সংবাদপত্রের শিরোনাম ও মানুষের কথা

যারা সরাসরি দুর্নীতি করছে- তাদের চেয়ে যিনি বা যারা তাদের দুর্নীতিবাজ হিসেবে গড়ে তুলছেন বা গড়ে উঠতে সহায়তা করছেন তারা কি করে আজও শাস্তির বাইরে দিব্যি রয়ে যাচ্ছেন? দুর্নীতি বহু দেশেই হয়। করোনা নিয়ন্ত্রণে কোনো কোনো দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। এ নিয়ে সেসব দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোতে তাদের সমালোচনা প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা পদত্যাগ করেছেন? আর আমাদের দেশে?

প্রকাশ | ৩১ জুলাই ২০২০, ০০:০০

রণেশ মৈত্র
দিনটি ছিল ১৯ জুলাই। সকালে ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে চায়ের পেয়ালা হাতে প্রতিদিনের অভ্যাসমত একাত্তর টিভি চ্যানেলটি খুলতেই চোখে পড়ল নানা সংবাদপত্রের শিরোনাম। এক এক করে কয়েকটি শিরোনাম পাঠক-পাঠিকাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তুলে ধরছি। এক. এক মাসেই আক্রান্ত বেড়েছে এক লাখ দুই. কম পরীক্ষা আক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায় তিন. ঈদের পরে উলস্নম্ফন চার. নিম্নমানের মাস্ক-পিপিই সরকারকে সরবরাহ দিতেন সাহেদ পাঁচ. বেশি দামে কিট কিনছে সরকার ছয়. টেস্ট-হাসপাতালে আস্থা নেই জনগণের সাত. হেভিওয়েট অনেকের নাম সাহেদের মুখে আট. সব জানতেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা-জেরায় সাবরিনা আমাদের দেশে দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা অনেক। প্রায় সব পত্রিকারই শিরোনাম একই ধরনের। তাই মাত্র আটটি প্রতিনিধিত্বমূলক শিরোনাম তুলে ধরলাম- এতেই এই দিনটির প্রধান প্রধান খবর পাঠকদের সামনে উঠে আসে। তাই খবরের বিস্তারিত উলেস্নখ করা থেকে বিরত রইলাম। ডা. এবিএম আবদুলস্নাহ, করোনাসংক্রান্ত জাতীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন, একই পত্রিকায় একই দিনে তার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন যা ১৯ জুলাই পত্রিকাটির প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিক্রিয়া সংক্ষিপ্ত তাই তার পূর্ণ বয়ান উদ্ধৃত করছি- দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দুই লাখ ছাড়িয়েছে। মৃতু্যও আড়াই হাজার ছাড়িয়েছে। গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছিলেন। এবং ১০ দিনের মাথায় ১৮ মার্চ একজন মৃতু্যবরণ করেন। প্রথম শনাক্ত হওয়ার দিন থেকে হিসাব করলে ১৮ জুলাই শনিবার ছিল ১৩৩তম দিন। এ সময়ে আক্রান্ত, মৃতু্য, সুস্থতার হার পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ১৯ শতাংশের কিছু বেশি, মৃতু্য হার ১.২৭ শতাংশের মতো। এর বিপরীতে সুস্থতার হার ৫৪ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ আক্রান্তদের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষই সুস্থ হয়ে উঠছেন। এটি আশাব্যঞ্জক খবর। মৃতু্যহার কম মানে এই নয় যে, কারও মৃতু্য কাম্য। যে কোনো রোগে একজনেরও মৃতু্য কাম্য হতে পারে না। কয়েকদিন ধরে দেখা যাচ্ছে, আক্রান্তের সংখ্যা কিছুটা কমতে শুরু করেছে। নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার কিছুটা বেড়েছে। তবে সেটি ২৪ থেকে ২৫ শতাংশের মধ্যে স্থির থাকছে। এ ছাড়া করোনার লক্ষণ উপসর্গ নিয়ে মৃতু্যর সংখ্যা গত কয়েক দিনে হ্রাস পেয়েছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, আমরা পরিস্থিতির উন্নতির দিকে যাচ্ছি। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগস্টের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহের দিকে সংক্রমণ হয়তো কমে আসতে পারে। সে জন্য যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। অন্যথায় পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হলেও এখনো অনেকেই তা মানছেন না। মনে রাখতে হবে, যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে না চললে আমরা কোনোদিনই এই রোগটি থেকে মুক্তি পাব না। আমাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহা সমাগত। এই ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে অনেকেই হয়তো বাড়ি যাওয়ার কথা ভাবছেন। তাদের প্রতি আহ্বান থাকবে, অতি প্রয়োজন ছাড়া এ সময় ঘর থেকে বের হবেন না। ঘরে বসে ঈদের আনন্দ উপভোগ করুন। এ ছাড়া ঈদুল আজহা সামনে রেখে রাজধানীসহ সারা দেশে পশুর হাট বসবে। সুতরাং এই হাটে যারা পশু কেনাবেচার জন্য যাবেন, তাদের প্রতি আহ্বান থাকবে, সবাই যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অবশ্যই পালন করবেন। সবশেষে বলব, করোনাভাইরাস নিয়ে কেউ আতঙ্কিত হবেন না, বরং সতর্ক থাকবেন যাতে সংক্রমিত না হন। এটি হলো ডা. এবিএম আবদুলস্নাহর বিশেষ লেখা। তিনি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও উপদেষ্টা, করোনা প্রতিরোধ সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি। ডা. আবদুলস্নাহকে করোনাসংক্রান্ত বিষয়ে শুধু বিশেষজ্ঞ বলেই মনে করা যাবে না- তিনি এই রোগটির নিরাময়সংক্রান্ত নীতির প্রধান প্রণেতাও। একেবারেই সাধারণ মানুষ হিসেবে বিনীতভাবেই বলতে চাই, দেশবাসীর মধ্যে কত ভাগ মানুষের করোনা টেস্ট করা হলো আজতক? যদি তা মাত্র ১০-১২ লাখ হয়ে থাকে তবে তার উলিস্নখিত সংক্রমণের ও মৃতু্যর হারকে কি সঠিক বলা যাবে? আরও জানতে ইচ্ছা করে করোনা টেস্টের সংখ্যা বাড়ছে- নাকি কমছে? আসলে তো দেখা যায়, সর্বোচ্চ যে সংখ্যায় টেস্ট কয়েক সপ্তাহ আগে করা হয়েছিল- তার বিপরীতে ইদানীং টেস্ট অর্ধেকই কমানো হয়েছে। কারণটা জানা অত্যন্ত জরুরি। জানা জরুরি যে টেস্ট না বাড়ালে বা বর্তমান হারে কমাতে থাকলে সংক্রমণ ও মৃতু্যর প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে কিনা। সরকার করোনা টেস্ট করার জন্য ফি নির্ধারণ করেছেন- যা এতকাল ছিল না। এর ফলেও কি টেস্টের সংখ্যা ক্রমেই কমে আসছে না এবং করোনা নিয়ন্ত্রণ-নিরাময়ের ক্ষেত্রে কি তা বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে না? করোনা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন, করোনা সংক্রমণ কোনো লক্ষণ উপসর্গ ছাড়াও হতে পারে। তা হলে ৬৪টি জেলার সব করোনা পরীক্ষার কিট বা ব্যবস্থা না থাকা এবং পিসি আর ল্যাব সর্বত্র স্থাপন না করায় বস্তুত আমরা করোনার সংক্রমণ ও মৃতু্যর সঠিক সংখ্যা আদৌ জানতে পারছি না। তাই এ নিয়ে বিন্দুমাত্র আত্মতৃপ্তিতে না ভুগে বেশি বেশি মানুষের টেস্ট করার ব্যবস্থা সর্বত্র প্রসারিত করা এবং দ্রম্নত সর্বত্র পিসি আর ল্যাব স্থাপন করা অত্যন্ত জরুরি। এ ব্যাপারে তাবৎ দুর্নীতিরও মূল্যোৎপাটন এখনই করতে হবে- নইলে করোনা টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট আসতেই থাকবে এবং মানুষের অহেতুক মৃতু্যও বাড়তে থাকবে। আর এর জন্য সরকারকেই দায়ী থাকতে হবে। সরকারিভাবে জনগণকে পরিপূর্ণভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বলা হচ্ছে কিন্তু এ ব্যাপারেও নিম্নোক্ত প্রশ্নগুলো সঙ্গতভাবেই উলেস্নখ করা যায়- এক. বিগত সাড়ে চার মাসেও কি সারা দেশের হাট-বাজারগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি বেশির ভাগ দোকানদার ও ক্রেতাকে মানতে দেখা গেছে? হাট-বাজারগুলোতে সেরকম কোনো ব্যবস্থা কি রাখা হয়েছে? সিটি করপোরেশন, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদগুলো কি এ ব্যাপারে নূ্যনতম তৎপরতা আজতক কার্যকরভাবে দেখাতে পেরেছে? দুই. যদি তা সম্ভব না হয়ে থাকে তবে ঈদ উপলক্ষে সারা দেশে যে অসংখ্য পশুহাট বসবে সেগুলোতে ক্রেতা-বিক্রেতাদের স্বাস্থ্যবিধি মানাতে কি সংশ্লিষ্টরা আদৌ তৎপর থাকবেন? সরকার কি এ ব্যাপারে নিশ্চিত? তিন. ঈদ মস্ত বড় একটি উৎসব- যাকে কেন্দ্র করে অসংখ্য মানুষ টাকা এবং অন্যান্য কর্মস্থল ছেড়ে ঐতিহ্যগতভাবেই নিজ নিজ এলাকায় যান এবং পশু কোরবানি দিয়ে থাকেন। ফলে সর্বত্র লোক সমাগম এমন হয় যেখানে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা কি আদৌ সম্ভব? এই বিবেচনায় এবং ঈদ পরবর্তী করোনা উলস্নম্ফনের আশঙ্কা এড়াতে এ বছর মানুষ বাঁচানোর স্বার্থে কি কোরবানি বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া যেত না? সৌদি আরব যেখানে এবার পবিত্র হজব্রত পালন নিষিদ্ধ করেছে পৃথিবীর লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের জন্য সেখানে এবার কোরবানি বন্ধ করলে কি পবিত্র ধর্মের প্রতি অবমাননা করা হতো? অন্তত পশুহাট কোথাও বসানো যাবে না বলে আদেশ দিলে? চার. দেশের কোটি কোটি গরিব মুসলমানরা তো কোনোবারই কোরবানি দিতে পারেন না- তবে কি তারা খাঁটি মুসলমান বলে বিবেচিত হবেন না? পাঁচ. লাখ লাখ বস্তিবাসী কি স্বাস্থ্যবিধি মানার ও কোরবানির আর্থিক ক্ষমতা রাখেন? তারা কি বস্তিতে সামাজিক দূরত্ব মানতে পারছেন? এবারে আসা যাক স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি প্রসঙ্গে- শুরুতেই স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্য সচিব ও মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তরের প্রধান কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ জানাতে হয় এই কারণে যে বাংলাদেশের করোনা টেস্ট ও তার সার্টিফিকেট আজ তাদের কল্যাণে আন্তর্জাতিক শিরোনামে উত্তরণ ঘটিয়েছে। আরও ধন্যবাদ জানাতে হয় তাদের খুঁটির জোর দেখে। যে খুঁটির জোরে তারা এতদিনেও পদচু্যত হননি। অনেকে দাবি করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ তাদের সবার পদত্যাগের। আমি চাই পদচু্যতি-পদত্যাগ নয় কারণ বহুদিন ধরে তারা মারাত্মক দুর্নীতি চালিয়ে আসছেন-কিংবা চালিয়ে আসতে সহায়তা করছেন। তারপরও তারা দিব্যি নিজ নিজ গদিতে বসে আনে। যারা সরাসরি দুর্নীতি করছে- তাদের চেয়ে যিনি বা যারা তাদের দুর্নীতিবাজ হিসেবে গড়ে তুলছেন বা গড়ে উঠতে সহায়তা করছেন তারা কি করে আজও শাস্তির বাইরে দিব্যি রয়ে যাচ্ছেন? দুর্নীতি বহু দেশেই হয়। করোনা নিয়ন্ত্রণে কোনো কোনো দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। এ নিয়ে সেসব দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোতে তাদের সমালোচনা প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা পদত্যাগ করেছেন? আর আমাদের দেশে? পদত্যাগ তো দূরের কথা-পত্রিকায় রিপোর্ট করার দায়ে সাংবাদিক ও সংবাদপত্রকেই উপর মহল থেকে কখনো কখনো নানা ভাষায় আক্রমণ করা হয়ে থাকে এমনকি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে জেলে পাঠিয়ে যধৎধংং ও করা হয় অনেক ক্ষেত্রে। কিন্তু সত্যকে এড়ানো যাবে কীভাবে? ওই যে বাজারে জাল মাস্ক, পিপিই প্রভৃতি যারা সরবরাহ করছে, সরবরাহ করছে বেশি দামে হাসপাতালগুলোতে সেগুলো যারা 'অলরাইট' লেবাস লাগিয়ে কিনে নিচ্ছেন বা কিনতে সহায়তা করছেন- কীভাবে তারা নিরাপদ থেকে যাচ্ছেন? জানি, এমন প্রশ্ন উত্থাপন করে হয়তো কোনো লাভ হবে না কারণ দুর্নীতির শিকড় আমাদের দেশে অনেক গভীরে। আর আছে আমলাদের রক্ষাকবচ (ইমিউনিটি) আইন। তাই জনগণ অসহায়। সবকিছুর অসহায় শিকার এ দেশের জনগণই। কিন্তু জনগণ যেদিন রুখে উঠবেন? যেদিন স্স্নোগানে স্স্নোগানে রাজপথগুলো মুখরিত করে তুলবেন- সেদিন দুর্নীতিবাজরা মুখ লুকোবেন কোথায়? অতীতেও তারা সফল হননি, বর্তমানেও সফল হবেন না, ভবিষ্যতেও না। সাহেদ-সাবরিনাদের শাস্তি চাই, শাস্তি চাই সব রাঘব-বোয়ালদেরও। জিজ্ঞাসাবাদে তারা এ পর্যন্ত যাদের নাম প্রকাশ করেছে- সেগুলোও প্রকাশ করা হোক। জনগণকে সুযোগ দেওয়া হোক তাদের চিনতে। রণেশ মৈত্র : সাংবাদিক, রাজনীতিক ও কলাম লেখক