পাঠক মত

তুরস্কে ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং সম্প্রীতি

প্রকাশ | ২০ জুলাই ২০২০, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
তুরস্কের ইস্তাম্বুলে অবস্থিত বিখ্যাত একটি ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শন হচ্ছে আয়া সোফিয়া (ঐধমরধ ঝড়ঢ়যরধ)। কালের পরিক্রমায় স্থাপনাটি কখনো অর্থোডক্স গির্জা, কখনো বা ক্যাথলিক গির্জা, আবার কখনো মসজিদ, এমনকি জাদুঘর হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক কর্তৃক আয়া সোফিয়াকে মসজিদ থেকে জাদুঘরে রূপান্তরের সিদ্ধান্তকে সম্প্রতি তুরস্কের সাংবিধানিক আদালত অবৈধ ঘোষণা করে। আদালতের এই রায়ের পরে তুরস্কের রাষ্ট্রপতি এরদোগান আয়া সোফিয়াকে পুনরায় মসজিদে রূপান্তর সংক্রান্ত নির্দেশনা জারি করেন। এই নির্দেশনা জারির পর থেকেই আয়া সোফিয়া এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। আয়া সোফিয়াকে ঘিরে রয়েছে পনের শত বছরের জটিল ইতিহাস। বর্তমান আয়া সোফিয়া নির্মাণ করিয়েছিলেন তৎকালীন বাইজেন্টাইন অধিপতি সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ান। প্রতিষ্ঠার পর থেকে দীর্ঘ ছয় শতাধিক বছর ধরে অর্থোডক্স গির্জা হিসেবে ব্যবহৃত হয় এটি। চতুর্থ ক্রুসেডের সময় কন্সট্যান্টিনোপল (বর্তমান ইস্তাম্বুল) শহরে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায় ক্যাথলিক খ্রিস্টানরা। বলা হয়ে থাকে, ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের হাতে অর্থোডক্স খ্রিস্টান হত্যার এই নারকীয়তা হালাকু চেঙ্গিস খানের বাগদাদ দখল পরবর্তী বীভৎসতাকেও হার মানিয়েছিল। এই সময়েই তারা অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের সবচেয়ে বড় এই গির্জা দখল করে নেয় এবং জোরপূর্বক আয়া সোফিয়াকে ক্যাথলিক গির্জায় রূপান্তর করে। এই ঘটনার ৫৭ বছর পরেই, রোমের পালাইলোগাস রাজবংশের অষ্টম মাইকেলের হাত ধরে ১২৬১ সালে আয়া সোফিয়া পুনরায় অর্থোডক্স গির্জায় পরিণত হয়। এর ১৯২ বছর পরে ইতিহাসের বাঁক বদলে কন্সট্যান্টিনোপল দখলে আসে উসমানীয় (ঙঃঃড়সধহ) সুলতানদের। ১৪৫৩ সালে সুলতান ফাতিহ মুহাম্মদ কন্সট্যান্টিনোপল জয় করার পরে যাজকদের কাছে আয়া সোফিয়া ক্রয়ের প্রস্তাব দেন। যাজকরা রাজি হলে নিজের ব্যক্তিগত সম্পদের বিনিময়ে তিনি আয়া সোফিয়া কিনে নেন। এই ক্রয়ের সঙ্গে সুলতানের প্রশাসনিক কোনো সম্পর্ক ছিল না। লেনদেনটি ক্রয় ও স্বত্বত্যাগের একটি চুক্তির মাধ্যমে নথিভুক্ত করা হয়েছিল এবং মূল্য পরিশোধ করা হয়েছিল ভাউচারের মাধ্যমে। এরপর সুলতান আয়া সোফিয়াকে মসজিদ হিসেবে ওয়াকফ করেন এবং লিখিত দলিলে অসিয়ত করে যান এটিকে পরিবর্তন না করার। যা আল- জাজিরা এবং তুরস্কের অসংখ্য গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক তুরস্কের রাষ্ট্রপ্রধান হলে উসমানীয় সম্রাজ্য বিলুপ্ত করেন। পশ্চিমা ধাঁচের ধর্মনিরপেক্ষতা রপ্ত করে ইউরোপীয় সমাজের অংশ হওয়ার খায়েশে এসময় তিনি তুরস্কের ইসলামী রীতিনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, এমনকি স্থাপনাতেও ব্যাপক পরিবর্তন আনেন। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৩৫ সালে আয়া সোফিয়াকে মসজিদ থেকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করেন। এরপর প্রায় ৮৫ বছর পরে আদালতের রায়ের মাধ্যমে মসজিদ হিসাবে আয়া সোফিয়ার পুনঃঅভিষেক ঘটেছে। তবে এটা সত্য যে, জন্ম থেকেই আয়া সোফিয়া ক্ষমতার রাজনীতিতে একটি রাজনৈতিক কাঠামো হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে বারবার। অর্থোডক্সরা এটিকে ব্যবহার করেছে ক্যাথলিকদের বিরুদ্ধে নিজেদের বড়ত্ব প্রমাণে। আবার ক্যাথলিকরা তা দখল করে অর্থোডক্সদের বিরুদ্ধে মনস্তাত্ত্বিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। এরপর উসমানীয় সুলতান কন্সট্যান্টিনোপল জয় করে যাজকদের থেকে কিনে নিয়ে আয়া সোফিয়াকে রূপান্তরিত করেন মসজিদে। আবার উসমানীয় সালতানাত বিলুপ্ত করে মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক এটিকে জাদুঘরে পরিণত করে স্থাপনাটির চূড়ান্ত রাজনৈতিক ব্যবহারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। মূলত ইস্তাম্বুল যখন যাদের দখলে এসেছে তারা তাদের মতো করেই ব্যবহার করেছে আয়া সোফিয়াকে। আবার এরদোগান কর্তৃক আয়া সোফিয়াকে মসজিদ হিসেবে পুনঃঅভিষেক ঘটানোকেও রাজনৈতিকভাবেই দেখছেন অনেকে। তারা বলছেন, ভোট ব্যাংক রক্ষা করতে এবং তুরস্কের জনগণের মার্কিনবিরোধী আবেগকে সমর্থন করেই মূলত এরদোগানের এই সিদ্ধান্ত। কারণ সম্প্রতি একটি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, তুরস্কের ৭৫% নাগরিক আয়া সোফিয়াকে মসজিদ হিসেবে চায়। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী স্বীকৃতির বিষয়টি তুরস্কের সেকুলার কিংবা রক্ষণশীল সমাজের কেউই মানতে পারেনি। আর তাই যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, গ্রিসসহ বেশ কিছু দেশের বিরোধিতা সত্ত্বেও আয়া সোফিয়াকে পুনরায় মসজিদে রূপান্তরিত করলেন তিনি। তুরস্কে ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং সম্প্রীতির এক দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। ফলে এই সিদ্ধান্তের ফলস্বরূপ তুরস্কে অভ্যন্তরীণভাবে বড় ধরনের ধর্মীয় সংঘাতের সম্ভাবনা আপাতত নেই। তবে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে কিছুটা প্রভাব পড়া অস্বাভাবিক নয়। তবে বহুল আলোচিত এই সিদ্ধান্তের পরিণতি কি হবে তা সময়ই বলে দেবে। এস এ এইচ ওয়ালীউলস্নাহ শিক্ষার্থী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া