাবে শিশুশ্রমের ঝুঁকিও। তাই এই ক্রান্তিকালীন শিশুশ্রমের ঝুঁকি নিরসনের ভাবনা ভাবার এখনই বোধহয় উপযুক্ত সময় আমাদের। বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ এ নির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে, কারা শিশু। আরও বলা আছে, ১৪ বছরের নিচে কোনো শিশুকে কাজে নেওয়া যাবে না। ১৪ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত কাজে নেওয়া যাবে, তবে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নেওয়া যাবে না। এছাড়াও আমাদের রয়েছে শিশুশ্রম নীতি-২০১০। ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রয়োজন এই আইনগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন। শিশুশ্রম নিরসনের জন্য প্রথমে কোথায় কোথায় শিশুশ্রম হচ্ছে তা খুঁজে বের করা দরকার। দরকার গণমাধ্যমে এ বিষয়ে বেশি বেশি প্রচার করা। দরিদ্র শিশুদের অভিভাবকদের কাজের ব্যবস্থা করা, বেশি বেশি তদারকির ব্যবস্থা করা, যারা শিশুদের কাজে লাগাবে তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। সংকটের সময়ে সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মানুষকে সহায়তা দেয়। এছাড়াও শিক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা, বিচার, শ্রমবাজার, আন্তর্জাতিক মানবিক ও শ্রম অধিকার বিষয়ে আন্তঃরাষ্ট্রীয় নীতিমালা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। আজকের শিশুরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। এরাই একদিন দেশতরীর নাবিক হয়ে কঠিন প্রতিকূলতার বুক চিরে দেশকে নিয়ে পৌঁছাবে আমাদের স্বপ্নের ঠিকানায়। তাই জাতির এই সম্ভাবনাময় কর্ণধারদের উজ্জ্বল ও শঙ্কাহীন ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের দায়িত্ব আমার, আপনার, সর্বোপরি সরকারের। তাই আসুন, প্রত্যেকে প্রত্যেকের নিজের অবস্থান থেকে মানবিক হই, সহযোগিতার হাতকে সাধ্যমতো প্রসারিত করি। আমাদের ছোট ছোট প্রয়াসই পারে, জাতির এই কঠিন সংকটকে দূর করতে। ভালো থাকুন সবাই, এই কামনায় এখানেই শেষ করছি। \হ এস এম খালিদ হোসেন : শিক্ষক ও গবেষক, আর্মি আইবিএ, সাভার (বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস)