বিশ্ব যুব দক্ষতা দিবসের গুরুত্ব

মূলত যুবসমাজকে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাপ্রদান, তাদের কর্মসংস্থান, যোগ্যতা অনুসারে সম্মানজনক পেশায় অন্তর্ভুক্তি, কর্মপরিবেশ উন্নয়ন, কর্মস্থলে শিক্ষানবিশি ব্যবস্থার প্রবর্তন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবার সচেতনতা বিকাশ এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে এসব বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগী করাই হলো বিশ্ব যুব দক্ষতা দিবস পালনের মূল অঙ্গীকার

প্রকাশ | ১৫ জুলাই ২০২০, ০০:০০

তপন কুমার দাশ
প্রতি বছরের মতো এ বছরেও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব যুব দক্ষতা দিবস। যুবসমাজের মধ্যে দক্ষতা উন্নয়ন ও কারিগরি শিক্ষার ধারণা সম্প্রসারণ এবং তাদের দক্ষ মানবসম্পদরূপে গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়েই মূলত ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ সাধারণ সভায় জুলাই মাসের ১৫ তারিখকে বিশ্ব যুব দক্ষতা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সে অনুসারেই বিশ্ব্‌ের নানা দেশে পালিত হয় বিশ্ব যুব দক্ষতা দিবস। মূলত যুবসমাজকে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাপ্রদান, তাদের কর্মসংস্থান, যোগ্যতা অনুসারে সম্মানজনক পেশায় অন্তর্ভুক্তি, কর্মপরিবেশ উন্নয়ন, কর্মস্থলে শিক্ষানবিশি ব্যবস্থার প্রবর্তন ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবার সচেতনতা বিকাশ এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে এসব বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগী করাই হলো বিশ্ব যুব দক্ষতা দিবস পালনের মূল অঙ্গীকার। বাংলাদেশেও এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে নানা কর্মসূচি বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে। জাতীয় পর্যায়ে বিশ্ব যুব দক্ষতা দিবসের মূল অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা এনএসডিএ-এর উদ্যোগে। এ উপলক্ষে আয়োজিত হয় সেমিনার,র্ যালি, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ উপকরণের প্রদর্শনী, পোস্টার প্রকাশনা ও বিতরণ ইত্যাদি কর্মসূচি। আনুরূপভাবে সারা দেশেই আয়োজিত হয় নানাবিধ কার্যক্রম। বেসরকারি সংস্থাগুলোও এসব আয়োজনে যোগ দেয় এবং বিশেষ করে মিডিয়াগুলো এ দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরতে বিশেষ নিবন্ধসহ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে, পালন করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তবে এ বছরের বিশ্ব যুব দক্ষতা দিবস আয়োজন একেবারেই অন্যরকম। কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্বব্যাপীই এবারের আয়োজন পেয়েছে ভিন্নমাত্রা। একদিকে যেমন দিবস উদযাপনের পদ্ধতিতে এসেছে পরিবর্তন, আবার আলোচ্যসূচিতেও এসেছে নতুন মাত্রা। ইতিমধ্যেই ইউনেস্কো, আইএলওসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো প্রক্ষেপণ করেছে যে কোভিডের কারণে প্রায় ৭০ ভাগ শিক্ষার্থীই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ব্যাহত হয়েছে তাদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কার্যক্রম এবং এদের মধ্যে অনেক শিক্ষার্থীই হয়তো আর বিদ্যালয়ে ফিরে আসতে সক্ষম হবে না। যদিও নানা দেশেই লকডাউন চলাকালে বা ছুটি থাকাকালে নানা ক্ষেত্রেই অনলাইন কোর্স চালু করা হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিদ্যমান শিক্ষা উপকরণ, শিক্ষক বা প্রশিক্ষকদের, ভার্চুয়াল পদ্ধতি ব্যবহারে অপরিপক্বতা বা শিক্ষার্থীদের অসামর্থ্য ইত্যাদি বিষয়গুলোর কারণে অনেক শিক্ষার্থীই এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে অন্তর্ভুক্তই হতে পারেনি। পাশাপাশি, ইতিমধ্যে লাখ লাখ লোক তাদের চাকরি হারিয়েছে এবং আরও বহুসংখ্যক লোক ছাঁটাই হওয়ার আশংকায় ভুগছে। বাংলাদেশের পরিস্থিতিও ভয়াবহ। ইতিমধ্যেই গণসাক্ষরতা অভিযানের এক জরিপে বলা হয়েছে কোভিডের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ড্রপআউট প্রবণতা বেড়ে যাবে, বেকারত্ব বাড়বে, ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে অন্তর্ভুক্তি বাড়তে পারে, বাল্যবিবাহ বাড়বে, অসামাজিক ও সমাজবিরোধী কাজের প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে। অন্যান্য অনেক গবেষণাতেই দেশে বেকারত্ব বৃদ্ধি এবং হতদরিদ্র মানুষের হার বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে। গার্মেন্ট সেক্টরের সমস্যাগুলো ইতিমধ্যেই আলোচনায় এসেছে। তবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী, হোটেল রেস্তোরাঁর কর্মীসহ অপরাপর অসংখ্য ক্ষতিগ্রস্ত শ্রেণি বা গোষ্ঠীর প্রসঙ্গটি বিবেচনায় আনতে হবে। বিবেচনায় আনতে হবে দেশে বিদ্যমান প্রায় ২৫ লাখ গৃহশ্রমিকের প্রসঙ্গটিও, যাদের প্রায় আশিভাগই নারী এবং তাদের অধিকাংশেরই বয়স বিশ বছরের কম। বিশেষব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে প্রতিবন্ধী, ট্রান্স-জেন্ডারসহ অন্যান্য বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের জন্যও। না হয় বৈষম্য আরও প্রকট আকার ধারণ করবে। ইতিমধ্যেই অনেক দাতা সংস্থাই এনজিওদের বাজেট কাটছাঁটের নির্দেশনা জারি করতে শুরু করেছে। বিশেষ করে, মানবিক উন্নয়নের জন্য বরাদ্দকৃত তহবিলের ক্ষেত্রেই এ সংকট প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। যা বিদ্যমান সমস্যায় যোগ করতে পারে নতুন মাত্রা। ধরেই নিলাম এখন থেকে ভার্চুয়াল বা অনলাইন কার্যক্রমের মাধ্যমেই অনেক কাজ বাস্তবায়ন করতে হবে। তা হলে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে, এ দেশের কতভাগ লোক ডিজিটাল পদ্ধতি বা কতভাগ মানুষ কম্পিউটার ব্যবহার করে বা ব্যবহার করতে জানে। অনেকেই মনে করে এখন পর্যন্ত দেশের মাত্র শতকরা তিন থেকে পাঁচভাগ মানুষ কম্পিউটার ব্যবহার করে, তবে তার বেশির ভাগ মানুষই মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষা সমাপ্তকারী। অথচ জাপানের মতো দেশে প্রায় ৯১ ভাগ লোক ইন্টারনেট ব্যবহার করে। ভারতের কেরালায় এ হার প্রায় ৫০ ভাগ। তবে আশার কথা, বাংলাদেশে কম্পিউটার টেকনোলজি দ্রম্নত সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সরকার ইতিমধ্যেই প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে কম্পিউটার বিতরণ করতে শুরু করেছে। তবে এসব কম্পিউটার এখনো শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছায়নি। এমন কি বিদ্যালয়ভিত্তিক দু-একজন ব্যতিরেকে শিক্ষকরাও এ প্রযুক্তি ব্যবহারে সক্ষম নন। আবার এমনও শোনা যায়, শিক্ষার্থীদের হাতে গেলে নষ্ট হয়ে যেতে পারে এ অজুহাতে প্রতিষ্ঠানের আলমিরাতেই কম্পিউটারগুলো সংরক্ষিত থাকে। বলা বাহুল্য, এ অবস্থার অবসান ঘটিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে সক্ষম জাতি গঠনের বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। সে যাক, এবারের বিশ্ব যুব দিবসের মূল আলোচনাই হবে যুবসমাজকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরিয়ে আনা এবং কর্মক্ষেত্রে প্রতিস্থাপন করা। অবশ্য ইতিমধ্যেই এ লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে। আইএলও, ইউনেস্কোসহ অনেক সংস্থাই উপর্যুক্ত লক্ষ্যে জনমত সৃষ্টির ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ইউনেস্কোর এক আলোচনায় বলা হয়েছে, সর্বাগ্রে প্রয়োজন কোভিড-১৯ এর স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের মাত্রা নির্ধারণ করা এবং এ তিন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা। দ্বিতীয়ত, কোভিড পরিস্থিতিতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানের উদ্ভাবনী কার্যাবলির তথ্য সন্নিবেশন করা এবং তা বিস্তরণের ব্যবস্থা করা। এ উদ্ভাবনী কাজের আওতাভুক্ত হবে কীভাবে তারা এ মহামারিতে তাদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালিয়ে গিয়েছে, কীভাবে তারা স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনায় এনেছে ও স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা রক্ষা করেছে এবং কীভাবে তারা চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছে ও তাদের চাহিদা অনুসারে কোর্সগুলোকে ঢেলে সাজিয়েছে ইত্যাদি। আইএলও কর্তৃক আয়োজিত গেস্নাবাল সামিটেও এ মহামারি পরিস্থিতিতে কার্যকরভাবে কর্মসংস্থান নিশ্চিতকরণ ও বাড়ানোর লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কিছু ইসু্যর অবতারণা করা হয়েছে। এতে অতিমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে তাদের কর্মসংস্থান এবং এজন্য বিশেষ সহায়তামূলক কর্মসূচি গ্রহণের উপায় উদ্ভাবনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। একই সঙ্গে এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকেও একযোগে কাজ করার আহ্বান জানানো হয়েছে। তপন কুমার দাশ : লেখক