অসৎ জনপ্রতিনিধিদের দৌরাত্ম্যের লাগাম টেনে ধরা সময়ের দাবি

জাতীয় সংসদ দেশের আইন পরিষদ। দেশ পরিচালনার দিকনির্দেশনা আসে জাতীয় সংসদ থেকে। আইনের শাসনের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা নিশ্চিত করে জাতীয় সংসদ। রাষ্ট্র পরিচালনার প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করে জাতীয় সংসদ। জাতীয় সংসদ সদস্যরা তথা আইন পরিষদ সদস্যরা রাষ্ট্রের আইন প্রণেতা। রাষ্ট্রের আইন প্রণেতাদের বিজ্ঞতা-বিচক্ষণতা, সততা, আত্মমর্যাদা সচেতনতা, জনসেবক মানসিকতার গুণে গুণান্বিত হতে হয়। এ গুণগুলো সংসদ সদস্যদের না থাকলে জাতীয় সংসদ বা আইন পরিষদে সঠিক দায়িত্ব পালন করা কঠিন হয়ে পড়ে। সংসদ সদস্যকে নিজের এবং সংসদের দায়িত্ব-মর্যাদা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা জরুরি।

প্রকাশ | ১৬ জুলাই ২০২০, ০০:০০

জহির চৌধুরী
ধীজাতীয় সংসদের লক্ষ্ণীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য (স্বতন্ত্র) কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল গত ৬ জুন রাতে কুয়েতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। জানা গেছে, মানব ও মুদ্রাপাচারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগে কুয়েত সিআইডি (ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট) কাজী শহীদ ইসলাম পাপুলকে গ্রেপ্তার করে ৮ দিন জিজ্ঞাসাবাদ শেষে কারাগারে পাঠিয়েছে। জানা মতে, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের কোনো সদস্য ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে বিদেশের মাটিতে গ্রেপ্তার হওয়ার নজির নেই। কাজী শহীদ ইসলাম পাপুলই এই প্রথম 'নজির' স্থাপন করেছেন। আগেও জাতীয় সংসদের বহু সদস্যের বিরুদ্ধে খুন, বোমাবাজি, সন্ত্রাস, মানবপাচার, মাদক কারবার, নারী কেলেঙ্কারি, টাকাপাচার, ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ, চোরাকারবার, জালিয়াতি, প্রতারণা, জমি-জায়গা দখল, সরকারি বরাদ্দ আত্মসাতের অভিযোগসহ নানা অভিযোগ শোনা গেছে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জামানায় বৃহত্তর সিলেটের একজন সংসদ সদস্যের চোরাকারবার সংশ্লিষ্টতা বেরিয়ে এলে বিষয়টি 'টক অব দ্য কান্ট্রি'তে পরিণত হয়েছিল। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে ওই সংসদ সদস্যকে 'বেসিক্যালি স্মাগলার, বাই চান্স মেম্বার অব পার্লামেন্ট' আখ্যায়িত করেছিলেন। বৃহত্তর নারায়ণগঞ্জের একজন সংসদ সদস্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের খাতায় সন্ত্রাসের গডফাদার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। এ কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার এ সংসদ সদস্যের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করেছে কয়েক বছর আগে। ২০০৬ সালে দুইজন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে জালকাগজপত্রের ভিত্তিতে অন্যের সন্তানকে নিজের সন্তান পরিচয় দিয়ে ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ড পাঠানোর অপচেষ্টার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ঢাকাস্থ ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ড দূতাবাস পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দায়ের করেছিল। ওই সময় ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ড দূতাবাস বিষয়টি ঢাকাস্থ পশ্চিমা দেশের দূতাবাসগুলোকে অবহিত করে বাংলাদেশ সরকারকে চরম বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছিল। দশম সংসদের একজন সদস্য মানব ও মাদকপাচারের গডফাদার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মানব ও মাদকপাচারকারীর তালিকায় এ সংসদ সদস্যের নাম উপরের দিকে রয়েছে। পেছনে তাকালে দেখা যায়, জাতীয় সংসদের বিভিন্ন টার্মে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের অনেকেই গুরুতর অপরাধে জড়িয়ে সংবাদ হয়েছেন, সংসদ সদস্যের ও জাতীয় সংসদের মর্যাদাহানি করেছেন। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের বিভিন্ন সময়ের নির্বাচনে নির্বাচিত সদস্যদের কাউকে কাউকে তাদের অপরাধমূলক কার্যকালাপের পরিপ্রেক্ষিতে 'বেসিক্যালি ক্রিমিনাল, বাই চান্স মেম্বার অব পার্লামেন্ট' বলে থাকেন অনেকেই। কুয়েতে আটক লক্ষ্ণীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্যের অপরাধ-অপকর্মের এ পর্যন্ত যেসব তথ্য-প্রমাণ বেরিয়ে এসেছে তাতে তাকে 'বেসিক্যালি ক্রিমিনাল, বাই চান্স মেম্বার অব পার্লামেন্ট' বলার অবকাশ থাকে। এ দেশ সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ, ফৌজদারি নানা অপরাধে অভিযুক্তরা রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়ে সংসদ সদস্য বনে যান রাতারাতি। এরা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর ক্ষমতার বদৌলতে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেন। মনীষী ড. বার্নাডশ বলেছেন, জাত-বজ্জাতদের মৌলিক চরিত্রে পরিবর্তন হয় না। জাত ক্রিমিনাল বা কালপ্রিট শ্রেণিভুক্তরা সংসদ সদস্যের সম্মানিত পদে অসীন হলেও তাদের মৌলিক চরিত্রে পরিবর্তন হতে দেখা যায় না। ক্রিমিনাল বা কালপ্রিট শ্রেণির লোকজন টাকার জোরে, রাজনৈতিক দলগুলোর আর্শীবাদে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে জাতীয় সংসদের মতো সর্বোচ্চ মর্যাদার প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রকও বনে যাচ্ছে। ২০১৬ সালে জাতীয় পার্টি আয়োজিত এক ইফতার মহফিলে পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেছেন, 'আইনজ্ঞরা আর সংসদ চালায় না, এখন সংসদ চালায় মাদক ব্যবসায়ীরা (২৮.০৬.২০১৬ বাংলাদেশ প্রতিদিন)।' একই বছরের গোড়ার দিকে জাসদের (রব) ত্রিবার্ষিক কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে দলের সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেছেন, 'জাতীয় সংসদ এখন হুন্ডি ব্যবসায়ীদের চেম্বার (২৬.০২.১৬ ইনকিলাব)।' একশ্রেণির সংসদ সদস্যের নৈতিক স্খলন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মর্যাদার প্রতিষ্ঠান জাতীয় সংসদ, সম্মানিত সংসদ সদস্যপদের তো বটেই দেশের রাজনীতির মানমর্যাদাও ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছে। জাতীয় সংসদ দেশের আইন পরিষদ। দেশ পরিচালনার দিকনির্দেশনা আসে জাতীয় সংসদ থেকে। আইনের শাসনের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা নিশ্চিত করে জাতীয় সংসদ। রাষ্ট্র পরিচালনার প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করে জাতীয় সংসদ। জাতীয় সংসদ সদস্যরা তথা আইন পরিষদ সদস্যরা রাষ্ট্রের আইন প্রণেতা। রাষ্ট্রের আইন প্রণেতাদের বিজ্ঞতা-বিচক্ষণতা, সততা, আত্মমর্যাদা সচেতনতা, জনসেবক মানসিকতার গুণে গুণান্বিত হতে হয়। এ গুণগুলো সংসদ সদস্যদের না থাকলে জাতীয় সংসদ বা আইন পরিষদে সঠিক দায়িত্ব পালন করা কঠিন হয়ে পড়ে। সংসদ সদস্যকে নিজের এবং সংসদের দায়িত্ব-মর্যাদা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা জরুরি। \হবিভিন্ন সময়ে লক্ষ্য করা গেছে, সংসদ সদস্যদের অনেকেই সংসদ অধিবেশনের গুরুত্ব বোঝেন না, বুঝলেও আমল দেন না। এক শ্রেণির সংসদ সদস্যের সংসদ বিমুখতা, সংসদীয় কার্যক্রমে অংশগ্রহণে অনীহা প্রকটিত বিষয়। অনেক সংসদ সদস্য সংসদের গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশনেও উপস্থিত থাকার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না। সংসদ সদস্য পদ টিকিয়ে রাখার জন্য হাজিরা খাতায় সই করে সংসদ সদস্যদের অনেকেই উধাও হয়ে যান। সংসদ সদস্যরা সংসদ অধিবেশনে যথাসময়ে উপস্থিত না হওয়ার কারণে কোরাম সংকট দেখা দেয়, নির্ধারিত সময়ে সংসদের অধিবেশন শুরু করা যায় না। এতে রাষ্ট্রের বিপুল অর্থের অপচয় হয়। টিআইবির এক প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী দশম সংসদের প্রথম থেকে শেষ অধিবেশন (২৩টি) পর্যন্ত কোরাম সংকটের কারণে ১৯৪ ঘণ্টা ৩০ মিনিট অপচয় হয়েছে। যার আর্থিক মূল্য ১৬৩ কোটি ৫৭ লাখ ৫৫ হাজার ৩৬৩ টাকা। সংসদ অধিবেশনে উপস্থিত থেকে সংসদ অধিবেশনে মন না দিয়ে গল্প-গুজব করে অধিবেশনের পরিবেশ নষ্ট করতেও দেখা যায় সংসদ সদস্যদের অনেককেই। বর্তমান রাষ্ট্রপতি এডভোকেট আবদুল হামিদ স্পিকার থাকাকালে কতিপয় সংসদ সদস্য সংসদ অধিবেশন চলাবস্থায় গল্প-গুজব করে সংসদ কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটানোর কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে সংসদকে মাছের বাজারে পরিণত না করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কতিপয় সংসদ সদস্য প্রয়োজন না হলেও সরকারি খরচে বিদেশে ভ্রমণের জন্য মরিয়া থাকেন। সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরে সংসদ সদস্যরা ভাগ চান- এমন তথ্য সংবাদ মাধ্যমে এসেছে। প্রত্যেক সংসদ সদস্যকে নির্বাচনী এলাকায় অফিস খরচ বাবদ মাসিক বরাদ্দ দেয়া হয়। কতিপয় সংসদ সদস্য নির্বাচনী এলাকায় অফিস না নিয়েও অফিস খরচ হিসেবে বরাদ্দ করা অর্থ তুলে নেন। এক শ্রেণির সংসদ সদস্যদের নৈতিক স্খলন, মূূল্যবোধের অবক্ষয়ের ফিরিস্তি বলে শেষ করার মতো নয়। এর জন্য দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে বহুলাংশে দায়ী করা যায়। রাজনৈতিক দলগুলো কালো টাকার মালিক, চোরাকারবারি, মাদককারবারি, মানবপাচারকারী, ব্যাংক ঋণ আত্মসাৎকারী, সন্ত্রাসী পরিচিতদের দলে ভেড়ায় কোনো রাখ ঢাক না রেখেই। এদের দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্তি, জাতীয় নির্বাচনে দলীয় টিকিট দেয়া হয় ঢাকঢোল বাজিয়ে। নিবেদিত প্রাণ, ত্যাগী নেতাকর্মীদের চেয়ে দলে এদের কদর-ইজ্জত বেশি দেয়া হয়। দেশের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক অঙ্গন দুর্নীতিবাজ আমলা, সন্ত্রাসী-মাস্তান-খুনি, চোরাকারবারি, মাদক-মানবপাচারকারী, ভূমিদসু্য, ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎকারী, টাকাপাচারকারী, রাজস্ব ফাঁকিবাজ তকমাধারীদের ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে- এটা বাস্তবতা। প্রবীণ রাজনীতিবিদদের অনেককেই মাঝেমধ্যে বলতে শোনা যায়, রাজনীতি এখন আর রাজনীতিবিদদের হাতে নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর 'কৃপা'তেই সংসদ সদস্য-রাজনীতিবিদের নামাবলি জড়িয়ে কালপ্রিট পরিচিতরা দল ও রাজনীতিতে অবস্থান পাকাপোক্ত করে নিতে সক্ষম হচ্ছে; রাজনীতিবিদদের হাতে রাজনীতি থাকছে না। রাজনৈতিক দলগুলো চোরাকারবারি, মাদককারবারি, মানবপাচারকারী, সন্ত্রাসী, ভূমিদসু্য, টাকা পাচারকারী, ব্যাংক ঋণ আত্মসাৎকারী, শেয়ারবাজার লুটেরা, খুনি পরিচিতদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া অব্যাহত রাখলে সামনের দিনগুলোতে সংসদ সদস্যরূপে এদের আরো বেশি সংখ্যায় দেখা যাবে। জেনুইন রাজনীতিবিদ/ সংসদ সদস্য হতে রাজনীতিবিদ/সংসদ সদস্যের গুণাবলি লালন-ধারণ ও বাধ্যতামূলক। বেপরোয়া অপকর্মের সুযোগ হবে মনে করে যারা রাজনীতিবিদ/ সংসদ সদস্য হন, যারা রাজনীতিবিদ/সংসদ সদস্য হওয়ার সুবাদে অবাধে অপকর্ম করার লাইসেন্স পেয়েছেন মনে করেন; তাদের কেউকেই জেনুইন রাজনীতিবিদ বা জেনুইন সংসদ সদস্য বলা যায় না। এদের বলা যেতে পারে 'বেসিক্যালি ক্রিমিনাল, বাই চান্স পলিটিশিয়ান', 'বেসিক্যালি ক্রিমিনাল, বাই চান্স মেম্বার অব পার্লামেন্ট।' 'বেসিক্যালি ক্রিমিনাল, বাই চান্স পলিটিশিয়ান', 'বেসিক্যালি ক্রিমিনাল, বাই চান্স মেম্বার অব পার্লামেন্ট'- এমনদের অনাচার-দুরাচার, অপকর্মে দেশ-জাতি অতিষ্ঠ। এদের উত্থান, দাপট-দৌরাত্ম্যের লাগাম টেনে ধরা সময়ের দাবি। \হ জহির চৌধুরী : কলাম লেখক