করোনাযুদ্ধ ও আমরা

করোনাভাইরাস অনেক ক্ষেত্রেই মানুষের জীবনযাপনকে বদলে দিয়েছে। মানুষ আগের চেয়ে সুশৃঙ্খল ও সতর্ক হয়েছে। জীবনযাপনে এসেছে পরিমিতিবোধ ও নিয়মানুবর্তিতা। একই সঙ্গে মানুষের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করেছে। কে কখন আক্রান্ত হন, কে কখন মারা যান- সে ভয় সবার মধ্যে কাজ করছে। যতই দিন যাচ্ছে দেশে আক্রান্ত ও মৃতু্যর সংখ্যা বাড়ছে। যারা ঘরবন্দি অবস্থায় রয়েছেন তারাও যেমন ভয় পাচ্ছেন, আর যারা জরুরি কাজে বাইরে আসছেন তাদের ভয়টা আরও বেশি। কারণ তারা যে কোনো সময় আক্রান্ত হতে পারেন। ফলে মানুষের মনোজগতে বিষাদ কাজ করছে। মানুষ নিজেকে নিয়ে, মৃতু্য নিয়ে, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এত ভাবেনি কখনো

প্রকাশ | ২২ জুলাই ২০২০, ০০:০০

সালাম সালেহ উদদীন
করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী এক মহাতঙ্কের নাম। এ পর্যন্ত বিশ্বের আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৪৮ লাখ, মৃতু্যর সংখ্যা ৬ লাখ ১৩ হাজার। আমাদের দেশে আক্রান্ত দুই লাখ ১০ হাজার ৫১০ জন আর মৃতু্য ২ হাজার ৭০৯ জন। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্র, আক্রান্তের সংখ্যা ৩৯ লাখ এবং মৃতের সংখ্যা ১ লাখ ৪৪ হাজার। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, আমেরিকায় মৃতু্যর সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে। লাখ ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। দ্বিতীয় অবস্থানে ব্রাজিল, আক্রান্তের সংখ্যা ২১ লাখ এবং মৃতের সংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার। তৃতীয় অবস্থানে ভারত, আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১১ লাখ এবং মৃতের সংখ্যা প্রায় ২৮ হাজার। আক্রান্তের হিসাবে শীর্ষ ২০টি দেশের মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার তিন প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তান। সত্যিকার অর্থেই যা উদ্বেগজনক। আগে ২৪ ঘণ্টায় বিশ্বে দুই লাখের কম আক্রান্ত হতো। গত কয়েকদিন ধরে দুই লাখের বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। এর দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় কেবল বাংলাদেশে নয়- সারা বিশ্বে আক্রান্তের হার বাড়ছে। আগস্টে পিক টাইমের কথা যে বলা হয়েছিল, বিশ্ব সেদিকেই যাচ্ছে। এও বলা হয়েছিল এ সংক্রমণ সহজে যাবে না। মানুষকে এর সঙ্গে খাপ-খাইয়ে চলতে হবে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবৈজ্ঞানিক, অযৌক্তিক এবং অমূলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে মানুষ নিজেদেরই ক্ষতি করছে। এর আগে দেশের যেসব এলাকায় আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে সেসব এলাকা সঙ্গে সঙ্গে লকডাউন করা হয়েছে। এটি ভালো দিক ছিল। এই ব্যবস্থা করোনা প্রতিরোধে ফলদায়ক ছিল। কিন্তু জীবন-জীবিকার স্বার্থে সবকিছু খুলে দেওয়ায় এবং মানুষ অসচেতন থাকার কারণে আমাদের দেশে সংক্রমণ এখন উচ্চমাত্রায়। অন্যদিকে আমাদের দেশে পর্যাপ্ত চিকিৎসাব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি এখনো। চিকিৎসা সংকট রয়েছে, রয়েছে অন্যান্য সংকটও। এরই মধ্যে করোনা পরীক্ষার নামে প্রতারণা করেছে দেশের তিনটি প্রতিষ্ঠান। রিজেন্ট, জেকেজি ও সাহাবউদ্দিন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। ফলে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। গত বছর যখন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১৭৯ জন মানুষ মারা গেল, এক লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হলো তখন থেকেই আমাদের বোঝা উচিত ছিল, এ ধরনের বা অন্য কোনো ভাইরাস মহামারি আকারে আঘাত হানতে পারে। আরও একটি নেতিবাচক দিক হচ্ছে প্রথম দিকে ডাক্তার-নার্সদের মধ্যে ভীতি কাজ করেছে। পরে অবশ্য তারা বাস্তবতা মেনে নিয়েছে। ফলে সেবা দিতে গিয়ে অনেকের জীবনও চলে গেছে। চীনের ডাক্তার-নার্সরা মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য এই মানবতাবাদে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই তারা সব ধরনের ভয়-ভীতিকে উপেক্ষা করে রোগীর সেবা করেছেন, অনেকে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারাও গেছেন। তবুও তারা দমে যাননি কিংবা থেমে থাকেননি। তাদের মনোবলে ধস নামেনি। ফলে করোনা আক্রান্ত বিশ্বে অন্যরকম এক চীনকে আমরা দেখতে পাচ্ছি। করোনার কারণে সারা বিশ্ব প্রকম্পিত আর চীন মুক্ত। চীন বাণিজ্যের সব দুয়ার খুলে দিয়েছে। চীনের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। এটা মেনে নিতেই হবে যে দেশের জনগণ করোনাভাইরাস সংক্রমণ বিষয়ে তেমন সচেতন নয়। বিশেষ করে বিভিন্ন শ্রমজীবী মানুষ এবং একশ্রেণির তরুণ। তারা এ ব্যাপারে গা করছে না। রাজধানী ঢাকার অলিগলিতে তাদের অবাধে ঘুরতে দেখা যায়, সামাজিক দূরত্ব রক্ষা না করেই। এমনকি কেনাকাটার সময়ও তারা সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করে চলে না। রাজপথে বাজারে অলিগলিতে মানুষের ভিড়। অনেকের মুখেই মাস্ক নেই। করোনার ব্যাপারে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে এসে নির্দিষ্ট তিন ফুটের দূরত্ব মানছে না তারা। কেবল তাই নয়- বস্তিবাসীরা কোনো ধরনের সামাজিক দূরত্ব মানছে না। তারা আগের মতোই খোশগল্পে মত্ত থাকছে। করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা সম্পর্কে তাদের ধারণা কম। আবার কেউ কেউ এও বলছে 'মউত আসলে মারা যামু'। গ্রামের নিরীহ মানুষের ধারণাও এমন। মরতে তো একদিন সবাইকেই হবে, এটা সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক নির্ধারিত ও অবধারিত। সে জন্য ট্রাক বা বাসের নিচে চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দেওয়া সঙ্গত ও যৌক্তিক নয়। করোনাভাইরাস সম্পর্কে অসাবধানতা বা অসতর্কতা আত্মহননের শামিল। মহামারি করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি থাকলেও জীবন ও জীবিকার তাগিদে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে অফিস-আদালত ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান আগের মতো স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছে। প্রতিদিনই রাস্তাঘাটে মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে নগরজীবন। গত মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে পরবর্তী দুই মাস সাধারণ ছুটি শেষে ১ জুন সীমিত পরিসরে প্রায় সবকিছু খুলে দেওয়া হয়। এরপরও জুন মাসে ভীতির কারণে রাস্তাঘাটে সীমিত সংখ্যক মানুষ ও যানবাহন দেখা যেত। প্রায় তিন মাসেরও বেশি সময় ঘরে বসে থাকায় আয়-রোজগার কমে যাওয়ায় ঝুঁকি নিয়েই মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফেরার অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মানুষের মধ্যে আগের মতো উৎফুলস্ন ভাব নেই। ব্যক্তি আচরণ পরিবর্তন হয়ে গেছে। করোনাকালে বেড়েছে পারিবারিক সহিংসতা। করোনাকে কেন্দ্র করে সমাজও আগের চেয়ে নিষ্ঠুর হয়েছে। যে বাড়ি বা বাসায় আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাচ্ছে, তাদের প্রতি অমানবিক আচরণ করা হচ্ছে, করা হচ্ছে একঘরে। যেন তারা মহা অপরাধ করে ফেলেছে। স্বজনরা আক্রান্ত বাবা, মা, ভাইকে রাস্তায় ফেলে চলে যাচ্ছে। এটা ভাবতে বিস্ময় জাগে, কোনোভাবেই আমাদের সমাজ যেন আলোর দিকে অগ্রসর হতে পারছে না, কেবল অন্ধকারে খাবি খাচ্ছে। অবক্ষয় যেমন আমাদের সমাজকে দিন দিন গ্রাস করছে। নীতিবোধ ও চারিত্রিক মূল্যবোধ সমাজ গঠনের প্রধান শক্তি, যা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। এই সংকট করোনাকালে আরও তীব্র হচ্ছে। জনজীবন হয়ে পড়েছে বিষাদময়। মানুষের আচার-আচরণের মধ্য নেই বিন্দুমাত্র মানবিকতার ছাপ। মানুষের মনোজগতেও ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে। তীব্র হচ্ছে মানুষের অর্থনৈতিক সংকট। অনেকেই চাকরি, ব্যবসা হারিয়েছেন। এই সংকটে একাধিক ব্যক্তি আত্মহত্যা করেছেন। অনেকে বেঁচে থাকার জন্য লজ্জা ভুলে পেশা পরিবর্তন করেছেন। বাসা ভাড়া দিতে না পেরে রাজধানী ছেড়ে চলে গেছে অনেকেই। রাজধানীর বাড়িতে বাড়িতে এখন টু-লেট ঝুলছে। ভাড়াটিয়া নেই। গ্রামে গিয়েও তাদের স্বস্তি শান্তি নেই। সেখানে পর্যাপ্ত কাজ নেই, রোজগার নেই। যারা ১০ কিংবা ২০ বছর পর গ্রামে ফিরেছে তাদের গ্রামবাসী আত্মীয়স্বজনরাও আগের মতো গ্রহণ করছে না। তাদের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। তারা মনে করছে আগতরা তাদের বোঝা, বাড়তি আপদ। দিন দিন মানুষ মানুষের প্রতি হয়ে উঠছে অমানবিক ও নিষ্ঠুর। আর এই নিষ্ঠুরতা ও অমানবিকতার সব থেকে বেশি শিকার হচ্ছেন করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা। যেখানে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের প্রতি মানুষের আচরণ হওয়ার কথা ছিল সহানুভূতিশীল ও মানবিক। যে সময়ে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের মনোবল বা সাহস বাড়ানোর জন্য তাদের প্রতি মানবিক দৃষ্টি প্রদান করার কথা ছিল ঠিক তখনই আমাদের সমাজে ঘটছে তার বিপরীত। করোনাকালে ব্যক্তির আচরণ ও মানসিকতা বিস্ময়কর। নিজের স্বজনদের সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করছে। করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা না পাচ্ছে প্রিয়জনের ছোঁয়া, না সম্মানজনক শেষ বিদায়। করোনাভাইরাস অনেক ক্ষেত্রেই মানুষের জীবনযাপনকে বদলে দিয়েছে। মানুষ আগের চেয়ে সুশৃঙ্খল ও সতর্ক হয়েছে। জীবনযাপনে এসেছে পরিমিতিবোধ ও নিয়মানুবর্তিতা। একই সঙ্গে মানুষের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করেছে। কে কখন আক্রান্ত হন, কে কখন মারা যান- সে ভয় সবার মধ্যে কাজ করছে। যতই দিন যাচ্ছে দেশে আক্রান্ত ও মৃতু্যর সংখ্যা বাড়ছে। যারা ঘরবন্দি অবস্থায় রয়েছেন তারাও যেমন ভয় পাচ্ছেন, আর যারা জরুরি কাজে বাইরে আসছেন তাদের ভয়টা আরও বেশি। কারণ তারা যে কোনো সময় আক্রান্ত হতে পারেন। ফলে মানুষের মনোজগতে বিষাদ কাজ করছে। মানুষ নিজেকে নিয়ে, মৃতু্য নিয়ে, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এত ভাবেনি কখনো। যেন ভাবনা আর মন খারাপ থাকার মৌসুম শুরু হয়েছে। পরিবারের শিশুরাও এ থেকে রেহাই পাচ্ছে না। একদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ অন্যদিকে তাদের বাইরে যাওয়া হচ্ছে না। সব মিলিয়ে শিশুরাও ভালো নেই। তারা কতক্ষণ ঘরে থাকবে। ফলে তারা লেখাপড়ার পরিবর্তে টিভি-মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়েছে। শিশুর মানসিক বিকাশে এটা বড় ধরনের বাধা। ফেসবুকে অনেকেই ক্ষমা চেয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছে। কেউ কেউ ঘুমের মধ্যে মারা যাওয়ার শঙ্কাও করছেন। যা খুবই বেদনাদায়ক। মানুষকে একদিন মরতে হবেই। এই নশ্বর পৃথিবীতে আসা আর যাওয়া এ দুটোই চরম সত্য। এই সত্যকে মেনে নিয়ে আমাদের বাকি জীবন চলতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, করোনা খুব সহজে মানুষের জীবন থেকে যাবে না। উপরন্তু করোনাসহ অন্যান্য মহামারিও জেঁকে বসতে পারে সিন্দবাদের দৈত্যের মতো। সুতরাং চরম বিভীষিকাময় অবস্থায় ভবিষ্যৎ জীবন কাটাতে হবে, না হয় মরে যেতে হবে। হতাশার কথা হচ্ছে, আগের পৃথিবীকে মানুষ হয়তো বা আর কোনোদিনই ফিরে পাবে না। মৃতু্য ও বেদনা পেরিয়ে, শোক কাটিয়ে নতুন পৃথিবীতে নতুন স্বপ্ন নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকবে, তৈরি হবে অহিংস মানবিক বিশ্ব। সালাম সালেহ উদদীন : কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক