করোনা ও অর্থনীতি

দেশের সার্বিক অর্থনীতির ইতিবাচকতা ধরে রাখতে হলে মানবসম্পদকে রোগমুক্ত রাখাটা বেশি দরকার। তাই প্রতিষেধক ব্যবস্থার আগে যদি সংক্রমণটি প্রতিরোধ করা যায়, তাহলে অর্থনীতির জন্যও এটি ইতিবাচক হবে।

প্রকাশ | ১৮ জুলাই ২০২০, ০০:০০

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে দেখা দিয়েছে মন্দাভাব। পৃথিবীর ২১৩টি দেশের মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। প্রতিটি দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার কমে যাবে বলে অর্থনীতিবিদরা ধারণা করছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে করোনার বিরূপ প্রভাব মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে। করোনার কারণে দেশের বেকারত্বের হার বাড়ছে। ছোট ছোট কলকারখানা এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থনীতির বিরূপ প্রভাবের কারণে থমকে গেছে; এ সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরতরা চাকরি হারাচ্ছেন। শহরমুখী কাজের আশায় ছুটে আসা মানুষ এখন উল্টো পথে চলছেন। শহরের কাজ হারিয়ে তারা এখন গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির বর্তমান ব্যবস্থায় এই বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। ফলে এর বিরূপ প্রভাব গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থায় দেখা দিতে পারে। বাংলাদেশে করোনা রোগী শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। সরকার ২৫ মার্চ সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেন। এই ছুটি ঘোষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল সবাই ঘরে থাকবে আর ঘরে থাকলে করোনাভাইরাসটি ছড়াতে পারবে না। ২৫ মার্চের আগেই দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি ঘোষণা করা হয়। মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা মূলত জুন পর্যন্ত বন্ধ থাকে। সেই সময় ইউরোপের দেশগুলোতে করোনা মহামারি হ্রাস পেতে শুরু করে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পোশাক শিল্পের রয়েছে অন্যতম অবদান। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের বড় বাজার হলো ইউরোপ। সারাদেশ কার্যত যখন বন্ধ, সেই সময় ইউরোপের বায়াররা এ দেশ থেকে পোশাক কেনার আগ্রহ প্রকাশ করে। তাদের এই আগ্রহে সারা দিয়ে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেই রাজধানীসহ আশপাশের জেলাগুলোতে অবস্থিত পোশাক কারখানাগুলো খুলে দেয়া হয়। গ্রামে চলে যাওয়া পোশাক শ্রমিকরা আবার ফিরে আসেন কর্মস্থলে- তবে এই ফিরে আসাটা ছিল তাদের জন্য খুবই কষ্টকর। কারণ পরিবহণ বন্ধ থাকায় পায়ে হেঁটে বা অন্য যানবাহন ব্যবহার করে তারা কাজে যোগ দেয়। করোনার কারণে সারাদেশে ২৫ মার্চ থেকে শুরু হয়ে ১ জুন পর্যন্ত সাধারণ ছুটি পালন করা হয়। এত দীর্ঘ সময় ছুটির পালন করে সরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে কি করোনাভাইরাস সংক্রমণের লাগাম টেনে ধরা গেছে? বর্তমান পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে যে, করোনাভাইরাস উত্তরোত্তর বৃদ্ধিই পেয়েই চলেছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণ রুখতে সারা বিশ্বের দেশে দেশে লকডাউন ঘোষণা করা হয় অপরদিকে বাংলাদেশে ঘোষিত হয় সাধারণ ছুটি। সাধারণ ছুটি এবং লকডাউন শব্দ দুটির অভিধানিক অর্থ এক না। সাধারণ ছুটি অনেকটা অবকাশ যাপনের বিষয়। তাই দেখা গেছে, সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর মানুষ ঈদ আনন্দে গ্রামে ফিরেছিল। ওই সময় গ্রামে ফেরা সময়টিতে সামাজিক দূরত্বটি কেউ বজায় রাখেনি, ফলে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস। তাই বর্তমানে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে রাজধানী পর্যন্ত সংক্রমণের ব্যাপকতা মহামারির রূপ ধারণ করছে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল রাখার উদ্দেশ্যে বেসরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখা হয় সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির মাধ্যেই। এই খোলা রাখার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা কতটা স্থিতিশীল রাখতে পেরেছে এ দেশের শিল্প মালিকরা? বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ, সার্বিক দিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, হাজার হাজার পরিবার রাজধানী ঢাকা ছাড়ছে? ঢাকা ত্যাগের মূল কারণ এই মানুষ যে সব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহে কর্মরত ছিলেন সেই সমস্ত প্রতিষ্ঠান তাদের কাজে রাখতে পারছেন না। প্রশ্ন হলো, সাধারণ ছুটির সময় অর্থনীতি সচল রাখার নামে এই প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা রেখে তাহলে কী লাভ হলো? সারাদেশে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার মানুষের দেহে করোনাভাইরাসটি রয়েছে বলে দেশের পিসিআর ল্যাবগুলোতে শনাক্ত করা হয়; অপর দিকে প্রায় দুই হাজার মানুষ প্রাণ হারায় করোনার করাল থাবায় (৪-৭-২০২০ তারিখ পর্যন্ত)। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে যে, সারাদেশে সুস্থতার হার বাড়ছে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সবাই কর্মক্ষম। যারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলেন, তাদের সুস্থ হয়ে কাজে ফিরতে সময় লাগছে কমপক্ষে একমাস করে। এক লাখ ৬০ হাজার কর্মক্ষম মানুষ রোগে ভুগছেন, তাদের আরোগ্য করে তোলার জন্য অর্থ ব্যয় হচ্ছে। অপর দিকে এই বিপুলসংখ্যক শ্রম সম্পদ অসুস্থ থাকার কারণে উৎপাদন কর্মকান্ডে অংশ নিতে পারছেন না ফলে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অর্থনীতি সচল রাখার নামে এই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো খোলে দেয়ার ফলে আজকে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে বারোটা বাজল। করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য প্রথমেই যদি প্রতিটি মানুষ যে যেখানে রয়েছে সেই স্থানে অবস্থান করার কঠোর নির্দেশনা দিয়ে ২৫ মার্চ থেকে এক মাসের জন্য সারাদেশে লকডাউন ঘোষণা করে কারফিউ জারি করা যেত, তাহলে হয়তো আজকের এই ভয়াবহ রূপ দেখতে হতো না। ওই কঠিন কারফিউ মধ্যেই শনাক্ত হয়ে যেত কারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত আর কারা করোনামুক্ত। আক্রান্তদের যদি আইসোলেশনে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হতো তবে আর মুক্তদের আক্রান্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। অথচ সারাদেশে ছুটিও পালিত হলো দীর্ঘ সময়, সরকারি ব্যয়ও বাড়ল এবং করোনাভাইরাসের কবল থেকে মানুষকে বাঁচানোর জন্য নেয়া হলো নানা পদক্ষেপ। এর ফলে ভয়াবহ রূপ কতটুকু ঠোকানো গেল তা অদূরভবিষ্যতই বলে দেবে। পৃথিবীর বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র কারফিউ জারির মাধ্যমে নিজেদের করোনামুক্ত হিসেবে ঘোষণা করতে পেরেছে স্বল্পসময়ের মধ্যেই। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশ যদি এ ধরনের কঠিন ব্যবস্থা নিত তাহলে তেমন কোনো বিরূপ প্রভাব দেখা যেত না। পৃথিবীর যে কোনো উৎপাদন ব্যবস্থায় তার মূল উপাদান হলো শ্রমসম্পদ আর এই শ্রমসম্পদ যদি সুস্থ না থাকে তাহলে যে কোনো ধরনের উৎপাদন বাধা প্রাপ্ত হবে আর অর্থনীতি কখনোই স্থায়িত্বশীল রূপ নেবে না। করোনার প্রাদুর্ভাবের প্রাক্কালে অর্থনীতি সচল রাখার নামে যে সব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল তা ছিল সামষ্টিক অর্থনীতির জন্যই নেতিবাচক। সারাদেশে বিপণি বিতানসহ বিভিন্ন ধরনের দোকানপাট বন্ধ ছিল (ওষুধ এবং খাদ্যসামগ্রীর দোকান ব্যতীত)। গত রোজার ঈদে তা খুলে দেয়া হয়। এই খোলে দেয়ার ফলে কি দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে? একটি বিষয় পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, রাজশাহী মহানগরীতে রোজার ঈদের আগে দুই থেকে তিনজনের দেহে করোনাভাইরাস পজেটিভ শনাক্ত হয়। ঈদকে কেন্দ্র করে মার্কেট খুলে দেয়ার ফলে রাজশাহীর বাহির থেকে লোকজন নগরীতে প্রবেশ করতে শুরু করে তখনই বাড়তে থাকে এই ভাইরাসটির প্রকোপতা। গত ১০ দিনে রাজশাহী মহানগরীতে করোনা পজেটিভ রোগী শনাক্ত হয় প্রায় সাড়ে ৪শর ওপরে এবং মারা গেছে প্রায় ১০ জনের মতো (০৪-০৭-২০ তারিখ পর্যন্ত)। বর্তমানে করোনাভাইরাসটি এই মহানগরীতে কমিউনিটি ট্রান্সফিশনের রূপ নিয়েছে। পরীক্ষা করা হয়নি এরকম করোনার উপসর্গ জ্বর- সর্দি-কাশি-শ্বাসকষ্ট আক্রান্ত রোগী প্রতিটি মহলস্নাতেই রয়েছে। তাছাড়া পরীক্ষার জন্য নমুনা দেয়া হলে, দুই দিন থেকে পাঁচদিন কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৭ দিনের আগে ফলও পাওয়া যায় না। ফলে দেখা যায়, ভাইরাস বহনকারী ব্যক্তিটি অবাধেই চলাচল করছে, কারণ তার হাতে এখনো পজেটিভ বা নেগেটিভ রিপোর্ট আসেনি, এই কারণেও দ্রম্নত আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে রাজশাহী মহানগরীতে। ঈদের সময় বহিরাগতদের সমাগম ঘটে বেশি আর সেই সময় মাত্র কটাদিন মার্কেটগুলো খুলে রাখার ফলে রাজশাহীর অর্থনীতিতে যে ইতিবাচক রূপ দেখা দিয়েছিল তার চেয়ে বেশি অর্থ এখন ব্যয় হচ্ছে আক্রান্ত ব্যক্তিদের আরোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রে। সুতরাং এ ধরনের কৌশল নিয়ে অর্থনীতি সচল করার লক্ষ্যে পদক্ষেপ নিলে ব্যক্তির অর্থনীতির কিছুটা লাভ হলেও সামষ্টিক অর্থনীতি দীর্ঘ সময়ের জন্য নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাই এ রকম সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সামষ্টিক অর্থনীতির বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া উচিত। লকডাউনের ফলে যে ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়, তা দেখা গেছে, রাজধানীর টোলারবাগ এবং পশ্চিম রাজাবাজার লকডাউন করার মধ্য দিয়ে। ময়মসিংহ জেলার হবিরবাড়ী ইউনিয়ন (শিল্পাঞ্চল) লকডাউনের কারণে ভালুকা উপজেলায় সংক্রমণের হার কমেছে আগের চাইতে অনেক। আসন্ন কোরবানির ঈদে গরুর হাটকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে করোনাভাইরাসটির প্রাদুর্ভভাব আবার বেড়ে যাবে এবং সারাদেশে এটি দীর্ঘ মেয়াদি রূপ নিতে পারে। করোনা সংক্রমণ নিরসনে লকডাউন ব্যবস্থাটি জরুরি। দেশের সার্বিক অর্থনীতির ইতিবাচকতা ধরে রাখতে হলে মানবসম্পদকে রোগমুক্ত রাখাটা বেশি দরকার। তাই প্রতিষেধক ব্যবস্থার আগে যদি সংক্রমণটি প্রতিরোধ করা যায়, তাহলে অর্থনীতির জন্যও এটি ইতিবাচক হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অবস্থা বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায়, করোনাভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে প্রতিরোধ ব্যবস্থাটাই জরুরি। তাই রেড জোন নির্ধারণ করে দ্রম্নত লকডাউন করাটাই এখন বেশি প্রয়োজন। শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : কলাম লেখক