শেখ কামাল: ক্রীড়াঙ্গনের উজ্জ্বল এক নক্ষত্রের কথা

দেশের ক্রীড়াঙ্গনে শেখ কামাল নামটি সত্যিই অন্যরকম এক মাধুর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিন্দুকেরা যাই বলুক না কেন- শেখ কামাল এ দেশের ক্রীড়াঙ্গনে আধুনিকতার অন্যতম রূপকার। বেঁচে থাকলে তার হাতের ছোঁয়ায় এ দেশের ক্রীড়াঙ্গন যে আরও সমৃদ্ধ হতো এতে কোনো সন্দেহ নেই।

প্রকাশ | ০৫ আগস্ট ২০২০, ০০:০০

জাহিদ রহমান
দেশের ক্রীড়াঙ্গনে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামাল। মাত্র ২৬ বছর বেঁচে ছিলেন তিনি। কিন্তু এই ছোট্ট জীবনে দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে উচ্চমাত্রায় নেওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা প্রোথিত ছিল তার মধ্যে। খেলাধুলোর বাইরে তিনি নিজেকে কখনই ভাবতেন না। তার ক্রীড়া দর্শনটাও ছিল আবেগের চেয়ে বাস্তবতায় পরিপূর্ণ। আর তাই তো ক্রীড়াঙ্গনে আধুনিকতা যুক্ত করার স্বপ্ন শুরুতেই দুচোখ ভরে দেখেছিলেন। আজ ৫ আগস্ট আবাহনীর প্রতিষ্ঠাতা শেখ কামালের জন্মবার্ষিকী। ১৯৪৯ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এই ক্রীড়া সংগঠক। আবার ঠিক এ মাসেই ঘাতকের বুলেটে নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন তিনি। তার জন্ম আর মৃতু্য তারিখের ব্যবধান মাত্র দশ দিন। শেখ কামাল অনুরাগীদের কাছে আগস্ট মাসের গুরুত্ব অপরিসীম। আগস্ট এলেই শেখ কামালকে একটু অন্যভাবে মনে করতে হয়। বিশেষ করে রণাঙ্গন থেকে ফিরে এসে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে তার নিবিড় সম্পৃক্ততা, আবাহনী ক্লাবকে আধুনিক ধাঁচে গড়ে তোলা, খেলাধুলোয় আবাহনীকে শীর্ষে নিয়ে যাওয়া, ফুটবলে আধুনিকতার সংযোজন- এসবই শেখ কামালকে অন্যরকম মর্যাদায় অভিষিক্ত করে। আর এ কারণেই ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে এ নামটি ভিন্নতরভাবে উচ্চারিত হয়। '৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ঘাতকদের বুলেটে নির্মমভাবে নিহত হন তার প্রথম পুত্র দেশসেরা ক্রীড়া সংগঠক শেখ কামালও। শেখ কামালকে নিয়ে এ দেশের এক কুচক্রীমহল দিনের পর দিন নানাবিধ কল্প কাহিনী ফেঁদে তার চরিত্রহননের প্রাণান্তকর চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু শেখ কামালের মতো একজন ক্রীড়া সংগঠকের মৃতু্যতে যে এ দেশের ক্রীড়াঙ্গনের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে এই বিষয়টি তার ঘোরশত্রম্নও স্বীকার করতে বাধ্য হবেন। শেখ কামাল এবং তার ক্রীড়াসংশ্লিষ্টতা নিয়ে যারা ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন তাদের কাছে এ বিষয়টি মোটেও অস্পষ্ট নয়, ক্রীড়া নিবেদিত এই মানুষটি দেশের ক্রীড়াঙ্গনে কেবলই দিতে চেয়েছিলেন আধুনিকতার ছোঁয়া। মৃতু্যর আগ পর্যন্ত সে স্বাক্ষরও রেখে যান তিনি। আবাহনী ক্রীড়াচক্রকে চোখের পলকে তিনি জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে এসেছিলেন। শাহীন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ক্লাসমেট আর ক্রিকেট মাঠের ঘনিষ্ঠ বন্ধু দেশের কিংবদন্তী ফটুবলার কাজী সালাউদ্দিনকে হৃদয়বন্ধন দিয়ে তিনিই টেনে এনেছিলেন আবাহনী ক্লাবেই। আবাহনীকে শুধু বাংলাদেশ নয়, এশিয়ার অন্যতম এক ক্লাবেও পরিণত করতে চেয়েছিলেন তিনি। আর তাই মৃতু্যর আগের দিনও আবাহনী ক্লাবের নতুন ভবনে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সামনে সেই অভিপ্রায়ই ব্যক্ত করেছিলেন। আজ আবাহনী ক্লাবটি যেখানে দাঁড়িয়ে ওখানে তখন নতুন ভবন হচ্ছিল। ১৪ আগস্ট সর্বশেষ নতুন ক্লাব চত্বরে দাঁড়িয়ে বন্ধু আর ক্লাব সহযোদ্ধাদের বলেছিলেন এখানে একটি পরিপূর্ণ সমন্বিত ক্রীড়া কমপেস্নক্স গড়ে তুলবেন। শুধু তাই নয়- বন্ধুদের এও বলেছিলেন, আবাহনী ক্লাবে তার স্ত্রী সুলতানা খুকীও নিয়মিত বসবে। তার ইচ্ছা ছিল সুলতানাকে দিয়ে আবাহনী ক্লাবের একটি 'আবাহনী উইমেন উইং' সেকশন গড়ে তুলবেন। নারী খেলোয়াড় তৈরিতে যে উইং মুখ্য ভূমিকা করবে। কামাল সতীর্থদের এও বলেছিলেন শুধু ছেলেদের কথা ভাবলে হবে না, মেয়েদের কথাও ভাবতে হবে। শেখ কামাল যে এক অসাধারণ ক্রীড়া সংগঠক ছিলেন তা সন্দেহাতীত। তার জাদুকরী সাংগঠনিক দক্ষতার কারণেই আবাহনী ক্রীড়াচক্র (বর্তমানে আবাহনী লি.) এক আধুনিক এবং জনপ্রিয় ক্লাবে পরিণত হয়েছিল। শেখ কামাল এবং আবাহনী তাই অভিন্ন এক নাম। এই ক্লাবের প্রতিটি কণায়, স্মৃতিতে জড়িয়ে আছে শেখ কামালের নাম। ছাত্রজীবনেই শেখ কামাল এই ক্লাবটিকে তার হৃদয়ের সঙ্গে বেঁধে নিয়েছিলেন। এর পেছনে অবশ্য সঙ্গত কারণও ছিল। শেখ কামালের সতীর্থদের কাছ থেকে জানা গেছে, ছাত্রজীবনে শেখ কামাল আপাদমস্তক একজন খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি নিয়মিত ক্রিকেট, বাস্কেটবল এবং ভলিবল খেলতেন। কাজী সালাহউদ্দিনসহ অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে ধানমন্ডি ও সোবহানবাগ মাঠেই তিনি বেশি খেলতেন। স্বভাবতই তখন ধানমন্ডি, কলাবাগান এলাকার খেলোয়াড়, ক্রীড়া সংগঠকদের সঙ্গে তার ছিল মধুর সম্পর্ক। আবার জাতির পিতা শেখ মুজিবের মতো নেতার ছেলের খেলোয়াড় হওয়ার কারণে অগ্রজেরা বড় বেশি তাকে স্নেহ করতেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের আগেই শেখ কামাল তরুণ সংগঠক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি প্রথম ধানমন্ডি ক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরের বছরই শেখ কামাল আবাহনী সমাজ কল্যাণ সমিতির সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। ওই সময় বর্তমান যে আবাহনী লি. তার নাম ছিল আবাহনী সমাজ কল্যাণ সমিতি। আবাহনী সমাজ কল্যাণ সমিতি গঠিত হয় ৬৬ সালের মার্চ মাসে। প্রতিষ্ঠা লগ্নে আবাহনী সমাজ কল্যাণ সমিতির সভাপতি ছিলেন- গোলাম আওলিয়া তালুকদার এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন হারুনুর রশিদ। সে সময় আবাহনী সমাজ কল্যাণ সমিতি গঠনে মুখ ভূমিকা পালন করেন- বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তায় থাকা বাচ্চু, ওমর, মাহফুজ, হারুন, সেন্টু, শফি, মঞ্জু, বাদল, বাবলু, জিলু, ফিরোজ, মাসুম, খোকা, মোশাররফ, ফারুক, কমলসহ আরও অনেকে। জানা যায়, ওই সময় আবাহনীর সঙ্গে শেখ কামালের সম্পৃক্ততা গড়ে তোলার ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন তার পিতা শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই। একদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজে ছেলে শেখ কামালকে ডেকে বলেন, সে যেন আবাহনীর সমাজ কল্যাণ সমিতির সঙ্গে যুক্ত হয়। এরপর শেখ কামাল আবাহনী সমাজ কল্যাণ সমিতিতে যুক্ত হলে এক নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়। শেখ কামাল আবাহনী সমাজ কল্যাণ সমিতির নেতৃত্বে আসার পরপরই প্রথমবারের মতো আবাহনী সংশ্লিষ্ট মাঠে আয়োজন করেন 'তোফাজ্জেল হোসেন মানিক মিয়া' স্মৃতি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। জানা যায়, আজকের যে আবাহনী মাঠ ওখানে সরকারের পক্ষ থেকে ২২ জন সিএসপির নামে পস্নট বরাদ্দের আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন স্থানীয় খেলোয়াড় ও ক্রীড়া সংগঠকরা। বিষয়টি সুকৌশলে রুখে দিতেই সে সময় আয়োজন করা হয় 'তোফাজ্জেল হোসেন মানিক মিয়া' স্মৃতি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। এই টুর্নামেন্ট শেখ জামাল ইলেভেন ক্রিকেট টিম নামে একটি দলও অংশগ্রহণ করে। এই দলটি গড়তে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন শেখ কামালের ক্রীড়া মাঠের বন্ধু বরকত-ই খোদা। সোবহানবাগ মাঠে ক্রিকেট খেলতে গিয়েই যার সঙ্গে শেখ কামালের বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। এদিকে ৭০ সালে দেশে বন্যা হলে ক্লাবের সবাইকে নিয়ে ত্রাণ তৎপরতায় অংশ শেখ কামাল। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ক্লাবের সবাইকে নিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। নিজে সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত হয়ে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করে শেখ কামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবনে ফিরে আসেন। নিজেকে আরও ব্যাপকমাত্রায় খেলাধুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত করেন। এদিকে আবাহনী সমাজ কল্যাণ সমিতি মূলত আবাহনী ক্রীড়াচক্র নামে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে ৭১ সালেই। জানা যায়, ওই বছর প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে নিজের কোনো একটি ফুটবল দলকে খেলানোর অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন শেখ কামাল। কিন্তু সরাসরি এরকম কোনো সুযোগ না থাকায় প্রথম বিভাগে ওঠা মোহাম্মদপুরের ইকবাল স্পোর্টিং ক্লাবের সব স্বত্ব কিনে নেন শেখ কামাল এবং আবাহনী ক্রীড়াচক্র নামে নতুন ক্লাব রেজিস্ট্রেশন করান। এসময় তিনি পাশে পান্না, হারুন, মন্টু, তারেক, জিলানী, শাহান, বরকত, আলী ইমাম, সেন্টু, বুলু, জামাল, শাহরিয়ারসহ আরও অনেককে সহযোগী হিসেবে পান। এসময় শেখ কামালের অনুপ্রেরণায় এ সময় বঙ্গবন্দুকন্যা শেখ হাসিনা, শেখ রেহানাসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের আরও অনেকেই এই ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হন। উলেস্নখ্য, এসময় আবাহনী ক্লাব ছিল ধানমন্ডি ১৯ নম্বর রোডে, ওখান থেকেই সব কার্যক্রম পরিচালনা হতো। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে শেখ কামালের নেতৃত্বেই আবাহনী ফুটবলে দারুণ সাফল্য দেখাতে সক্ষম হয় এবং দ্রম্নতই এই ক্লাবটি সর্বমহলে জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে। আবাহনী ক্লাবকে প্রাণের চেয়েও ভালোবাসতেন শেখ কামাল। আর তাই মৃতু্যর আগের দিনও ১৪ আগস্ট স্ত্রীকে নিয়ে তিনি নতুন ক্লাব ভবনে এসেছিলেন। জানা যায়, ১৪ আগস্ট সন্ধ্যায় শেখ কামাল স্ত্রী সুলতানাসহ ক্লাবে আসেন। সে সময় ক্লাব প্রাঙ্গণে উলেস্নখযোগ্যদের মধ্যে ছিলেন- হারুনুর রশিদ, ইকবাল হাসান টুকু, শেখ মারুফ, ফারুক, বাচ্চু, ক্যাপ্টেন কাদেরসহ আরও কয়েকজন। এসময় ক্লাব চত্ব্বরে দাঁড়িয়ে খেলাধুলো নিয়ে অনেক স্বপ্নের কথা বলেন শেখ কামাল। মিটিং শেষ করে শেখ কামাল স্ত্রী অ্যাথলেট সুলতানাকে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে যান। এটিই ছিল শেখ কামালের সর্বশেষ আবাহনী ক্লাবে আসা। এদিকে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর আবাহনী ক্লাবের ওপর দিয়ে নানা সময়ে নানাভাবে ঝড়-ঝাপটা বয়ে গেছে। আর সেসব ঝড়-ঝাপটা শেখ কামালের বন্ধু, সহযোগী, ভক্তরা অনেক কিছু মাথায় নিয়ে সামাল দিয়েছেন। ১৫ আগস্টের পর আবাহনী ক্লাব সেনাবাহিনী কর্তৃক লুটপাট হয়। শুধু এই নয়, পঁচাত্তর পরবর্তীতে ফুটবল লীগেও তাদের অংশ নিতে হয় বিরাট ঝুঁকি নিয়ে। কিন্তু কোনো কিছুই দমাতে পারেনি শেখ কামাল ভক্তদের। দেশের ক্রীড়াঙ্গনে শেখ কামাল নামটি সত্যিই অন্যরকম এক মাধুর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিন্দুকেরা যাই বলুক না কেন- শেখ কামাল এ দেশের ক্রীড়াঙ্গনে আধুনিকতার অন্যতম রূপকার। বেঁচে থাকলে তার হাতের ছোঁয়ায় এ দেশের ক্রীড়াঙ্গন যে আরও সমৃদ্ধ হতো এতে কোনো সন্দেহ নেই। জাহিদ রহমান : লেখক, ফ্রি-ল্যান্স সাংবাদিক