অনিশ্চিত গন্তব্যে চামড়াশিল্প

দেশের চামড়াশিল্প রপ্তানি পণ্যের তালিকায় উলেস্নখযোগ্য একটি নাম। তৈরি পোশাক, ওষুধসহ আরও কিছু পণ্যের মধ্যে রপ্তানি তালিকায় চামড়াজাত পণ্য অর্থনীতিতে বড় ধরনের ভূমিকা রেখে আসছে। বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে রপ্তানিমুখী চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বড় ধরনের অবদান ছিল। সেই রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল চামড়াকে গত বছর পানির দামে বিক্রি করতে হয়েছে। ক্রেতার অভাবে কোথাও কোথাও চামড়া পচে নষ্ট হয়ে গেছে, আবার কোথাও বা মাটিচাপা দিতে হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেন এই চামড়াশিল্পের অধোনমন?

প্রকাশ | ২০ জুলাই ২০২০, ০০:০০

হোসাইন মুবারক
অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এবার দেশের চামড়াশিল্প সংকটের মুখে। দেশি ও বৈশ্বিক মিলে এবারের সংকট আরও জটিল আকার ধারণ করতে পারে। সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল যদি এখনই তৎপর না হয় তাহলে আসন্ন ঈদুল আজহা উপলক্ষে সংগৃহীত হতে যাওয়া চামড়া মারাত্মক মূল্য-বিপর্যয়ে পড়তে পারে।. এ দেশের প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায় হচ্ছে মুসলমান। তাদেরই বড় উৎসব ঈদুল আজহা। এই ঈদকে ঘিরে দেশের অর্থনীতি স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে। বিশেষ করে কোরবানির পশু কেনাবেচা থেকে শুরু করে জবাই করা পশুর চামড়ার বেচাকেনা দেশের অর্থনীতির প্রধান অনুষজ্ঞ হয়ে যায়। চামড়াশিল্পের জন্য সারা বছর যে কাঁচামাল সংগৃহীত হয়, তার ৬০ শতাংশই এই ঈদকে কেন্দ্র করে কোরবানি করা পশু থেকে আসে। যার ফলে দেশজুড়ে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়। ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে নিম্নবিত্ত পর্যন্ত সবার হাতে এই কোরবানির চামড়ার টাকা চলাচল করে। দেশের চামড়াশিল্প রপ্তানি পণ্যের তালিকায় উলেস্নখযোগ্য একটি নাম। তৈরি পোশাক, ওষুধসহ আরও কিছু পণ্যের মধ্যে রপ্তানি তালিকায় চামড়াজাত পণ্য অর্থনীতিতে বড় ধরনের ভূমিকা রেখে আসছে। বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে রপ্তানিমুখী চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বড় ধরনের অবদান ছিল। সেই রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল চামড়াকে গত বছর পানির দামে বিক্রি করতে হয়েছে। ক্রেতার অভাবে কোথাও কোথাও চামড়া পচে নষ্ট হয়ে গেছে, আবার কোথাও বা মাটিচাপা দিতে হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেন এই চামড়াশিল্পের অধোনমন? \হচামড়াশিল্পে ধস নামার উলেস্নখযোগ্য কারণ যে শুধু এবারের করোনাভাইরাস, তা কিন্তু নয়। আমাদের দেশে এই শিল্পে বিপর্যয় শুরু হয়েছে আরও আগে। ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা নদীকে দূষণের জন্য দায়ী করা হতো সেই সময়ে হাজারীবাগে গড়ে ওঠা চামড়াশিল্পের প্রায় ২০০ কারখানাকে। চামড়াশিল্পের বর্জ্যের জন্য কালক্রমে এই হাজারীবাগই বিশ্বের অন্যতম দূষিত স্থানের তালিকায় স্থান করে নিয়েছিল। এসব ট্যানারি কারখানার বর্জ্য কোনো রকম প্রক্রিয়া ছাড়াই সরাসরি গিয়ে পড়ত রাজধানীর প্রাণ নামে খ্যাত বুড়িগঙ্গা নদীতে। এই বুড়িগঙ্গা রক্ষার জন্য সরকারের কঠোর পদক্ষেপে ও দীর্ঘ প্রচেষ্টায় সাভারের হরিণধরায় চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তোলা হয়। নানা অজুহাতে দফায় দফায় সময়ক্ষেপণের পর অবশেষে সাভারে স্থানান্তরিত হয় চামড়াশিল্পের কারাখানাগুলো। যদিও অবকাঠামোগত কারণে ওইসব কারখানা কয়েক বছরেও পরিপূর্ণভাবে এখনো উৎপাদনে যেতে পারেনি। ফলে চামড়াশিল্পে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। এ কারণে ২০১৭ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত চামড়াশিল্প বিশ্ববাজারে ভালো কোনো বাণিজ্যিক সাফল্য দেখাতে পারেনি। এই সময়কাল থেকে এখন পর্যন্ত ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকার প্রক্রিয়াজাত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য অবিক্রীত অবস্থায় মালিকদের গুদামেই পড়ে রয়েছে। আর এই দীর্ঘ সময়ে এই শিল্পের অনুকূলে ব্যাংক ঋণের সুদ হয়েছে ২৫০-৩০০ কোটি টাকা। শুধু তা-ই নয়, চামড়াশিল্পের অনুকূলে আরও ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার ঋণের সংবাদ পত্রিকায় এসেছে, যার বিপরীতে সুদই দাঁড়িয়েছে ৭০০ কোটি টাকা। যার ফলে এই শিল্পের উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা এখন ঋণের ভারে নু্যব্জ। এখন তারা না বিক্রি করতে পারছেন পণ্য, না পরিশোধ করতে পারছেন ব্যাংকের ঋণ। ফলে এবারও তাদের পক্ষে ব্যাপক মাত্রায় কাঁচা চামড়া কেনা প্রায়ই অনিশ্চিত। সরকারের শুভ উদ্যোগের অংশ হিসেবে চামড়াশিল্পের সংকট উত্তরণে গত বছরের অক্টোবরে চারটি মন্ত্রণালয় ও বেশ কয়েকটি বিভাগের সমন্বয়ে উচ্চপর্যায়ের একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়। গত ফেব্রম্নয়ারিতে টাস্ক ফোর্সের একটি সভাও করা হয়। ঈদের এক মাস আগে চামড়ার দাম নির্ধারণ ও চামড়া ক্রয়ে প্রয়োজনীয় অর্থ ছাড়সহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্তগুলোর বেশির ভাগই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। শুধু তাই নয়- ২২ জুন চামড়াশিল্পের আর্থিক সমস্যা নিয়ে অনলাইন সভা হয়েছে। ২৯ জুন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে চামড়াশিল্পের সংকট নিরসনে আরও একটি সভাও করা হয়। চামড়া কেনার বিষয়ে অর্থঋণ নিশ্চিত করার বিষয়ে আলোচনাও হয়। কিন্তু কাজের কাজ কতটা হয়েছে, সেটা আজও প্রশ্ন হয়ে রয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে যদি আলোচিত সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়িত না হয়, ব্যাংক খাতের বিষয়গুলো যদি শর্তের বেড়াজালে আটকে থেকে যায়, তাহলে চামড়াশিল্পের এবারের সংকট হবে আরও ভয়াবহ। চামড়াশিল্পে দেশি সংকটের পাশাপাশি বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে করোনাভাইরাস। এ ভাইরাসের কারণে বিশ্বের চামড়ার প্রধান বাজার চীন, আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, হংকং ও ইতালিতে রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। তা ছাড়া চীন-আমেরিকা বাণিজ্য বিরোধে চামড়াজাত পণ্যের ওপর বাড়তি সংকট তৈরি করেছে। চীনের চামড়াপণ্যের প্রধান ক্রেতা আমেরিকা। চীন পণ্য উৎপাদন করে আমেরিকায় রপ্তানি করত। অভ্যন্তরীণ বিরোধে জড়িয়ে চীন আমেরিকায় রপ্তানিবাজার হারিয়েছে। আর চীনের চামড়াপণ্যের জন্য বেশির ভাগ কাঁচামাল আমদানি হতো বাংলাদেশ থেকে। এখন যেহেতু চীনের চামড়াপণ্যের বাজার মন্দা, সেহেতু আমাদের রপ্তানিতেও নেমে এসেছে স্থবিরতা। যার ফলে এ দেশের চামড়াশিল্পের পথ আরও একধাপ সংকুচিত হয়ে গেছে। এ দেশে কোরবানি থেকে সংগৃহীত চামড়ার মূল্য বেশির ভাগ চলে যায় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোয়। বিশেষ করে এতিমখানা, মাদ্রাসা, ফকির-মিসকিন, হতদরিদ্র মানুষ সাহায্য হিসেবে চামড়া বিক্রির টাকা পেয়ে থাকে। এতে প্রান্তিক অতি দরিদ্র শ্রেণির মানুষই বেশি উপকৃত হয়। এক অর্থে চামড়া বিক্রির অর্থ দারিদ্র্য নিরসনে কিছুটা হলেও সহায়ক হয়ে থাকে। সংগৃহীত চামড়াগুলো অধিক নিম্নমূল্যে বিক্রি হলে কিংবা অবিক্রীত অবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে শিল্পের পাশাপাশি দরিদ্রদের সহায়তার চেইনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বঞ্চিত হয় সাহায্য প্রত্যাশী অসহায় মানুষ। এবার সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককে ৩ শতাংশ সুদে ৫০০ থেকে ৬০০ কোটি টাকা চামড়া ক্রয়ে ঋণ দেওয়ার পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। এই ঋণ-সহায়তা চামড়াশিল্পকে উজ্জীবিত করতে কতটা সহায়ক হবে তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। তবে ট্যানারি ব্যবসায়ীরা বিগত তিন-চার বছরে সৃষ্টি হওয়া জটিলতা থেকে মুক্তি পেতে চামড়াশিল্পের ঋণের সুদ থেকে মুক্তি এবং ঋণ মওকুফের দাবি জানিয়ে আসছেন। অথবা ওই ঋণগুলো দীর্ঘ সময়ের জন্য বস্নক অ্যাকাউন্টে রাখার দাবি জানিয়েছেন। এখন তাদের দাবিগুলো কতটা যৌক্তিকতা- এই দাবিগুলোর বাস্তবিক কোনো ভিত্তি আছে কিনা, তাও ভেবে দেখা দরকার। কারণ, রাজধানীর পরিবেশের সুরক্ষায় কারখানা স্থানান্তরের কবলে পড়ে এই শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশি, যার কারণে দেশীয় চামড়াশিল্পের মূল্য বিপর্যয়, এটাও এই সংকট মুহূর্তে ভেবে দেখার দাবি রাখে। আসন্ন ঈদে সময়মতো শ্রেণিভেদে পশুর চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়াও দরকার ছিল। সেই সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা মাঠপর্যায়ে পর্যবেক্ষণমূলক পদক্ষেপ নেওয়াও প্রয়োজন ছিল। এ ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে কাঁচা চামড়া কিনে দুই-তিন মাসের জন্য গুদামজাত করে সংকট মোকাবিলা করার যে আলোচনা উঠেছিল, তাও ভেবে দেখা দরকার। আসলে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এ শিল্পকে সুরক্ষা দিতে হলে সরকারকে এই জটিলতাগুলো নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। সভার পর সভা করে যে সিদ্ধান্তহীনতা রয়ে গেছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এই সব বিষয় সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলকে এখনই ভেবে দেখতে হবে। তাহলে হয়তো আসন্ন ঈদে ন্যায্যমূল্যে চামড়া সংগ্রহ কিছুটা সংকটমুক্ত হতে পারে। হোসাইন মুবারক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট