মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

নৌপথে নিরাপদ যাত্রা নিশ্চিত করুন

যাত্রীদের নির্বিঘ্ন ও যাত্রাপথ সুন্দর করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, লঞ্চ মালিক সমিতি, বিআইডবিস্নউটিএসহ সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে।
অ্যাডভোকেট মো. সাইফুদ্দীন খালেদ
  ১৭ জুলাই ২০২০, ০০:০০

নদীমাতৃক বাংলাদেশে নৌপথ খুব স্বাভাবিক কারণেই যোগাযোগ ও পরিবহণের গুরুত্বপূর্ণ রুটে পরিণত হয়। ঔপনিবেশিক শক্তির হাত ধরে আসা যান্ত্রিক পরিবহণের সূচনা হয়েছিল এই রুটে। কিন্তু আধুনিককালে এসে বিশ্বের আর সব জনগোষ্ঠী যখন তাদের নৌপথকে আরও নিরাপদ ও কার্যকর করে তোলার দিকে মনোযোগ দিয়েছে, এদিকে আমাদের নৌপথ যেন পড়ে আছে অবহেলিতভাবে। স্থল ও আকাশপথের তুলনায় নৌপথ যদিও অনেক বেশি সাশ্রয়ী। কিন্তু আমাদের নৌপথে প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী যেভাবে প্রাণ হাতে নিয়ে চলাচল করে, সেটা সভ্যতার জন্য পরিহাসই বিবেচিত হচ্ছে। সম্প্রতি রাজধানীর সদরঘাটের শ্যামবাজার এলাকায় বুড়িগঙ্গা নদীতে অর্ধশত যাত্রী নিয়ে মর্নিং বার্ড নামে একটি লঞ্চ ডুবির ঘটনায় ৩৪ জন প্রাণ হারায়। শ্যামবাজার পয়েন্টে ময়ূর-২ নামের লঞ্চের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ডুবে যায় মর্নিং বার্ড নামের লঞ্চটি। ওই ঘটনায় সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলায় বেপরোয়া লঞ্চ চালিয়ে মানুষ হত্যা ও ধাক্কা দিয়ে লঞ্চ দুর্ঘটনার জন্য দন্ডবিধির ২৮০, ৩০৪(ক), ৪৩৭ ও ৩৪ ধারার অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রতি বছর লঞ্চ দুর্ঘটনায় মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ১৯৯১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ২৯ বছরে ৫৭০টি দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৬৫৪ জন মারা গেছেন। এসব ঘটনায় ৫১৬ জন আহত ও ৪৮৯ জন নিখোঁজ হন। এসব দুর্ঘটনার মধ্যে যাত্রীবাহী নৌযানের সংখ্যা ২৩৬টি। ২০১৯ সালে ২৬টি নৌদুর্ঘটনায় তিনজন মারা গেছেন। ৩৩ জন আহত ও ২০ জন নিখোঁজ হন। বিগত বছরগুলোয় বাংলাদেশের বিভিন্ন নদীতে সংঘটিত নৌদুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে নৌযানের ত্রম্নটিপূর্ণ ডিজাইন, ডিজাইন না মেনে নৌযান নির্মাণ, ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত মালপত্র এবং যাত্রী বহন, মাস্টার-সারেংদের অদক্ষতা ও অসতর্কতা, সংঘর্ষ, নদীর নাব্য সংকট, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, নৌযান মালিকদের দায়িত্বহীনতা এবং নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষের অবহেলাকে চিহ্নিত করা হয়। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, দুর্ঘটনার এই কারণগুলো কিন্তু এখনো দৃশ্যমান। বিআইডবিস্নউটির আইন ও নীতিমালা রয়েছে। তবে আইনগুলো সময়োপযোগী করে নেওয়া দরকার। 'দি ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স ১৯৭৬' অধ্যাদেশের পঞ্চম অধ্যায়ের ৫৮ (এ) ধারায় যাত্রী ও ক্রুদের জন্য জীবন বিমার কথা বলা থাকলেও, প্রয়োজনীয় আর্থিক কাভারেজের পরিমাণ উলেস্নখ নেই। এ ছাড়া বিদ্যমান আইনে ফিটনেস সার্টিফিকেট ছাড়া যাত্রী পরিবহণ করা, প্রশিক্ষিত চালক বা ইঞ্জিনিয়ার ছাড়া জাহাজ চালানো অথবা ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল বহন করার জন্য যে ধরনের শাস্তির পরিমাণ নির্ধারণ করা আছে তা অপর্যাপ্ত। ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বহন করার শাস্তি হিসেবে ('দি ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স- ১৯৭৬' ধারা ৬৬-৬৭ অনুযায়ী) দুই থেকে তিন বছর জেল এবং পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে, তা অপ্রতুল। পরিবহণ মালিকদের গাফিলতির কারণে দুর্ঘটনা ঘটা বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। আবহাওয়া মাঝেমধ্যেই বৈরী হয়ে ওঠে। এদিকে নৌপথের সিগনালিং বা সংকেত ব্যবস্থা নাজুক। এর ওপর ফিটনেসবিহীন অসংখ্য নৌযান চলাচল করছে। ঈদের সময় পুরনো ও চলাচলের বৈধতা নেই এমন নৌযানগুলো পালিশ করে যাত্রী পরিবহণ করে ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেকাংশে বাড়িয়ে তোলে। এটা কঠোর হাতে দমন করতে হবে। নৌ-নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য নৌপুলিশ, কোস্টগার্ড, বিআইডবিস্নউটিএর সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী টাস্কফোর্স গঠন করা প্রয়োজন। ত্রম্নটিপূর্ণ, সার্ভেবিহীন ও অনিবন্ধিত লঞ্চসহ সব ধরনের অবৈধ নৌযান চলাচল বন্ধে নৌপরিবহণ অধিদপ্তর ও বিআইডবিস্নউটিএর নিয়মিত অভিযান পরিচালনা; দুর্যোগ মৌসুম বিবেচনায় ঈদের আগে অবৈধ নৌযান চলাচল বন্ধে নৌপথে ভ্রাম্যমাণ আদালত চালু রাখার বিকল্প নেই। লঞ্চের চালক এবং স্টাফদের যথাযথ প্রশিক্ষিত ও লাইসেন্সপ্রাপ্ত হতে হবে। তাদের শারীরিকভাবেও উপযুক্ত থাকতে হবে, যাতে বিপদকালীন সময়ে তারা যাত্রীদের সাহায্য ও দিকনির্দেশনা দিতে পারেন। নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয়ে কারিগরি ও ব্যবহারিক জ্ঞান এবং শারীরিক উপযুক্ততা যাচাইয়ের জন্য নিয়মিত বিরতিতে পরীক্ষা করতে হবে। সীমিতসংখ্যক যাত্রীবাহী লঞ্চের কারণে প্রতিনিয়ত লঞ্চে ওভারলোডিং হয়ে থাকে। এই ওভারলোডিং থেকে যাত্রীদের বিরত রাখা অত্যন্ত কঠিন। এ ক্ষেত্রে আইন রয়েছে তা অত্যন্ত দুর্বল। লঞ্চ দুর্ঘটনা এড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের বিকল্প নেই। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় লঞ্চ চলাচল না করা। এ ক্ষেত্রে আবহাওয়া বার্তা মেনে চললে দুর্ঘটনার সমূহ সম্ভাবনা এড়ানো যাবে। যাত্রীবাহী বৈধ লঞ্চের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। উন্নততর লঞ্চ সার্ভিস চালু করতে হবে। নৌ-পরিবহণের উন্নয়নের জন্য এই খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। নৌপথে ট্রাফিক সিস্টেমের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। নিরাপত্তাব্যবস্থাকে আরও আধুনিক করতে হবে। বিআইডবিস্নটিএর উপকূলীয় দ্বীপসমূহে সার্ভিসের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। আমরা মনে করি, নৌযানের বিজ্ঞানসম্মত নকশা ও ধারণক্ষমতা সম্মত যাত্রী উত্তোলন নিশ্চিত করা গেলে নৌ-দুর্ঘটনা অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে আসবে। এ ব্যাপারে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় ও নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। নৌপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তাদের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। অবশ্যই সার্ভেয়ারের সংখ্যা বাড়াতে হবে। সি-সার্ভে সনদ ছাড়া যাতে কোনো নৌযান চলাচল করতে না পারে, সেজন্য নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হবে।

যাত্রীদের নির্বিঘ্ন ও যাত্রাপথ সুন্দর করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, লঞ্চ মালিক সমিতি, বিআইডবিস্নউটিএসহ সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে।

অ্যাডভোকেট মো. সাইফুদ্দীন খালেদ : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<106083 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1