করোনাকালে পুলিশের মানবিকতা

পুলিশের ওপর যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তা পালনে তারা সচেষ্ট থাকবেন। আগামী দিনে মানুষের সুখে-দুঃখের সঙ্গী হবেন, এ প্রত্যাশাই করছি। এ চাওয়াটা দেশের আপামর জনতারও।

প্রকাশ | ১০ আগস্ট ২০২০, ০০:০০

মীর আব্দুল আলীম
বিরাজমান করোনাকালে সম্মুখযোদ্ধার ভূমিকায় পুলিশ সদস্যরা। বাংলাদেশ পুলিশের অনবদ্য ভূমিকায় সারাদেশে এবার বেশ প্রসংশা পেয়েছে। নানা কারণে নেতিবাচক খবরের বিষয়বস্তু হওয়ায় জনমানসে পুলিশ সম্পর্কিত যে ভীতিপ্রদ ভাবমূর্তি ছিল মাত্র তিন/চার মাসেই এই দুঃসময়ে পুলিশ মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছে- তা বলা যায়। এ দুর্যোগে বাংলাদেশ পুলিশের বহুমুখী মানবিক ভূমিকা মুগ্ধতা জাগানিয়া, বিস্ময়কর এবং অনুপ্রেরণাদায়ীও। এ কারণে আন্তর্জাতিকভাবেও বাংলাদেশে পুলিশের প্রশংসা করা হচ্ছে। বিদেশি মিডিয়ায় পুলিশের ভালো কাজগুলো স্থান পাচ্ছে। শত দুর্নাম ঘুচিয়ে জীবন বাজি রেখে, জীবন দিয়ে পুলিশ যে জনগণের বন্ধু তা প্রমাণ করেছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও পুলিশের প্রসংশা করেছেন। সত্যিই করোনাকালে পুলিশের বিচিত্র ও চমৎকার সব কার্যক্রমে সব দুর্নাম যেন ঘুচতে চলেছে। পুলিশ জনবান্ধব হচ্ছে। আর তা হওয়া খুব জরুরিও বটে। কথা হলো বাংলাদেশ পুলিশের এ সুনাম ধরে রাখা যাবে কি? যখন করোনা থাকবে না, তখন কী হবে? পুলিশ কি আগের অবস্থায় ফিরে যাব? পুলিশের নয়া আইজিপি বলেছেন, পুলিশ যেখানে গিয়েছে সেখান থেকে আর ফিরে আসবে না। সেখান থেকে আরও এগিয়ে যাবে পুলিশ। মানুষের ভালোবাসা, সম্মান, শ্রদ্ধার যে জায়গা তৈরি হয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ তা ধরে রাখবেই। আইজিপির কথায় আমরা আশ্বস্তও হতে পারি। পুলিশ জনবান্ধব না হলে জনগণের জন্য তা কষ্টের, দেশের জন্যতো বটেই। করোনাকালে পুলিশ- জনগণের মাঝে যে বন্ধন তৈরি হয়েছে তা যেন অটুট থাকে এই প্রত্যাশা এখন সবার। একটু পেছনে ফিরে যাই। পুলিশ দুঃসময়ে দেশের ও জনগণের জন্য যে কাজ করে তার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধেও পুলিশ তাদের দেশপ্রেমের প্রমাণ দিয়েছে। পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিহত করতে প্রথম জীবন দিয়ে ছিল এই পুলিশবাহিনীর সদস্যরা। কিছু দুর্নীতিবাজের কারণে ভালো কাজগুলো ম্স্নান হয় সব সময়। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ পুলিশে সৎ, নিষ্ঠাবান এবং দেশপ্রেমী সদস্য রয়েছেন। ঊর্ধ্বতন পুলিশে এখন পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তারা স্থান পাচ্ছেন। যার সুফল মিলতে শুরু করেছে। আমার জানা মতে একজন ডিআইজি মর্যাদার কর্মকর্তা নিজের জন্য একটি ভালো বাড়ি পর্যন্ত করতে পারেননি। তিনি সততার সঙ্গে পুলিশ বিভাগের দুর্নাম ঘুচাতে এবং পুলিশকে জনবান্ধব করতে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ পুলিশে এখন এমন অনেক কর্মকর্তা খুঁজে পাওয়া যায়। যার কারণে পুলিশ জনবান্ধব হচ্ছে। দেশের স্বার্থে যে কোনো মূল্যে পুলিশকে আস্থার জায়গায় ফিরে আসতেই হবে। বলছিলাম পুলিশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের কথা। হলিআর্টিজানে জঙ্গি হামলাকে পরাস্ত করতে একাধিক পুলিশ অফিসারকে জীবন দিতে হয়েছিল। বাংলাদেশের জঙ্গি দমনে পুলিশের ভূমিকা সারা বিশ্বে নন্দিত। বাংলাভাই থেকে শুরু করে সব জঙ্গি দমনে সফলতা দেখিয়েছে পুলিশ। ৫ মে হেফাজতের তান্ডবকে প্রতিহত করে ঢাকা মহানগরীর শান্তি বজায় রাখতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে। তারপরও কিছু অপেশাদার অসৎ পুলিশের বিতর্কিত ভূমিকায় গৌরব প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তবে এবার করোনাযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা সারা বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশকে এই জায়গাটা ধরে রাখতেই হবে। ২০২০-এর পুলিশ সপ্তাহের প্রতিপাদ্য বিষয়টা আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। তা ছিল 'মুজিববর্ষে অঙ্গীকার, পুলিশ হবে জনতার'। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আসলে পুলিশকে জনতারই হতে হবে। জনগণ যেন আস্থা পায়, বিশ্বাস পায়, পুলিশের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারে। সেই কাজটি করতে হবে। বর্তমানে করোনাভাইরাসের সংকটকালে বাংলাদেশ পুলিশ এখন জনতার পুলিশের ভূমিকায় কাজ করে যাচ্ছে। পুলিশ বিভাগ যেভাবে কাজ করে যাচ্ছে ইতিমধ্যে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের হৃদয় জয় করতে সক্ষম হয়েছে। করোনা পরিস্থিতির শুরু থেকেই পুলিশ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম, সরকার ঘোষিত লকডাউন নিশ্চিতকরণ, লাশ দাফনসহ বিভিন্ন জরুরিসেবা প্রদানে বাংলাদেশ পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। যাই বলি না কেন, এ দেশে চাইলেও সব কিছু পুরোপুরি সঠিকভাবে করা যায় না। লকডাউনের প্রথম দিকে পুলিশ এবং জনপ্রশাসন ছিল হার্ড লাইনে। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পুলিশের হার্ডনেসকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে পুলিশ তথা প্রশাসনের ভাবমূতি নষ্টের পাঁয়তারায় নামে কতক মানুষ। মানুষকে ঘরে রাখার জোরপূর্বক বা নিবর্তনমূলক পুলিশিং কার্যক্রম পরিচালনার ছবি-ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পরিপ্রেক্ষিতে সমালোচনা হলে বাংলাদেশ পুলিশ সেই স্ট্যাটেজি থেকে সরে আসে। এতে দেশের বেশ ক্ষতিও হয়েছে। ওই সময় লকডাউনটা সঠিকভাবে পালন করা গেলে করোনা পরিস্থিতি অনেক আগেই হয়তো নিয়ন্ত্রণে চলে আসতো। এটা বলতেই হয় করোনাকালে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট সচেষ্ট ছিল। আর তা করে তারা প্রসংশিতও হয়েছে। আগে বলা হতো পুলিশ জনগণের বন্ধু। অনেক ক্ষেত্রেই প্রচলিত কথাটির প্রমাণ মিলতো না। পুলিশ কখনো কখনো জন আতঙ্কের কারণ ছিল। বর্তমান সময়ে তা বাস্তবে পরিণত হয়েছে। পুলিশ জনগণের বন্ধু হতে শুরু করেছে। কেবল এই ধারাবাহিকতাটা ধরে রাখা গেলেই পুলিশ জনগণের বন্ধু হয়েই থাকবে সব সময়। পুলিশ কীভাবে এলো। ব্রিটিশরা তাদের উপনিবেশ এলাকায় পুলিশি ব্যবস্থা চালু করে, তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল এ দেশীয় মানুষকে দমন করা। তাদের শাসন ব্যবস্থাকে মজবুত করা। দুইশ বছরের ব্রিটিশ শাসন, চব্বিশ বছরের পাকিস্তানি শাসন, স্বাধীন বাংলাদেশে জিয়া, এরশাদ, খালেদা এমনকি বর্তমান সরকারও যেভাবে পুলিশকে দলীয় লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ভিন্নমতকে প্রতিহত করতে অপব্যবহার করেছে। সেই ট্র্যাডিশন থেকে বের হতে একটু সময়তো লাগবেই বটে। তবে আশার কথা বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশকে মানবিক পুলিশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। নিস্বার্থভাবে তা অব্যাহত রাখতে পারলে দেশের জন্য মঙ্গল হবে বৈকি! আধুনিক নগরায়িত পুলিশের আঁতুরঘর হিসেবে ইংল্যান্ডকে বিবেচনা করা হয়। পুলিশের উৎপত্তি যেখানেই হোক না কেন, আইনিকাঠামো অনুযায়ী পুলিশ হলো এমন একটা সরকারি আইনপ্রয়োগকারী বাহিনী, যারা জনগণের স্বাস্থ্য, সম্পদ এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি অপরাধ এবং সমাজিক বিচু্যতি প্রতিরোধ করে। অপরাধ বিশ্লেষণ, গ্রেপ্তার এবং টহলের বাইরেও পুলিশ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করে থাকে- যেমন জাতিসংঘে। বাংলাদেশ পুলিশের আরেকটু ভিন্নতা আছে। তারা অপরাধ ব্যবস্থাপনার বাইরেও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন সামাজিক দায়িত্ব পালন করে থাকে- যা বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে অনেক বেশি দৃশ্যমান আছে। আইনের বাইরে থেকে স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ রোধ, ছেটখাটো বিষয়গুলো যা আদালতে গড়ালে হয়তো বড় আকার ধারণ করবে সেসব বিষয়ের সমাধান অন্তরালে থেকে পুলিশকেই দিতে হয়। বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমাদের সবার কাছে পুলিশের নানাবিধ কর্মকান্ড চোখে পড়ে। অনেকে পুলিশের এই কর্মকান্ডের জন্য 'মানবিক পুলিশ' শব্দটিও ব্যবহার করছে- যা জনগণের কাছে পুলিশকে প্রশংসিত করেছে। আবার এর উল্টোটাও কিন্তু আছে। কতক অমানবিক পুলিস সদস্যের কারণে পুলিশের ভাবমূতি নষ্ট হওয়াতো মামুলি বিষয়। তারপরও বলব প্রচলিত ধারণার বিপরীতে করোনাকালে পুলিশের সবক্ষেত্রে অংশগ্রহণ ও বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে অগ্রণী ভূমিকা পুলিশের ভাবমূর্তি সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করেছে। পুরো বিশ্বেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ে মানুষের ধারণা সুখকর নয়। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়েও সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা রকম ধারণা, ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। সম্প্রতিকালের দুটি বিষয় সামনে আনছি। করোনাকালে আমাদের দেশের পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা কয়েক মাসে পুলিশ সম্পর্কে ধারণাই বদলে দিয়েছে। বিশ্বের প্রচার মাধ্যমগুলোতে ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছে তা। অতিত নিকটে তার ঠিক উল্টোটা ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশ কর্তৃক। একজন কৃষাঙ্গ নাগরিক হত্যার পর শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়, একই সঙ্গে পুরোবিশ্বকে চরমভাবে নাড়া দিয়েছিল। প্রশ্নবিদ্ধ করেছে পুলিশবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে। এমন সময় আমাদের পুলিশ মানবিক হয়ে মানুষের পাশে থেকে যেভাবে কাজ করে যাচ্ছে তা কখনই ভুলার নয়। করোনাকালের শুরুতে যখন হাসপাতালে ডাক্তার মিল ছিল না; দাফন করার মানুষ পাওয়া যাচ্ছিল না। ছেলে বাবা-মার, বাবা-মা ছেলের কাছে যেতে ভয় পেত পুলিশ তখন মানুষের পাশে ছিল। তাই এ সময় পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাই বেশি আক্রান্ত হন। বিশেষ করে করোনাকালে আমাদের পুলিশের মানবিক এই ভূমিকায় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে পুলিশবাহিনী বীর সদস্যদের স্যালুট জানাই। এটাও আশা করি, তারা যেন তাদের এই সাফল্য, এই সুনাম ধরে রাখে। পুলিশের ওপর যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তা পালনে তারা সচেষ্ট থাকবেন। আগামী দিনে মানুষের সুখে-দুঃখের সঙ্গী হবেন, এ প্রত্যাশাই করছি। এ চাওয়াটা দেশের আপামর জনতারও। মীর আব্দুল আলীম : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গবেষক