পাঠক মত

মানবতা আজ কোথায়!

প্রকাশ | ০৮ জুলাই ২০২০, ০০:০০

ইমরান হুসাইন শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মী বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী করোনাভাইরাসের কবলে প্রায় দুই শতাধিক দেশ। সংক্রামিতের হার দিন দিন বেড়েই চলেছে দ্রম্নতগতিতে। জনজীবন হয়ে পড়েছে বিষাদময়। তারপরও এই মহামারির ভিতরে মানুষের আচার-আচরণের মধ্যে নেই বিন্দুমাত্র মানবিকতার ছাপ। দিন দিন মানুষ মানুষের প্রতি হয়ে উঠছে অমানবিক ও নিষ্ঠুরতার উদাহরণ। আর এই নিষ্ঠুরতা ও অমানবিকতার সব থেকে বেশি শিকার হচ্ছেন করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা। যেখানে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের প্রতি মানুষের আচারণ হওয়ার কথা ছিল সহানুভূতিশীল ও মানবিক। যে সময়ে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের মনোবল বা সাহস বাড়ানোর জন্য তাদের প্রতি মানবিক দৃষ্টি প্রদান করার কথা ছিল ঠিক তখনই আমাদের সমাজে ঘটছে তার বিপরীত। একটু খেয়াল করলেই দেখা যায় শুধু আমাদের দেশেই নয়- বাইরের দেশগুলোতেও চলছে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের ওপর অবহেলা ও অবজ্ঞা। তাদের এই খারাপ সময়গুলোতে তাদের প্রতি সদয় না হয়ে পশুর মতো ব্যবহার করেই চলেছে যা করোনায় আক্রান্ত রোগীদের মানুষিক অবস্থার বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে প্রতিফলিত হচ্ছে। এখনো পর্যন্ত গোটা বিশ্বে করোনার কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়ায় সেবা ও মানুষিক শক্তিই এই দুরবস্থা থেকে নির্ময়ের একমাত্র উপায়। কিন্তু সমাজের মানুষের আচার-আচরণ তার সম্পূর্ণ বিপরীতে অবস্থান। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর রোগীরা হয়ে উঠছে সবারর অবহেলা ও অবজ্ঞার পাত্র। নানারকম নির্যাতন ও অমানবিকতার শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়তই। করোনায় আক্রান্ত রোগীদের প্রতি এমন আচারণ যা হয়তো অতীতে কখনো ঘটেনি। কিন্তু বর্তমান এই করোনাভাইরাসের প্রভাবে সবাই দেখতে হচ্ছে নিজেদের চোখে। মানুষের প্রতি মানুষের যে সাধারণ দায়িত্ব-কর্তব্য, মানবিকতা সব যেন বিলীন হয়ে গেছে এক করোনার ছোবলে। নিজ সন্তান তার বাবা-মাকে অবহেলা করছে। করোনার ভয়ে ফেলে রেখে যাচ্ছে রাস্তায়। অনেক সময় ঘরবন্দি করে রাখছে দিচ্ছে না কোনো খাবার। হাসপাতালে পাচ্ছে না পর্যাপ্ত চিকিৎসা। যা প্রতিটা করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিকে পরিচয় করে দিচ্ছে বাস্তবতা ও নিষ্ঠুরতার চরম সত্যের সঙ্গে। আর বারবার এটা মনে করিয়ে দিচ্ছে জগতে কেউ কারও নয়। আজ করোনার ভয়ে করোনা আক্রান্ত নন এমন রোগীকেও হাসপাতালে ভর্তি না করে তাড়িয়ে দিচ্ছে। তারা যে কতটুকু অমানবিক কাজ করছেন সেই উপলব্ধিটুকুও কি হারিয়ে গেছে? আজ করোনায় আক্রান্তের ভয়ে আপনি যাকে হেয় প্রতিপন্ন করছেন, যার সঙ্গে অমানবিক ব্যবহার করছেন আগামীকাল যদি আপনি এমন ব্যবহারের শিকার হন, তাহলে তার অনুভূতি কেমন হবে? একবার অন্যের কষ্টের কথাটি উপলব্ধি করলে বোধহয় তারা চৈতন্য ফিরে পাবে। কিন্তু এর ভিতরে অনেকেই করোনার ভয়ে নিজের আপনজনকে ঘরের রুমে বাইরে থেকে সিটকিনি লাগিয়ে মৃতু্যর মুখে ঠেলে দিচ্ছেন, তারা কী জবাব দেবেন? তাদের ভয় এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তারা মনে করছেন করোনা উপসর্গের কোনো ব্যক্তিকে দূর থেকে দেখলেও তাদের করোনা হবে? আরও একটি মর্মান্তিক বিষয়। কোনো মানুষ যখন করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যান তখন পরিবারের কেউ তো কাছেই আসে না। গোরস্তানে লাশ দাফন করতে গেলে গ্রামবাসী বাধা দেন। তাহলে করোনা আক্রান্ত মৃত ব্যক্তি কি অন্যদের সংক্রমিত করতে পারে? নাকি গোরস্তান অপবিত্র হয়ে যাবে? মুসলমানের দেশে কেন তাহলে এমন পরিস্থিতি? কেন মানুষের প্রতি মানুষের এমন অমানবিকতা। দেশে সম্প্রতি করোনা আক্রান্তের সম্ভাবনা ও করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে ঘটে যাওয়া কয়েকটা অমানবিক ও নিষ্ঠুরতার গল্প তুলে ধরছি। (১) ১৯ এপ্রিল, সাভারে করোনাভাইরাস আক্রান্ত সন্দেহে পৃথক স্থান থেকে এক বৃদ্ধা ও বৃদ্ধকে ফেলে গেছে স্বজনরা। পরে তাদের উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে ভর্তি করেছিল। জয়নাবাড়ি ও পৌর এলাকার মাঝিপাড়া থেকে তাদের উদ্ধার করে সাভার উপজেলা প্রশাসন। তবে তারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কিনা, তা নিশ্চিত নয় এবং তাদের করোনা নেগেটিভ আসে। (২) কুমিলস্নার নাঙ্গলকোট উপজেলায় একটি পরিত্যক্ত হাসপাতালে একজন করোনা রোগীকে রাখা হয়েছে। ওই রোগীকে উপজেলার গোহারুয়া গ্রামের ২০ শয্যা গোহারুয়া হাসপাতালে রেখে বাইরে থেকে পাহারা দিচ্ছে ৫-৬ জন পুলিশ। ও পরিত্যক্ত ওই হাসপাতালের ভেতরে ঘাস জন্মেছে। ভবনের চারপাশে এখন বনজঙ্গলে ভরে গেছে। ভয়ে তাই পরিত্যক্ত এই হাসপাতালে মানুষ প্রবেশ না করলেও একজন করোনা রোগীকে রাখা হয়েছে। যা অমানবিকতার বিরল দৃষ্টান্ত। (৩) করোনাভাইরাস আক্রান্ত সন্দেহে বরিশালের আগৈলঝাড়ায় সত্তরোর্ধ্ব এক বৃদ্ধাকে রাস্তায় ফেলে চলে যায় বৃদ্ধার আপন ভাইয়ের ছেলে। স্বামীহারা এই দীপা বালা নামের আপন ফুফুকে তার ভাইয়ের সন্তানরা স্থানীয় ফুলস্নশ্রী গ্রামের আগৈলঝাড়া-ঢাকা-পয়সারহাট আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে ফেলে রাখার এ ঘটনা জানতে পারলে পুলিশ গিয়ে উদ্ধার করে। পরে চিকিৎসার জন্য তাকে স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে প্রেরণ করে। (৪) চট্টগ্রামের আগ্রার মা ও শিশু হাসপাতালের ঘটনা জানা যায়, কয়েকদিন ধরেই শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালের শিশুরোগ বিভাগের চিকিৎসক ডা. জাফর হোসাইন। প্রথমে কেবিনে ভর্তি হয়ে চিকিৎসাসেবা নেন। কিন্তু অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। এরপরও স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটায় ঢাকায় নেওয়ার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্স কল করা হয়। এয়ার অ্যাম্বুলেন্স এসে মাঠে অবস্থান নেয়। এসময় এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ওই চিকিৎসককে তোলার সময় এয়ার অ্যাম্বুলেন্স কর্তৃপক্ষ জানতে পারে তার করোনার লক্ষণ আছে। পরে তাকে না নিয়ে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সটি চলে যায়। (৫) গত ২৭ মে করোনাভাইরাস আক্রান্ত সন্দেহে চট্টগ্রাম থেকে বস্তাবন্দি করে বাবাকে পাবনায় গ্রামের বাড়িতে ফেলে গেছে তার দুই ছেলে (২৬ মে) ভোরে পাবনার চাটমোহর উপজেলায় এ ঘটনা ঘটে। এবং কিছুক্ষণ পরেই ওই ব্যক্তি মারা যান বলে জানায় স্থানীয়রা। তবে তিনি করোনা আক্রান্ত ছিলেন না। ডায়াবেটিস ও অ্যাজমার রোগী ছিলেন। (৬) গত ১৪ এপ্রিল, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে টাঙ্গাইলে এক নারীকে রাতের অন্ধকারে জঙ্গলে ফেলে গেছেন তার স্বামী-সন্তানরা। টাঙ্গাইল জেলার সখীপুরের গজারিয়া ইউনিয়নের ইছাদিঘী গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। গভীর রাতে ওই নারীর কান্না শুনে স্থানীয় ইউপি সদস্য আবুল কালাম আজাদ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে বিষয়টি জানান। রাত দেড়টার দিকে উপজেলা প্রশাসন ওই নারীকে উদ্ধার করে ঢাকায় পাঠায়। ওই নারীর বাড়ি শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলায়। (৭) গত ৬ জুন, করোনা আক্রান্ত সন্দেহে এক নারীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বারান্দায় ফেলে রেখে উধাও হয়ে গেছে তার ছেলে। অসুস্থ মা মনোয়ারা বেগমকে ফেলে রেখে উধাও হয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে বৃদ্ধাকে উদ্ধার করে পুলিশ। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক অসুস্থ ওই নারীকে উদ্ধার করে করোনা ইউনিটে ভর্তি করেন। (৮) সুনামগঞ্জের ছাতকে করোনার উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে আসা ঢাকা ফেরত এক যুবককে রেখে পালিয়ে গেছে তার স্বজনরা। সে উপজেলার আমেরতল গ্রামের বাসিন্দা। বর্তমান পরিস্থিতিতে করোনার এই সংকটময় মুহূর্তে করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রতি এমন অমানবিক ও নিষ্ঠুরতার আচারণ একজন মানুষের বেঁচে থাকার সব আশাকে প্রতিহত করে এমনিতেই মৃতু্যর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়। আর তাই তাদের প্রতি এমন অমানবিক আচারণ করে তাদের প্রতি সদয় হওয়া খুবই জরুরি। গবেষকরা মনে করেন, 'প্রিয়জনদের প্রতি দায়িত্ববোধই এসব মানুষকে দীর্ঘ জীবন লাভের ব্যাপারে আশাবাদী ও অনুপ্রাণিত করে তোলে।' রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কথা আমাদের সবার জানা। সেখানেও ছিল অনেক মানবিকতার বিশাল গল্প। এক যুবক ঝুড়িতে বসিয়ে কাঁধের দুইপাশে ভার বহন করে অশীতিপর মা-বাবাকে নিয়ে এসেছে এ দেশে। মানবিক বাংলাদেশে এত রোহিঙ্গাদের জায়গা হয়েছে। আর করোনাতঙ্কে পাল্টে যাচ্ছে আমাদের চেহারা। তাই আসুন, আমরা একটু মানবিক হই। করোনার ভয়ে পালিয়ে বেড়ালেই কি আমরা করোনা থেকে বাঁচতে পারব? না পারব না। আমরা আপনজনের প্রতি নিষ্ঠুর না হয়ে মানবিক হলে মহান প্রতিপালকও আমাদের ওপর মানবিক হবেন।