শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পোশাকশিল্প: হতাশার মাঝে নতুন আলো

পোশাকশিল্পকে এগিয়ে নিতে বহুমাত্রিক ভাবনাকে প্রাধান্য দিতে হবে। নানা সংকটের মাঝেও এ খাতকে এগিয়ে নিতে হবে। স্মরণ রাখতে হবে, দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য পোশাকশিল্প। যেখাতে কর্মরত প্রায় ৪০ লাখ কর্মী। যার মধ্যে আবার ৬০ শতাংশই নারী।
হোসাইন মুবারক
  ৩০ জুলাই ২০২০, ০০:০০

কোনো দেশের আমদানি সক্ষমতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেলে ওই দেশের অবকাঠামোসহ যাবতীয় উন্নয়ন প্রক্রিয়ার অগ্রগতি হয়। এর ফলে প্রভাব পড়ে জিডিপি বা জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সূচকে দেশ স্থান পায় অনন্য মাত্রায়। আর এই আমদানি সক্ষমতা বৃদ্ধির পেছনে কাজ করে রপ্তানি আয়ের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা। আবার কোনো দেশের রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পেলেই যেমন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সমৃদ্ধ হয়, তেমনই এরই ধারাবাহিকতায় দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে জোয়ার আসে।

\হদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক। সব রপ্তানি পণ্যের মধ্যে ৮৪ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয় এই তৈরি পোশাক খাত থেকে। সেই অর্থে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে সবচেয়ে বড় ভূমিকা এই তৈরি পোশাক খাতের। কিন্তু বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের বিরূপ প্রভাবে সামাজিক দূরত্ব বজায়ে রাখতে গিয়ে যেমন দেশের পোশাক কারখানাগুলো সাময়িক বন্ধ করে দেওয়া হয়, তেমন স্বল্পসময়ের জন্য শিল্প এলাকাগুলোও লকডাউন ঘোষণা করা হয়। এতেই তৈরি পোশাকসহ যাবতীয় পণ্য উৎপাদনে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। অনুরূপভাবে বিদেশেও পণ্য বিক্রি প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হওয়ায় একের পর এক রপ্তানি আদেশ বাতিল হতে থাকে। দেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলোয় নেমে আসে স্থবিরতা। বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাকের চাহিদা একেবারে নিম্ন পর্যায়ে এসে দাঁড়ায়। এ কারণে দেশের পোশাক কারখানাসমৃদ্ধ অঞ্চলগুলোয় কর্মীদের আনাগোনা নেমে আসে শূন্যের কোঠায়। রপ্তানি কমে যাওয়ায় অনেক কারখানার মালিকরা শ্রমিকদের বেতন দিতে হিমশিম খেতে শুরু করেন। ফলে বিগত ঈদে বেতন-বোনাস না পাওয়ায় কিছু কিছু কারখানার শ্রমিকদের রাজপথে নামতে দেখা গেছে। এক সময়ের সমৃদ্ধ পোশাকশিল্পকে দেখতে হয়েছে একেবারে বিধ্বস্ত অবস্থায়।

পোশাকশিল্পের এই যখন অবস্থা, তখন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বিদগ্ধ পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করে আবারও কারখানাগুলো শত সমালোচনার মাঝে জেগে ওঠে। গ্রামে ফিরে যাওয়া কর্মীরা কারখানা কর্তৃপক্ষের নির্দেশে করোনার জন্য জারি করা স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে আবারও দলে দলে ফিরতে শুরু করেন কর্মস্থলে। উৎপাদন প্রক্রিয়াতেও আসে নতুন জোয়ার। বাতিল হওয়া ক্রয়াদেশগুলো নতুন করে নবায়ন হতে শুরু করে। অথবা স্থগিত হওয়া আদেশগুলো পুনঃনবায়ন করে আবার শুরু হয় কর্মপ্রক্রিয়া।

যায়যায়দিনে প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়েছে, তিন শতাধিক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৩১৫ কোটি মার্কিন ডলারের রপ্তানি আদেশ স্থগিত হয়েছিল, বাংলাদেশি মুদ্রায় যেটা ছিল ২৭ হাজার কোটি টাকা। ওই সংবাদের আরেক অংশে বলা হয়েছে, গতবারের তুলনায় বর্তমানে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ক্রয়াদেশ আসছে। এর অর্থ দাঁড়ায়, এই করোনাকালেও স্বাভাবিক পরিস্থিতির চেয়ে মাত্র ২০-৩০ শতাংশ ক্রয়াদেশ কমেছে।

সংবাদ ভাষ্যের আরেক অংশের মতে, করোনা সংক্রমণ রোধে ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর মাসখানেক পোশাক কারখানাগুলো পুরোপুরি বন্ধ ছিল। এ কারণে গত এপ্রিলে মাত্র ৩৭ কোটি মার্কিন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়- যা গত দুই দশকের চেয়ে সর্বনিম্ন। কিন্তু পরের মে মাসে রপ্তানি হয় ১২৩ কোটি মার্কিন ডলারের পোশাক। জুনে সেটা বেড়ে হয় ২২৫ কোটি মার্কিন ডলার। তারপরও বিদায়ী ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ২ হাজার ৭৯৫ কোটি মার্কিন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়- যা আগের বছরের চেয়ে ৭১৮ কোটি মার্কিন ডলার কম।

উপরের পরিসংখ্যান আর যা-ই হোক না কেন, এখন বলতে হবে তৈরি পোশাকশিল্প এই করোনা পরিস্থিতিতেও হতাশার মাঝে নতুন আলো। আরও বলা যায়, পোশাক খাতের ঘুরে দাঁড়ানোর নতুন প্রেরণা রয়েছে এই পরিসংখ্যানে। করোনাভাইরাসের ফলে এই মহামন্দায় একেবারে থেমে যাওয়া রপ্তানি আদেশ নতুন করে প্রেরণা জোগাচ্ছে মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে।

আরেকটি পরিসংখ্যানের তথ্য এখানে না উলেস্নখ করলেই নয়। ওই পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ১ থেকে ১২ জুলাই পর্যন্ত ৯৮ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে- যা গত বছর একই সময়ে রপ্তানি হয়েছিল ১১৯ কোটি মার্কিন ডলারের পোশাক। আর যা-ই হোক, এই করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও পোশাকশিল্পের এটা ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত- যা এই করোনাকালের ডামাডোল পরিস্থিতিতে অনেকটাই সন্তোষজনক।

সব মিলে এই করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করে তৈরি পোশাক খাত যতটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে তাকে অনেকটা আশাব্যঞ্জক বলা যায়। এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও এটা শিল্পসংশ্লিষ্ট মানুষের আশার মাঝে নতুন আলো।

তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে জিএসপি সুবিধা একটা বড় বিষয়। বাংলাদেশসহ ৫১টি দেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো থেকে জিএসপি সুবিধা পায়। যেহেতু ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত আমদারিকারক দেশগুলো ৫৬ শতাংশ পণ্য বাংলাদেশ থেকে আমদানি করে, সেহেতু এই জিএসপি সুবিধার বিষয়টি ভেবে দেখা প্রয়োজন। জিএসপি সুবিধা পেতে সহায়ক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া রেজিস্ট্রার্ড এক্সপোর্ট সিস্টেম বা রেক্স অগ্রাধিকারমূলক ভূমিকা রাখে, সেহেতু এই সনদ দেয়ার বিষয়ে কেবল উপযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব উৎপাদন ব্যবস্থা নেই অর্থাৎ বায়ার প্রতিষ্ঠান, তাদের রেক্স সনদ দেয়া ঠিক কি না, পোশাকশিল্পের গতিধারা ও স্বার্থ অক্ষুণ্ন রাখতে তাও ভেবে দেখার বিষয়। জিএসপি সুবিধা পাওয়ার জন্য এমন কোনো প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ বিবেচনা করা উচিত নয়, যাতে মূলধারার পোশাকশিল্প বিশ্ববাজারে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কারণ, ইউরোপীয় ইউনিয়নই আমাদের পোশাকশিল্পের বৃহত্তম রপ্তানি বাজার।

আরো একটি বিষয় লক্ষণীয়, সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিজেদের অর্থনীতির মন্দা মোকাবিলা করতে ৭৫০ বিলিয়ন ইইউরোর বড় ধরনের প্রণোদনা প্যাকেজ অনুমোদন করেছে। সেই ক্ষেত্রে এই প্যাকেজ ইউরোপীয় ইউনিয়নের নাগরিকদের ক্রয়-ক্ষমতার পাশাপাশি নানা ক্ষেত্রে সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে। তৈরি পোশাকের রপ্তানি বাজারে এর বড় ধরনের প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেই অর্থে রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে আমাদেরও একটা নজরদারি থাকা দরকার।

বাংলাদেশের পোশাকশিল্প সারা বিশ্বে আলোচিত একটি নাম। মেইড ইন বাংলাদেশ লেখা পোশাক এখন বিশ্বের উন্নত দেশগুলোয় বড় বড় ব্র্যান্ডের শো-রুম থেকে বিক্রি হচ্ছে। তাই স্বাভাবিকভাবে বিশ্বের স্বনামে খ্যাত ব্র্যান্ডগুলো আমাদের তৈরি পোশাকের মূল ক্রেতা। পোশাকশিল্পের এই গৌরবজনক অধ্যায় একদিনে সৃষ্টি হয়নি। আশির দশকে যাত্রা শুরু করা এ শিল্প ভিয়েতনাম, ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, কম্বোডিয়ার মতো শিল্পে অগ্রসর দেশকে পেছনে ফেলে সারা বিশ্বের পোশাক রপ্তানিকারকদের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে নেয়। যার প্রথম স্থানে রয়েছে এ সময়ের উদীয়মান শিল্পশক্তি চীন। যাত্রার এই দীর্ঘ সময়ে দেশে গড়ে উঠেছে এ শিল্পের দক্ষ ব্যবস্থাপনা, সেই সঙ্গে আরও সুগঠিত হয়েছে পোশাককর্মীদের দক্ষ হাত। এই দুই মিলে দীর্ঘ যাত্রাপথ অতিক্রম করে অর্জিত হয়েছে অবাক করা ঈর্ষণীয় সাফল্য। শত প্রতিকূলতার মাঝে এই সাফল্য আমাদের ধরে রাখতে হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট সব মহলকে প্রসারিত করতে হবে উদারনৈতিক সহযোগিতার হাত।

\হপোশাকশিল্পকে এগিয়ে নিতে বহুমাত্রিক ভাবনাকে প্রাধান্য দিতে হবে। এখন এ খাতকে এগিয়ে নিতে হবে নানা সংকটের মাঝেও। স্মরণ রাখতে হবে, দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য পোশাকশিল্প। যেখাতে কর্মরত প্রায় ৪০ লাখ কর্মী। যার মধ্যে আবার ৬০ শতাংশই নারী।

এসব কর্মীর আবার সিংহ ভাগই গ্রামীণ জনপদের অধিবাসী। যার কারণে এদের আয়-রোজগারের বড় একটা অংশ স্বজনদের হাতে গিয়ে এলাকার হাটবাজারে ব্যয় হয়- যা গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতিসঞ্চার করে। এমন একটি বিস্তৃত খাতকে ঘুরে দাঁড়াতে সব মহলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকা জরুরি।

হোসাইন মুবারক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<107473 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1