করোনাকালে আরেকটি দুর্যোগ বন্যা

ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বন্যা মোকাবিলার প্রস্তুতি সরকারের রয়েছে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। হয়তো তাৎক্ষণিক মোকাবিলা করার প্রস্তুতি রয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যতে এর স্থায়ী সমাধানের জন্য এখনই কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তা ছাড়া আসন্ন কোরবানি ঈদে এটি যেন সাধারণ মানুষের বেশি দুর্ভোগের সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।

প্রকাশ | ২৭ জুলাই ২০২০, ০০:০০

ড. মো. হুমায়ুন কবীর
চলছে ভয়াবহ দুর্যোগ ও মহামারি করোনা। বিশ্বের শক্তি, ক্ষমতা, অর্থ, পান্ডিত্য, মোড়লিপনা সবকিছুতেই এগিয়ে থাকা দেশগুলোও সামাল দিতে পারছে না চরম দুর্ভোগের করোনাকে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেরও যেখানে সীমাহীন দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়ে চলেছে। সেখানে আমাদের বাংলাদেশ সেটাকে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে কোনোভাবে চেপে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বেশ কয়েকদিন ধরে আক্রান্তের হার, মৃতু্যর হার ইত্যাদিতে স্থিতিশীল অবস্থা বিরাজমান। তারপরও বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত করোনা পরিস্থিতি পুরো নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। তার ওপর সাংবাৎসরিক মৌসুমি সমস্যা হিসেবে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকা ইত্যাদি ভাইরাসজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব যখন চরমভাবে চলে আসে তখন সেটির পরিস্থিতি কেমন হয় তা সবাই হয়তো অনুভব করতে পারছেন। ভারতে পঙ্গপালের আক্রমণ হওয়ায় বাংলাদেশেও তা চলে আসার পূর্বাভাস ছিল। কিন্তু সেটা আলস্নাহর রহমতে আসে নাই। প্রতি বছর পাহাড়ি ঢল, উজান থেকে নেমে আসা পানি, আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ নদীগুলোর উৎসের দেশে বন্যা হওয়া ইত্যাদি কারণে কিছু কিছু এলাকায় আগাম, মধ্য মৌসুম ও শেষ মৌসুম ইত্যাদি বিভিন্ন রকম বন্যা দেখা দেয়। আবার পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, কমবেশি প্রতি দশ বছরের ব্যবধানে দেশে একটি বড় বন্যা হওয়ার ইতিহাস রয়েছে। তদানুযায়ী বিগত তিন-চার বছর আগেও দেশের হাওরাঞ্চলসহ সারা দেশে একটি বন্যা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কোনো ধরনের ফর্মুলা না মেনেই যেন এবারে আরও একটি বন্যা ধেয়ে আসছে। করোনাকালের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল হাওরের বোরো ধান ঘরে তোলা। সেটি আলস্নাহর রহমতে সঠিকভাবে শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু এখন করোনাকালে যখন দ্বিতীয় পর্যায়ের কৃষি বিপস্নব চলমান তখন এ বন্যা কৃষি ক্ষেত্রে একটি বড় ক্ষতির কারণ বয়ে আনবে। বোরা ধান আবাদ ও ফলনে ব্যাপক সাফল্যপ্রাপ্তির স্বাভাবিকভাবেই কৃষকের মনে অনেক সাহস সঞ্চারিত হয়েছিল, হয়তো আমন মৌসুমেও আরেকটি বাম্পার ফলন হবে। যার ফলে প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যাশা, নির্দেশনা ও আশাবাদ অর্জন করা সম্ভব হবে। তিনি একটি সম্মুখ দুর্ভিক্ষের পূর্বাভাস থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য একমাত্র কৃষিকেই ভরসা হিসেবে দেখেছিলেন। কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই এভাবে তাদের মাইন্ডসেট তৈরি করে নিয়েছিল। কিন্তু এ সময়ে বন্যা সেটি ভুলুণ্ঠিত করে দিতে পারে। বন্যা এখন পর্যন্ত সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে নাই। কেবল দেশের উত্তরাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। রাজধানী ঢাকাও বন্যাক্রান্ত এখন। তবে পূর্বাভাস বলছে হয়তো সারা দেশে ছড়িয়ে যেতে পারে। এ বন্যার কারণে মূলত দুটি দিকে সমস্যা দেখা দেবে। প্রথমত, এমনিতেই করোনার কারণে দেশে দফায় দফায় লকডাউনের ফলে এবং মানুষ অনেকাংশেই কর্মহীন হয়ে পড়েছে। সেজন্য তাদের সরকারি সাহায্য কিংবা ত্রাণের উপর নির্ভরশীল থাকতে হচ্ছে। এর ওপর আসছে কোরবানির ঈদের মতো ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ আচার। দ্বিতীয়ত, পরপর দুটি ধানফসল যেমন- বোরো ও আউশের মতো লাভজনক আমন মৌসুমেও বাম্পার ধান উৎপাদন হলে আগামী এক বছর মানুষের ঘরে খাবারের সমস্যা হবে না। কিন্তু বন্যায় যদি আমন মৌসুমের ধান ফসলটি ভালোভাবে উৎপাদিত হতে না পারে তাতে সামনের দিনগুলোতে আমাদের খাদ্যঘাটতির বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তা ছাড়া বন্যায় প্রধান খাদ্যের সঙ্গে সঙ্গে শাক-সবজিসহ অন্যান্য ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার কারণে পুষ্টির সমস্যা দেখা দিতে পারে। ইতিমধ্যে অতিবৃষ্টি ও বন্যার কারণে সবজি ফসলের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হওয়া সেগুলোর দাম বাজারে অনেকগুণ বেড়ে গেছে। যেখানে করোনাকালে পুষ্টিকর খাদ্য যথা- মাছ, মাংস, শাক-সবজি, ফলমূল, ডিম, দুধ, কলা ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে খাদ্যতালিকায় রেখে শরীরে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে। সেখানে যদি এসব জিনিস দেশে প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত না হয় তাহলে বিদেশ থেকে আমদানি করা সম্ভব হবে না। কারণ দীর্ঘ প্রায় ছয় মাসকাল দেশে গতিশীল অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চলতে না পারার কারণে দেশের আমদানি সক্ষমতা কমে যাবে। অন্যদিকে দেশে টাকা থাকলেও যেসব দেশে এসব পণ্য উৎপাদিত হতো যা থেকে আমরা আমদানি করতাম, এখন তাদের দেশেও করোনার জন্য সেসব দ্রব্য উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই আমদানিও করা সম্ভব হবে না। কাজেই করোনাকালে এবারের বন্যাটি দেশের জন্য একটি বিরাট প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে দেখা দেবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের উপরে কারও হাত নেই। একে নিয়ন্ত্রণ হয়তো করা সম্ভব নয়। তবে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে সেটিকে পুনর্বাসনের মাধ্যমে ক্ষয়-ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বন্যা মোকাবিলার প্রস্তুতি সরকারের রয়েছে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। হয়তো তাৎক্ষণিক মোকাবিলা করার প্রস্তুতি রয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যতে এর স্থায়ী সমাধানের জন্য এখনই কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তা ছাড়া আসন্ন কোরবানি ঈদে এটি যেন সাধারণ মানুষের বেশি দুর্ভোগের সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। ড. মো. হুমায়ুন কবীর : কৃষিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় শনফযঁসধুঁহ০৮@মসধরষ.পড়স