নিষ্ঠুরতা ও বর্ণবাদ : এশিয়া থেকে আমেরিকা

মানুষের নিষ্ঠুরতার কারণে জলবায়ু ও পরিবেশ দিন দিন বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে। আমরা এখনো যদি সচেতন কিংবা প্রকৃতির প্রতি ন্যায় আচরণ না করি ভবিষ্যতে আরও খারাপ পরিণতি হতে পারে।

প্রকাশ | ১৩ জুলাই ২০২০, ০০:০০

মো. শফিকুল ইসলাম
মানুষের নিষ্ঠুরতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা সমাজকে এক ভীতিকর পরিবেশে রূপান্তর করছে। আমাদের কেউ কেউ ক্রমান্বয়ে অমানুষের মতো আচরণ করে চলছে। লক্ষ্ণীপুরে ক্যান্সারে মৃত স্বামীর লাশ আনতে স্ত্রী যখন ঢাকায়, ঠিক তখনই বাড়িতে রেখে যাওয়া ৯ম শ্রেণির কন্যা হিরামণিকে দিনের আলোতে ধর্ষণ করে মেরে ফেলেছে কিছু দুষ্ট লোক। অন্যদিকে অন্যের যৌন লালসার হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে বাধা দেয় এক কিশোরী। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে বর্বররা ওই কিশোরীর গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। নিজের সম্ভ্রম রক্ষার জন্য শেষ পর্যন্ত আগুনে পুড়ে মরতে হলো তাকে। ঘটনাটি ভারতের বেমেতারা জেলার। এছাড়াও ঠাকুরগাঁওয়ে সালিশের নামে মোবাইল চুরির অভিযোগে দুই শিশুকে হাত-পা বেঁধে প্রকাশ্যে নির্যাতন করছে। নির্যাতনের ভিডিও এরই মধ্যে সোস্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়েছে। যা নিয়ে নিন্দা এবং সমালোচনা চলছে। এর কোনোটাই সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়। হাতি মারার ঘটনা যদিও নতুন নয়। গত কয়েকদিন আগে হাতির মৃতু্য বা হত্যার খবর সংবাদপত্রে প্রায় দেখতে পাই। সম্প্রতি বান্দরবানের লামা উপজেলার ফাঁসিয়াখালীতে আবারো বন্যহাতির মৃতু্য হয়েছে। এদিকে হাতিটির মৃতু্য স্বাভাবিক নাকি হত্যা এ নিয়ে মানুষের মনে ধূম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে। তবে বন বিভাগ মনে করছে, নিয়মবহির্ভূত বনাঞ্চল এলাকায় স্থাপিত বিদু্যতের খুঁটির বিদু্যৎ সরবরাহ লাইন স্পর্শে ওই হাতির মৃতু্য হয়েছে। এর আগে কেরালায় এবং কক্সবাজার হাতিকে নিষ্ঠুরভাবে খুন করার ঘটনা সোস্যাল মিডিয়াতে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছে। তবে সেই মর্মান্তিক নিষ্ঠুরতা থেকে যে কোনো শিক্ষাই নেয়নি কেরালাবাসী। কারণ এবার জোড়া বাঘ হত্যার ঘটনা ঘটেছে সেই কেরালাতে। এসব মর্মান্তিক ঘটনা খুবই দুঃখজনক। বন্যপ্রাণীর প্রতি মানুষের নিষ্ঠুরতার বিষয়টি নিয়ে সমাজ সচেতন নাগরিক খুবই উদ্বিগ্ন। নদী প্রকৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু আমরা নদীকে দিন দিন ধ্বংস করে দিচ্ছি। ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে তিস্তা নদী। কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও পানি নেই। তিস্তা এখন হেঁটেই পার হওয়া যায়। তিস্তা নদী দিয়ে এখন গাড়ি চলে। কি যে তিস্তার করুণ হাল! চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। শুকনো মৌসুমে তিস্তা শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে যায়। উজানে ভারত ব্যারেজ নির্মাণ করে তিস্তার প্রাকৃতিক প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করছে। একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ার ফলে বাংলাদেশের ১১২ মাইল দীর্ঘ এই নদী শুকিয়ে এখন মৃতপ্রায়। এই নদী দিয়ে নীলফামারী ও লালমনিরহাট জেলায় কৃষি কাজে সেচ দেওয়াও এখন অসম্ভব। প্রকৃতি ক্রমাগত ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। ফলে এই তিস্তা নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে পানির স্তর নিম্নমুখী হচ্ছে। আবার এখন অবিরাম বর্ষণ ও উজানে থাকা ৬৫ কিলোমিটার অদূরে ভারতের গজলডোবা ব্যারাজের জলকপাট খুলে দেয়ায় তিস্তায় দ্বিতীয় দফায় বন্যা দেখা দিয়েছে এবং পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় উত্তরাঞ্চলে ব্যাপক নদী ভাঙনে মানুষের আবাদি জমিসহ ঘরবাড়ি ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নদীতে বিলিন হয়ে যাচ্ছে। শুধু কি তিস্তা? হবিগঞ্জের শাখা বরাক নদী এক সময়ের খরস্রোতা নদী নামে মানুষের কাছে পরিচিত ছিল। কিন্তু নদীর উভয় পাড় দখলদারদের কারণে নদীর প্রশস্ততা হারিয়ে ছোট খালে পরিণত হয়েছে। শাখা বরাক নদীর সঙ্গে যেসব খাল সংযুক্ত ছিল সেগুলোর অবস্থা খুবই শোচনীয়। খাল ভরাট করে অনেকেই রাস্তা তৈরি করছে, কেউ কেউ ইট-বালু ব্যবসার স্থান হিসেবে গড়ে তুলছে। ফলে, ওই এলাকার পানি নিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়াও আমাদের অসচেতনতা এবং সমন্বয়হীনতার কারণে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও মেঘনা নদী ক্রমাগতভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও অনেক নদীর পাড় ধরে মানুষ বাড়িঘর, দালান তৈরি করছে। ময়মনসিংহের সুতিয়া নদী ধ্বংসের দিকে। নান্দনিক সৌন্দর্য, ফসল, মৎস্য সম্পদ, আবাসন ও সুস্বাস্থ্যের জন্য নদীকে রক্ষা করতে হবে। শীঘ্রই বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও মেঘনা নদীকে দখল ও দূষণমুক্ত করে নদীপাড় থেকে সব অবৈধ স্থাপনা অপসারণ করতে হবে। নদী বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত। যদিও বর্ষার পানিতে যৌবন ফিরে পেয়েছে দেশের অনেক নদনদী। যেগুলো শুকিয়ে গিয়েছিল বা মানুষের দখলে ছিল। নদীর জীবন ফিরে আসায় সমাজের নাগরিকরা খুবই খুশি। পরিবেশ রক্ষার্থে শক্তিশালী উচ্ছেদ অভিযান চালু রাখা, স্থায়ীভাবে সীমানা পিলার নির্মাণ, ময়লা পরিষ্কার করা ও নদীর গভীরতা বৃদ্ধি করতে হবে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার, সম্পদপাচার এবং দেশ ত্যাগের ঘটনা কমবেশি সব দেশে চলছে। শ্রীলঙ্কা, ভারত, মিয়ানমার, বাংলাদেশ, চীন, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর এরকম হত্যাচার কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ। কিন্তু দুর্ভাগ্য, মাঝে মাঝে সংবাদপত্রে দেখতে পাই, বিভিন্নভাবে এক ধরনের ক্ষমতাশালী লোকের দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছে আমাদের দেশের সংখ্যালঘুরা। এমনকি করোনাকালে থেমে থাকেনি সংখ্যালঘু নির্যাতন। এর আগে সাতক্ষীরা, রাজশাহী, যশোর, চট্টগ্রাম এবং বাগেরহাটসহ ২৭টি জেলায় সংখ্যালঘুরা বিভিন্নভাবে নির্যাতিত এবং হয়রানি হওয়ার ঘটনা সংবাদপত্রে দেখতে পাই। যেমন গত ২৪ এপ্রিল বাগেরহাটে অনিল বালার পরিবারের ওপর হামলা চালায় পাশের বাঁশতলা গ্রামের একদল ভূমিদসু্য। সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ, নারী নির্যাতন এবং উপাসনালয়ে হামলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ভারতে নাগরিক আইন নিয়ে যা হয়েছে, তা সমর্থন করি না। গণমাধ্যমে জানতে পাই ভারতে মুসলিম-খ্রিষ্টান সংখ্যালঘুদের ওপর যেভাবে ক্রমাগত হামলা, হত্যা, নির্যাতন করছে কিন্তু অপরাধীরা আবার পার পেয়েও যাচ্ছে। গত ফেব্রম্নয়ারি মাসে দিলিস্নতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনায় পুলিশের অভিযোগপত্রে যে চার্জশিট পেশ করেছে তাতে 'হেইট স্পিচ' দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত বিজেপির নেতা-মন্ত্রীদের নাম উলেস্নখ না করে বরং প্রতিবাদকারীদের নাম রয়েছে- যারা তখন দেশের নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিপক্ষে কথা বলেছিলেন। এতে বোঝা যাচ্ছে যে, ওই বিক্ষোভে জড়িত মুসলিম নেতা বা ছাত্রছাত্রীদেরই দোষী বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। মিয়ানমারে বৈষম্যমূলক আইন ও নীতির কারণে অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে নির্যাতন-নিপীড়ন, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বঞ্চনার শিকার হচ্ছে রোহিঙ্গাসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। এছাড়াও শ্রীলঙ্কায় করোনাভাইরাস মহামারিতে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে কর্তৃপক্ষ বৈষম্যমূলক আচরণ করছে। যেমন কোনো মুসলিম মারা গেলে তার মৃতদেহ দাহ করতে বাধ্য করা হচ্ছে- যা ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ। যা মারাত্মক উদ্বেগের বিষয়। সব দেশে এসব বন্ধ হওয়া জরুরি। এ ধরনের সব ঘটনা অবশ্যই নিন্দনীয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশ হেফাজতে জর্জ ফ্লয়েড নামে এক কৃষ্ণাঙ্গের মৃতু্যর প্রতিবাদে হাজার হাজার মানুষ দেশজুড়ে বিক্ষোভ করছেন। একজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তা হাঁটু গেড়ে বসে তার গলার ওপর চাপ দিয়ে শ্বাস বন্ধ করে তাকে হত্যা করে। জর্জ ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিক্ষোভ শেষ না হতেই আরেক আফ্রিকান বংশোদ্ভূত যুবককে গুলি করে হত্যা করেছে দেশটির পুলিশ। এ ঘটনায় ফের বিক্ষোভ শুরু হলে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন আটলান্টার পুলিশ প্রধান। দুঃখজনক এ ঘটনা বর্ণবাদেরই নামান্তর। আমরা প্রকৃতিরই অংশ। কেউই পূর্বে জেনে আসেনি যে আমাদের ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি কী। কারণ কোনো ধর্ম বা বর্ণই পূর্বনির্ধারিত নয়। ফলে মানুষ হিসেবে সবাইকে সবার শ্রদ্ধা করা উচিত। ধর্ম বা বর্ণ কোনো পরিচয় হতে পারে না, আমাদের মূল পরিচয় হলো আমরা মানুষ। হিংস্রতা নয়, মানবতাই মানুষের প্রকৃত পরিচয়। একজন মানুষের আচরণ অনেকাংশেই পরিবার দিয়ে গড়ে ওঠে। তাই পরিবারকে খুবই সতর্ক থাকতে হবে যাতে তাদের সন্তান কী করছে, কোথায় যাচ্ছে- সেই বিষয়ে পিতা-মাতা নজর রাখতে পারে। মানুষের নিষ্ঠুরতার কারণে জলবায়ু ও পরিবেশ দিন দিন বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে। আমরা এখনো যদি সচেতন কিংবা প্রকৃতির প্রতি ন্যায় আচরণ না করি ভবিষ্যতে আরও খারাপ পরিণতি হতে পারে। মো. শফিকুল ইসলাম : শিক্ষক ও সাবেক সভাপতি-শিক্ষক সমিতি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ ংযধভরয়ঁবলশশহরঁ@মসধরষ.পড়স