সড়ক দুঘর্টনা : এ মৃত্যু চলতেই থাকবে?

সড়ক দুঘর্টনা শব্দটি বতর্মানে আমাদের এত বেশি শুনতে হয় যে বিষয়টা খুব বেশিক্ষণ মাথার মধ্যে থাকে না। দুঘর্টনা শব্দটি দিয়েই প্রতিটি ঘটনাকে দঁাড় করানো হচ্ছে। কিন্তু কতদিন? এভাবে দায়িত্বে অবহেলাকে দুঘর্টনা বলে চালিয়ে দেয়া যাবে আর কতদিন?

প্রকাশ | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০

অলোক আচাযর্্য
আমরা তো আমাদের দেশে সড়ক দুঘর্টনা শব্দটি শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। প্রত্যেক ঈদের পরেই যাত্রী কল্যাণ সমিতি সড়ক দুঘর্টনার সংখ্যা, আহত ও নিহতের সংখ্যা প্রকাশ করে থাকে। এবছরের কোরবানির ঈদের পরেও করেছে। এবছর ১৩ দিনে ২৫৯ জন সড়ক দুঘর্টনায় নিহত হয়েছে। প্রতি ২৪ ঘণ্টায় প্রায় ২০ জন করে সড়ক দুঘর্টনায় মারা গেছে। উন্নত বিশে^র দেশেও সড়ক দুঘর্টনা ঘটে। সেসব উন্নত দেশে সড়ক দুঘর্টনা মানেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রাইভেট গাড়ি দুঘর্টনার কবলে পড়া। বাসও দুঘর্টনার কবলে পড়ে তবে তার সংখ্যা অনেক অনেক কম। আমাদের দেশে সড়ক দুঘর্টনা মানে বাস, ট্রাক, নছিমন এসব। সম্প্রতি বুলগেরিয়ায় বাস দুঘর্টনার ঘটনায় সে দেশের তিন মন্ত্রীকে বরখাস্ত করা হয়েছে। অনেকেই বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন। সেই মন্ত্রীত্রয়ও তাদের ব্যথর্তার দায় স্বীকার করে নিয়েছেন। তার অথর্ এই নয় যে আমি বলতে চাইছি আমাদের দেশেও সড়ক দুঘর্টনার দায় নিয়ে পদত্যাগ করতে হবে। কারণ এতে আমাদের দেশের কোনো সমস্যার সমাধান হবে না। সে দেশের আইন এবং তার প্রয়োগ এবং সেই সঙ্গে সচেতনতা এক রকম আর আমাদের দেশের আইন তার প্রয়োগ এবং জনগণের সচেতনতার ধরন আলাদা। চাইলেই আমরা সব বদলে ফেলতে পারি না। তবে চাইলেই মনমানসিকতা বদলাতে পারি। যেমন নিজের ভুল স্বীকার করার অভ্যাস। কয়েকদিন আগে রাজধানীতে বাসচাপায় দুই শিক্ষাথীর্ মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। বাসচালক আরেক বাসের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বাস চালাতে গিয়ে শিক্ষাথীের্দর শরীরের ওপর গাড়ি তুলে দিয়েছে। যার ফলে ঘটনাস্থলেই দুজন শিক্ষাথীর্ মারা গিয়েছিল এবং আহত ছিল বেশ কয়েকজন। এরপর বহু ঘটনা ঘটে গেল। শিক্ষাথীর্রা আন্দোলন করল। সবাই অবাক হয়ে দেখল, চাইলেই পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব। তবে কয়েকদিন পরেই পরিস্থিতি যা ছিল তাই হলো। প্রতিদিন অসংখ্য দুঘর্টনা ঘটছে। বাসগুলো থামায়নি প্রতিযোগিতা। কুষ্টিয়ার শিশু আকিফার মৃত্যু চোখে জল এনে দেয়। স্পষ্ট ভিডিওতে দেখা গেল থেমে থাকা একটা বাসের সামনে দিয়ে আসার সময় বাসটি চালিয়ে দিল ড্রাইভার। ফলে মায়ের হাত থেকে ছিটকে পড়ে তার মৃত্যু হলো। এভাবে খুব অল্প সময়ের ব্যবধানেই বাসের প্রতিযোগিতায় কারও প্রাণ যাচ্ছে, কারও পা যাচ্ছে আবার কারও বা হাত। এর আগে বাসের চিপায় শিক্ষাথীর্র হাতের দৃশ্যটি আজও চোখে ভাসে। সত্যি বাসগুলোর বড় তাড়া! আগে গেলেই যাত্রী বেশি। আর বেশি যাত্রী মানে লাভ বেশি। সব কিছুতেই হিসাব। কেবল মানুষের হাত, পা বা জীবনের কোনো হিসাব থাকে না। আবার কোথাও বাসের ধাক্কায় আহত ব্যক্তিকে চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে ছুড়ে ফেলে দেয়া হচ্ছে। যাতে সে সুস্থ হয়ে বেঁচে তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপে না যায়। বাসের চাপায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়িচালক রাসেল সরকার, গৃহকমীর্ রোজিনা আক্তার, পরিবহন শ্রমিক খালিদ হোসেন, ট্রাফিক পরিদশর্ক দেলোয়ার হোসেন, বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষাথীর্ রুনি আক্তার, গৃহবধূ আয়েশা খাতুন ও তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব হোসেনসহ অনেক নাম পরিচয় বের হয়ে আসে যারা বাসের প্রতিযোগিতার শিকার। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসেবে চলতি বছরের প্রথম পঁাচ মাসে সারাদেশে ২ হাজার ৩৩টি সড়ক দুঘর্টনায় প্রাণ হারিয়েছেন ২ হাজার ৪১১ জন। আর এসব ঘটনায় আহত হয় ৬ হাজার ৭৩০ জন। যেখানে চালকের অসাবধানতা, অদক্ষতা, বিপজ্জনক ওভারটেকিং এসব দায়ী থাকে। যাত্রীর দায় কতটা থাকে? একজনই ফুটপাত দিয়ে হঁাটতে গিয়ে বাসের নিচে চাপা পড়েছেন। তিনি তো আর জানতেন না বাস সড়ক ছেড়ে ফুটপাত দিয়ে চলতে শুরু করবে। জানলে নিশ্চয়ই অন্য কোনো রাস্তা দিয়ে হঁাটতেন। শুধু দুঘর্টনা বলে দিনের পর দিন এসব মৃত্যু মেনে নেয়া যায় না। মানুষের জীবন এত সস্তা যে অবহেলায় চাকার নিচে পিষ্ট হলেও তাকে দুঘর্টনা বলা হচ্ছে। আমাদের দেশে যারা মহাসড়কে বা অন্যান্য সড়কে যানবাহন চালায় তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অশিক্ষিত। গাড়ি চালানোর সঠিক সাইড, গতি নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি বিষয়গুলো জানে না বললেই চলে। আবার জানলেও আইনের ফঁাক-ফোকর খঁুজে তার মার প্যঁাচে ঠিক নিজেকে বের করে নেয়। ফলে এত এত দুঘর্টনা ঘটলেও শাস্তির খবর আসে হাতেগোনা। অথচ এর চালকের ভুলেই কিন্তু দুঘর্টনা ঘটার হার বেশি থাকে। কিন্তু শাস্তির ক্ষেত্রে তা লঘু অপরাধে পরিণত হয়। দুঘর্টনা তো দুঘর্টনাই! সড়ক দুঘর্টনা শব্দটি বতর্মানে আমাদের এত বেশি শুনতে হয় যে বিষয়টা খুব বেশিক্ষণ মাথার মধ্যে থাকে না। দুঘর্টনা শব্দটি দিয়েই প্রতিটি ঘটনাকে দঁাড় করানো হচ্ছে। কিন্তু কতদিন? এভাবে দায়িত্বে অবহেলাকে দুঘর্টনা বলে চালিয়ে দেয়া যাবে আর কতদিন? লক্কড়-ঝক্কড় মাকার্ গাড়ি রং-চং করে সাজিয়ে আর কতকাল প্রাণঘাতী হয়ে মহাসড়কে চলবে। এই কাজটা করতে পারলে একদিকে যেমন রাজধানীতে গাড়ির জট কিছুটা কমবে তেমনি দুঘর্টনার পরিমাণও কমবে। প্রতিদিন এবেলা ওবেলা যেভাবে সড়ক দুঘর্টনার কথা আমাদের কানে আসে তাতে কোন দুঘর্টনার কথা কতক্ষণ মনে থাকবে। আমাদের অনুভ‚তিগুলো মনে হয় অনেকটাই ভেঁাতা হয়ে গেছে। ইন্দ্রিয়গুলো এত সহজে আবেগে আক্রান্ত হয় না। কান্নার শক্তিও কমে গেছে। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও বাস, ট্রাক, নছিমন-করিমন বা মোটরসাইকেল বা কোনো না কোনো যানবাহন দুঘর্টনায় পড়বে। কখনো আলাদা আলাদা পরিবারের সদস্যের মৃত্যুর খবর আসে আবার কখনো আসে একই পরিবারের সদস্যের মারা যাওয়ার খবর। ভেঁাতা হয়ে যাওয়া অনুভ‚তিতে মানুষের মৃত্যু আর আগের মতো ভাবায় না। শুধু সাময়িক এক ধরনের যন্ত্রণা দেয়। যে যন্ত্রণায় মিশে থাকে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ খঁুজে না পাওয়ার ব্যথর্তার কথা। বারবার বহু আলোচনা, যুক্তি, তকর্, বহু লেখালেখি বহু টকশো হয়েছে এই সড়ক দুঘর্টনার ওপর। কাজের কাজ কতটুকু হয়েছে। এসব কারণের মধ্যে রয়েছে ত্রæটিপূণর্ যানবাহন, চালকের অদক্ষতা (অনেক সময়ই দেখা যায় কয়েকদিন চালকের সহকারী হিসেবে কাজ করার পরপরই গাড়ি চালানোর মতো ঝুঁকিপূণর্ দায়িত্ব তুলে নেয়), ঝুঁকিপূণর্ গাড়ি চালনা করা (আমাদের দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোন রাস্তায় কত গতিতে গাড়ি চালানো উচিত সেসব নিয়ম-কানুন মেনে চলার কোনো বালাই নেই। যদিও সড়কের ধারেই সবোর্চ্চ গতির বিষয়টি লেখা থাকে), মহাসড়কগুলোতে আগে চালানোর প্রবণতা (সামনের গাড়ির চেয়ে আগে না গেলে যাত্রী পাওয়া যাবে না অথবা নিজেকে দক্ষ প্রমাণ করার চেষ্টা অথবা অভ্যাসবশত অনেক চালকই এটা করে থাকে। এ ক্ষেত্রে আমার অভিজ্ঞতা হলো একবার যখন আমি বলেছিলাম ভাই, একটু আস্তে চালান তখন হেলপার বলল, ভাই না পোষালে আপনি নেমে যান), জবাবদিহিতার অভাব, অনেক সড়কে ঝুঁকিপূণর্ বঁাক বেশি থাকে, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হওয়া অথার্ৎ আইন জানা সত্তে¡ও দেখা যায় তা মেনে চলার কোনোই প্রয়োজন মনে করে না অনেকে, ড্রাইভিং পেশার অনুৎকষর্তা, ত্রæটিপূণর্ ট্রাফিক সিগনাল ব্যবস্থা, বিকল্প যানবাহনের পযার্প্ত ব্যবস্থা না থাকা, বতর্মান প্রেক্ষাপটে আইন প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া এসব। আইন করা হয় নাগরিক সুরক্ষার জন্য। আর সে আইন মেনে চলা প্রতিটি নারিকের নৈতিক দায়িত্ব। আমি যদি মনে করি আমি না মানলে কিছুই হবে না অন্য সবাই মানবে। সেটা ভুল। কারণ আমাকে দিয়েই শুরু করতে হবে। নিজে মানতে হবে অন্যকে মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে কেন আইন মেনে রাস্তায় চলাচল করা উচিত। আমরা কেউই নিয়মের বাইরে যেতে পারি না। ঢাকা শহরে ওভারব্রিজ থাকতেও মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে চলন্ত গাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে রাস্তা পার হচ্ছে প্রতিদিন। একটু এদিক-সেদিক হলে যে রক্ষা নেই তাও কিন্তু জানি। এই কাজ যে ঠিক না এটাও কিন্তু জানি। কিন্তু মানি না। দুঘর্টনা ঘটে যাওয়ার পর সাময়িকভাবে বোধ জাগ্রত হয়। মনে হয় কাল থেকে এটা আর করব না। কিন্তু কাল আসার পর আর মনে থাকে না। আবার সেই পূবির্দনের ঘটনারই পুনরাবৃত্তি করেই বাড়ি ফিরি। সড়ক দুঘর্টনার কারণগুলো কিন্তু আমরা প্রায় সবাই জানি। সড়ক মহাসড়কে ত্রæটি ও বিপজ্জনক মোড়গুলো কমিয়ে আনা, লাইসেন্সবিহীন সহকারীদের হাতে স্টিয়ারিং তুলে দেয়া থেকে বিরত থাকা, চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, সচেতনামূলক কাযর্ক্রম গ্রহণ করা, আইনের আধুনিকায়ন করা ইত্যাদি অনেক কাযর্ক্রম হাতে নেয়া যেতে পারে। তবে সব কথার বড় কথা নিজেকে তৈরি করা। যাত্রী হিসেবে আমি যেমন রাস্তায় চলাচলের আইন মানতে বাধ্য ঠিক তেমনি একজন চালক হিসেবেও যেন কেউ আইন সঠিকভাবে মেনে চলে। উন্নত বিশ্ব যদি সড়ক দুঘর্টনা কমাতে পারে তাহলে আমরা পারব না কেন? দুঘর্টনা ঘটার পর কার দোষ ছিল কার দোষ ছিল না এসব না ভেবে দুঘর্টনা যাতে না ঘটে সেটা চিন্তা করাই ভালো। কারণ দুঘর্টনা ঘটার পর সেই দায় আর কেউ নিতে চায় না। চালকদের প্রয়োজনীয় ও পযার্প্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি। নতুন আইন দুঘর্টনা রোধে কতটা সুফল বয়ে আনবে তা সময়ই বলে দেবে। তবে শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি নিঃসন্দেহে প্রয়োজন ছিল। সবচেয়ে বড় কথা হলো আইনের পাশাপাশি নিজেদের আইন মেনে চলার অভ্যাসটাও করতে হবে। আমাদের দেশটা বুলগেরিয়া নয়। এ দেশে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুঘর্টনা ঘটছে। সহসাই এই হার কমবে বলেও মনে হয় না। আমরা কারও পদত্যাগ বা বরখাস্ত চাই না। চাই সমাধান। কারণ বুলগেরিয়ার সাধারণ মানুষ যে আইন মেনে চলে আমরা তা মানি না। সমাধানের জন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে। কেবল পদক্ষেপ বা আইন প্রণয়ন করেই দায়িত্ব শেষ হয় না। তার সঠিক বাস্তবায়নও দরকার। অলোক আচাযর্্য: শিক্ষক, কলাম লেখক