করোনাকাল ও শিক্ষার্থীদের অটোপ্রমোশন

অটোপ্রমোশন হলে শিক্ষার্থীদের অনিশ্চিত ভাবনা কমবে। মানসিক অশান্তি দূর হবে। সবচেয়ে বেশি লাভের বিষয় হচ্ছে- তারা সামনের জন্য প্রস্তুত হতে পারবে।

প্রকাশ | ১৪ জুলাই ২০২০, ০০:০০

মীর আব্দুল আলীম
সীমিত আকারে এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়ার কথা ভাবছে সরকার। শিক্ষামন্ত্রী এ ব্যাপারে সম্প্রতি বক্তব্যও পেশ করেছেন। মন্ত্রী পরবর্তীতে এও বলেছেন- 'পরীক্ষার চেয়ে শিক্ষার্থীদের জীবনের মূল্য অনেক বেশি। শিক্ষার ক্ষেত্রে পরীক্ষাই শেষ কথা নয়। এক বছরে সব শেষ হয়ে যাবে তাও নয়' শিক্ষামন্ত্রীর এমন মন্তব্য বেশ ভালো লেগেছে আমাদের। তবে সরকারের ভাবনায় আনা সীমিত পরীক্ষার বিষয়টি আতঙ্কেরই বটে! এইচএসসি পরীক্ষার ক্ষেত্রে কমসংখ্যক পরীক্ষা নেওয়া, পরীক্ষা কেন্দ্র বাড়িয়ে পরীক্ষা নেওয়া হলে কি দাঁড়াবে? প্রায় ১৪ লাখ পরীক্ষার্থী এবার এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। যেভাবেই পরীক্ষা হউক এই সংখ্যক পরীক্ষার্থীকে পরীক্ষা দিতে একই সঙ্গে বের হতে হবে। পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে থাকবেন আরও ১/২ জন করে অভিভাবক। পরীক্ষা কেন্দ্রের নিরাপত্তার জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, কেন্দ্রের শিক্ষক, কর্মকর্তা কর্মচারী এ নিয়ে প্রায় কম করে পরীক্ষার দিন অর্ধ কোটি মানুষের সমাগম হবে। প্রশ্ন হলো- ১৪ লাখ শিক্ষার্থী কীভাবে কেন্দ্রে যাবে? কোনো পরিবহণযোগে অবশ্যই। পরিবহণে চড়তে গিয়ে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের করোনা আক্রান্তের সম্ভাবনা কিন্তু থেকেই যায়। এরপর শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের অধিকাংশই কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অসচেতন ধরে নিতেই হবে। তারা পরীক্ষা দিতে এসে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে সামাজিক দূরত্ব কতটা বজায় রাখতে পারবে তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন থেকে যায়। অভিভাবকরাও কি এসময় সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলতে পারবেন? প্রশ্নই আসে না। তাহলে পরীক্ষা দিতে গিয়ে অসংখ্য পরীক্ষার্থী যারা এতদিন ঘরেই নিরাপত্তা বজায় রেখে চলেছে তারা করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন এটাই কিন্তু স্বাভাবিক। শিক্ষার্থী কিংবা অভিভাবকরা করোনা আক্রান্ত হলে এর দায় কে নেবে? জনগন কিন্তু নিশ্চিত সরকারকেই এজন্য দায়ী করবেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়াও হবে তখন। তাতে সরকারের ভাবমূর্তি চরমভাবে নষ্ট হবে বৈকি! আমাদের দেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রচার-অপপ্রচার কীভাবে হয় তা কিন্তু আমরা বেশ জানি। গুটিকয়েক চালচোরা, ত্রাণচোরার কারণে দেশের সব জনপ্রতিনিধিদের ঢালাওভাবে সামাজিক যোগাযেগমাধ্যমে হেয় করার ঘটনা অতীত নিকটেরই। পদ্মা সেতুতে রক্ত লাগে, মাথা লাগে এমন অপপ্রচারও কিন্তু ফেসবুক ইউটিউবের মাধ্যমেই হয়েছে। দেখা গেল কোনো শিক্ষার্থী করোনাভাইরাস ছাড়া অন্যকোনো কারণে মারা গেলেও এটাকে একশ্রেণির মানুষ ভিন্ন খাতে নিয়ে সরকারকে নাজেহাল করতে চাইবে। তা ছাড়া এতসংখ্যক শিক্ষার্থী অভিভাবক, শিক্ষক, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজনের সমাগমে করোনা ছড়াবেই এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। প্রশ্ন হলো- নিশ্চিত বিষয়টিতে সরকার কেন ঝুঁকি নিতে যাবে। তা যদি হয় তাতে সরকারকে অনেক বেশিই খেসারত দিতে হতে পারে। এ জন্য কি করা দরকার? উন্নত বিশ্বে করোনাকালে অটোপ্রমোশন দিচ্ছে এমন খবর আমরা পাচ্ছি। এশিয়ার মধ্যে মালয়েশিয়া এমনকি পার্শ্ববর্তী বন্ধুদেশ ভারতও স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অটোপ্রমোশনের ঘোষণা দিয়েছে। সিঙ্গাপুর, কানাডাসহ বহু দেশ অটোপ্রমোশন দিয়ে সামনের শিক্ষাকে গতি দেওয়ার চেষ্টা করছে। চলতি জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে ভারতের এনডিটিভি, আনন্দবাজারসহ বেশ কটি পত্রিকায় দেখলাম, করোনা পরিস্থিতিতে এ বছরের জন্য সব কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারতের রাজস্থান সরকার। তবে এসব শিক্ষার্থী পরীক্ষা ছাড়াই পরবর্তী ধাপে উত্তীর্ণ করা হবে বলে জানানো হয়। রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলট বলেন, করোনা মহামারির কারণে রাজ্য সরকার এ বছরের জন্য সব পরীক্ষা বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সব শিক্ষার্থীকে পরীক্ষা ছাড়াই পাস করানো হবে এবং আগামী কয়েকদিনের মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশিকা অনুসারে তাদের স্কোর করা হবে বলে তিনি জানান। এ ক্ষেত্রে অটোপ্রমোশনে আমাদের দেশে সমস্যা কোথায়? এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ক্ষেত্রে এইচএসসিতে অটোপ্রমোশন হতেই পারে। তা না হলে পিএসসি, জেএসসির ফলাফলও বিবেচনায় আনা যায়। অটোপ্রমোশন হলে লাভ কিংবা লোকসান কি? এতে ৮ থেকে ১০% শিক্ষার্থী ফলাফলে কেবল খুব সামান্য লাভ হতে পারে। কোনো প্রকার ক্ষতি নয়। যেমন- পরীক্ষা হলে যারা এ গ্রেডের নিচে ফলাফল করত তারা হয়তো এ গ্রেড পেয়ে যাবে আগের ফলাফলের কারণে। এ ছাড়া যাদের এসএসসিতে এ গ্রেড ছিল কিন্তু তারা এ+ পেতে পারতো এ ক্ষেত্রে এমন শিক্ষার্থীর কিছুটা ক্ষতি হয়তো হবে। তবে এর পরিমাণ হবে খবই কম। এটা অল্পসংখ্যক পরীক্ষার্থী কিছুটা লাভ-লোকসানে পড়তে পারে। সংকটকালে এমন এক-আধটু সমস্যা কিন্তু মেনে নিতেই হয়। তা ছাড়া কোভিট করোনা মহামারি সংকট কিন্তু বিশ্বজুড়ে এক মহাসংকট। অনেক দেশই যখন এমনটা ভাবছে তখন বাংলাদেশেরও তা ভাবা উচিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফলাফলে খুব একটা তারতম্য হবে না। পরীক্ষা দিতে না পেরে এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা চরম ভাবনার মধ্যে পড়েছে। একদিকে পরীক্ষা অন্যদিকে ভর্তির প্রস্তুতি সব যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে তাদের। অটোপ্রমোশন হলে শিক্ষার্থীদের অনিশ্চিত ভাবনা কমবে। মানসিক অশান্তি দূর হবে। সবচেয়ে বেশি লাভের বিষয় হচ্ছে- তারা সামনের জন্য প্রস্তুত হতে পারবে। এইচএসসি পাসের পরই কিন্তু একজন শিক্ষার্থীর জীবন ঘুরে দাঁড়ায়। এমন এক অবস্থায় দেশের ১৪ লাখ শিক্ষার্থী যেন মহাসংকটে পড়েছে। এখন পরীক্ষা চিন্তাই করবে নাকি ভর্তির প্রস্তুতি নেবে। অটোপ্রমোশন হয়ে গেলে তারা সামনে ভর্তির জন্য প্রস্তুত হতে পারবে। সহসাই যে করোনা সংকট চলে যাবে তা কিন্তু নয়। এমন লক্ষণও দেখছি না আমরা। তাই শিক্ষার্থীদের সামনের কথা ভেবে তাদের এ দায় থেকে মুক্ত করে অটোপ্রমোশন দেওয়া হলে তারা নতুন ভাবনা শুরু করতে পারে। ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নিতে পারবে। ভর্তির বিষয়টা না হয় পরেই ভাবুক সরকার। এটাও কোন পদ্ধতিতে করে নেওয়া যেতে পারে। করোনা সংকটকালে সব থেমে যাবে তা হতে পারে না। তা ছাড়া এ মহামারি যদি ক্ষণস্থায়ী ভাবা যেত তাহলে হয়তো অপেক্ষা কোনো বিষয় ছিল না। এটা তো অনিশ্চিত যে করোনা সংকট থেকে কবে দেশ কিংবা বিশ্ব মুক্ত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যদি এইচএসসিতে অটোপ্রমোশন হয় তাহলে ভর্তির বিষয়টা কি হবে এমন বিষয়টিও ভাবছেন অনেকে। অন্যদেশে সেমিস্টার চালু আছে এমন কথা বলতে পারেন কেউ কেউ। এমন ভাবনাটা কিন্তু পরেও ভাবা যাবে। অন্তত এইচএসসির দায়মুক্তিটা তো হউক। এই পরীক্ষার্থীরা কিন্তু বেশ মানুষিক চাপে আছে। কি হবে? কবে পরীক্ষা হবে? ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি কবে থেকে নেবে। ভর্তির কি হবে। নানা প্রশ্ন মাথায় কিলবিল করছে। এতে তারা মানসিকভাবে অসুস্থও হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি সরকারের ভাবনায় নেওয়া দরকার। গত ২৭ জুন বাংলাদেশ (ইরাব) আয়োজিত 'করোনায় শিক্ষার চ্যালেঞ্জ এবং উত্তরণে করণীয়' শীর্ষক ভার্চুয়াল সেমিনারে করোনাভাইরাসের জন্য আটকে যাওয়া এইচএসসি পরীক্ষার বিষয় সংখ্যা কমানো এবং কম সময়ে নেওয়ার চিন্তা-ভাবনা চলছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, 'এ বছরের এইচএসসির সিলেবাস কমানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই। কারণ তারা তো তাদের সিলেবাস সম্পন্ন করেছে। এখন হতে পারে যে, পাবলিক পরীক্ষা নেওয়া হবে এবং এত লাখ লাখ পরিবার, এত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, এত প্রশাসনের মানুষ, এত শিক্ষক- সবাইকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলব? 'তাহলে সেটি আমরা কম সময়ে করতে পারি কিনা? কমসংখ্যক পরীক্ষা নিতে পারি কিনা? আমরা সবকিছুই ভাবছি।' পরীক্ষা কবে হবে- তা নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, 'শিক্ষা পরিস্থিতি অনুকূলে আসার ১৫ দিন পর এই পরীক্ষা নেওয়া হবে। মন্ত্রী কমসংখ্যক পরীক্ষা আর বেশিসংখ্যক পরীক্ষা যেভাবেই নেওয়া হউক শিক্ষার্থী, অভিভাবক, প্রশাসনের লোকজন আর শিক্ষকদের কিন্তু একসঙ্গেই বাইরে বের হতে হবে। লিখিত পরীক্ষা মানেই কিন্তু ঘর থেকে বের হওয়ার প্রশ্ন আসে। তাতে ঝুঁকিটা কি একই রকম নয়? আমরা দেখেছি, এ দেশের অধিকাংশ মানুষ নিয়মনীতির খুব একটা তোয়াক্কা করে না। করোনা সংকটকালে সরকার জনগণের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার স্বার্থে কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। জীবনযাত্রা যাতে একেবারে থমকে না যায় এজন্য সীমিত আকারে ব্যবসা-বাণিজ্য, গণপরিবহণ চলাচল, অফিস-আদালত খোলা রাখা হয়েছে। কি দেখছি আমরা? এ দেশে কোনো সীমিত আকার বলে কথা থাকে না। যে যার মতো চলে। সরকারের নির্দেশনা মানতে চায় না জনগণ। অবাদ এবং যত্রতত্র স্বাস্থ্যবিধী না মেনে চলা যেন আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। এই হচ্ছে আমাদের অবস্থা। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিতে গিয়ে কতটা নিরাপদ থাকতে পারবে তা সরকারের ভাবনায় আনা উচিত। আমরা জানি, আমাদের দেশের মানুষের স্বাস্থ্যসচেতনতা খুবই কম। তারা অবিবেচকের মতো আচরণ করেছেন। করোনা গোটা বিশ্বব্যবস্থার সব সামাজিক সিস্টেম তছনছ করে দিয়েছে। আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত আমাদের নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের ঘাটতি প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। সন্তান তার মাকে জঙ্গলে ফেলে রেখেছে। বাবা তার করোনা আক্রান্ত সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে পরীক্ষার কথা ভাবনায় আনা কতটা যৌক্তিক। এ ছাড়া পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা থেকে দ্বায়মুক্তির বিষয়টিও রয়েছে। এমন তো নয়- তাদের কোনো পাঠ গ্রহণ বাদ ছিল। সব প্রস্তুতি শেষে তারা পরীক্ষা দিতে যাবে এমন সময়ই করোনাভাইরাস সব থমকে দিয়েছে। তারা গত দুবছর পড়াশোনা করেছে, কলেজের পরীক্ষাগুলোতে অংশ নিয়ে উত্তীর্ণও হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অটোপ্রমোশন হলে ক্ষতি কি তাতে। তা ছাড়া পরীক্ষা যদি নেওয়া হয়ই তবে তাতে সহসাই নয়। এমন বিলম্ব শিক্ষার্থীদের চরম ক্ষতির কারণ হবে নিশ্চিত। শিক্ষা মন্ত্রণালয় তথা রাষ্ট্র বিষয়টি ভাববে এই প্রত্যাশা রইল। মীর আব্দুল আলীম : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গবেষক, হবংিংঃড়ৎবসরৎ@মসধরষ.পড়স