বাড়ছে ব্যয় কমছে মান

উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দানের পাশাপাশি দক্ষ, মেধাবী ও সঠিক যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের শিক্ষকতার পেশায় আকৃষ্ট করতে শিক্ষকদের বেতন কাঠামো ও সুযোগসুবিধা বৃদ্ধি ও বেতন বৈষম্য দূর করার বিষয়ে বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

প্রকাশ | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০

ড. হারুন রশীদ
বতর্মানে সারাদেশে কোচিং বাণিজ্যের দৌরাত্ম্য কোন পযাের্য় পৌঁছেছে, তা শিক্ষাথীর্ ও অভিভাবকরা ভালোভাবেই জানেন। কোচিংয়ের নামে প্রতিষ্ঠানগুলোয় দুনীির্তসহ নানা অনৈতিক কাযর্কলাপ চলে। অনেক শিক্ষক কোচিং ও প্রাইভেট টিউশনির সঙ্গে অতিমাত্রায় জড়িয়ে পড়ায় ভালোভাবে ক্লাস নেন না। শিক্ষাথীের্দর কোচিংয়ে প্রলুব্ধ করেন। যারা কোচিং করে, পরীক্ষায় তাদের বেশি নম্বর দেন। এসব অভিযোগ তো আছেই, কিছু শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোচিংয়ের সুযোগে ছাত্রীদের ওপর যৌন নিযার্তন চালানোর মতো গুরুতর অভিযোগও উঠেছে বিভিন্ন সময়। এ ছাড়া বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফঁাসের সঙ্গেও কোনো কোনো কোচিং সেন্টার জড়িত বলে অভিযোগ আছে। কোচিংয়ের আড়ালে বিভিন্ন ধমির্ভত্তিক রাজনৈতিক দলের মতাদশর্ প্রচারের অভিযোগ অনেক পুরনো। এসব কারণে সমাজে কোচিং ব্যবসা বন্ধের দাবি দীঘির্দনের। বিভিন্ন সময়ে শিক্ষামন্ত্রী নিজেও কোচিংকে অনিয়ম, দুনীির্ত ও অনৈতিক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তবে তিনি বলেছেন, ক্লাসে ঠিকমতো পড়াশোনা হয় না। ক্লাসে পুরো শিক্ষা শেষ করা হলে কোচিং বন্ধ হয়ে যাবে। তিনি বাস্তবতার নিরিখে একথা বলেছেন সন্দেহ নেই। তবে কোচিংয়ের দ্বার অবারিত রেখে ক্লাসে ঠিকমতো পড়াশোনা নিশ্চিত করা সম্ভব কি-না, সে প্রশ্ন থেকেই। কোচিং বাণিজ্য আজ এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে, তা ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামগঞ্জেও। এটা বিশেষ করে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পযাের্য় বিষফেঁাড়ার আকার ধারণ করেছে। অনেকে মনে করেছিলেন, সৃজনশীল পদ্ধতির প্রচলনে কোচিং বাণিজ্য নিরুৎসাহিত হবে কিন্তু সৃজনশীল পদ্ধতিতে কোচিং আরও জেঁকে বসেছে। এখন স্কুল কতৃর্পক্ষই ভালো রেজাল্টের উসিলায় নিজেরাই স্কুল কোচিং চালু করেছে। স্কুল শেষ করে আবার কোচিং। এটা অনেকটা বাধ্যতামূলক। বিশেষ করে পঞ্চম ও ৮ম শ্রেণির শিক্ষাথীের্দর জন্য। পিএসসি ও জেএসসিতে ভালো ফল করার প্রতিশ্রæতি দিয়ে বিভিন্ন স্কুল স্কুলের ভেতরেই কোচিং চালু করেছে। এতে শিক্ষাথীের্দর ওপর চাপ তো বাড়ছেই অভিভাবকদেরও বাড়তি পয়সা গুণতে হচ্ছে। সবচেয়ে অবাক করার মতো ব্যাপার হচ্ছে স্কুলের কোচিংও অনেকটা নিয়ম রক্ষার। সেখানে তেমন পড়াশোনা হয় না। এরপর আবার প্রাইভেট কোচিংয়ে পড়তে হয়। ফলে একজন শিক্ষাথীর্ সকালে স্কুলে গিয়ে ফিরে সন্ধ্যায়। এটা যে কোমলমতি শিক্ষাথীের্দর জন্য কত বড় চাপ সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ছাড়া শিক্ষা ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে কয়েকগুণ। (অভিভাবকরা হিমশিম খাচ্ছে খরচ চালাতে।) কিন্তু সে অনুযায়ী শিক্ষার মান বাড়ছে না। বাস্তবতা হচ্ছে কোচিং নিষিদ্ধ থাকলেও তা থেমে নেই। সরকার যদি প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ক্লাসে ভালোভাবে পড়ানোর বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে এমনিতেই কোচিং নিরুৎসাহিত হবে। সেক্ষেত্রে শিক্ষকদের হতে হবে শিক্ষাথীর্র প্রতি যথেষ্ট যতœশীল। দুবর্ল শিক্ষাথীর্র প্রতি দিতে হবে বিশেষ দৃষ্টি। প্রয়োজনে ক্লাসের বাইরে বা বিশেষ ক্লাস নিয়ে তার ঘাটতি পূরণ করতে হবে। এ জন্য তার কাছ থেকে অথর্ নেয়া চলবে না, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নিজ দায়িত্বেই এটা করতে হবে। এক্ষেত্রে মূল দায়িত্বটি অবশ্যই শিক্ষকের। কারণ তারাই প্রাইভেট বা কোচিংয়ের ক্ষেত্র তৈরির জন্য ক্লাসে অবহেলা করেন। কোচিং বন্ধে দায়িত্ব রয়েছে অভিভাবকদেরও। তারা সন্তানের বেশি নম্বরের আশায় তাকে নিদির্ষ্ট শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়াতে উদ্বুদ্ধ করেন। সেক্ষেত্রে পরীক্ষায় নম্বর বা ফলটাই হয়ে উঠে মুখ্য, সন্তান কতটা মানসম্পন্ন শিক্ষা গ্রহণ করছে তা নিয়ে যেন কারও মাথাব্যথা নেই। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান নিশ্চিত করার স্বাথের্ই কোচিং বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ জরুরি হয়ে পড়েছে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, প্রয়োজনের তুলনায় শিক্ষাখাতে সবসময়ই কম বরাদ্দ দেওয়া হয়। শিক্ষকদেরও পরিবার-পরিজন রয়েছে। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য রক্ষা করতে গিয়ে তারা হিমশিম খান। একশ্রেণির শিক্ষকের নৈতিক অধঃপতনের দায় পুরো শিক্ষক সমাজের ওপর চাপিয়ে দেয়া সমীচীন নয়, আমরা এটা মানি। তাই অধঃপতিত শিক্ষকদের শনাক্ত করাও আজ সময়ের দাবি। কোচিং সেন্টারে মেয়ে শিক্ষাথীের্দর যৌন নিপীড়নের ঘটনাও ঘটেছে। তবে আশার কথা হলো, সমাজ ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। গণমাধ্যম তার সতকর্ দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছে। সম্মিলিতভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করছে সাধারণ মানুষ। আমাদের প্রত্যাশা, বিলম্ব হলেও বাংলাদেশে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। কোচিংয়ের অভিশাপ থেকে জাতি মুক্ত হবে। শিক্ষার মানোন্নয়ন একটি জাতীয় গুরুত্বপূণর্ ইস্যু। শুধু পাশের হার এবং উচ্চতর গ্রেডই শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য নয়, পাশাপাশি নৈতিক মানসম্পন্ন সুনাগরিক হিসেবে শিক্ষাথীের্দর গড়ে তোলাই শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠাগুলো শিক্ষার মান ও শিক্ষাথীর্র নৈতিক মানোন্নয়নের বদলে প্রতিষ্ঠানের পাসের হার ও জিপিএর প্রতি বিশেষ নজর দেয়ায় শিক্ষা ব্যবস্থায় মানহীনতা দেখা দিয়েছে। শিক্ষাথীর্রাই পাস করে শিক্ষকসহ সমাজের গুরুত্বপূণর্ পদে আসীন হন। মানহীন ও নৈতিকতা বিবজির্ত, সাটিির্ফকেট নিভর্র শিক্ষার ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়ার ফলে সমাজে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইভ-টিজিং, শিক্ষকদের মানহীনতা থেকে ছাত্রীদের যৌন নিযার্তন ও হয়রানির মতো ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনা শুধু অনাকাক্সিক্ষত নয়, এটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য কলঙ্কজনক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান ও অভিভাবকদের এ বিষয়ে সচেতন হওয়ার ও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার বিকল্প নেই। তবে এ কথা সত্য যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদানের যথাথর্ মান রক্ষিত না হওয়া এবং শ্রেণিকক্ষেও শিক্ষকদের অমনোযোগিতা ও অদক্ষতার জন্যই ভালো ফলাফলের আশায় শিক্ষাথীের্দর প্রাইভেট কোচিং অথবা টিউশনি এবং কোচিং ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের বেশিরভাগই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক। শিক্ষামন্ত্রীর ভাষায় এসব ঘটনা শুধু অনাকাক্সিক্ষত নয়, এটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য কলঙ্কজনক। এ কথা সত্য যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদানের যথাথর্ মান রক্ষিত না হওয়া এবং শ্রেণিকক্ষেও শিক্ষকদের অমনোযোগিতা ও অদক্ষতার জন্যই ভালো ফলাফলের আশায় শিক্ষাথীের্দর প্রাইভেট কোচিং অথবা টিউশনির দিকে যেতে হয়। এবং কোচিং ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের বেশিরভাগই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক। বতর্মান বাস্তবতায় কোচিং বাণিজ্য বন্ধের পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার মানোন্নয়নে দ্রæত ও কাযর্কর উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষক, ম্যানেজিং কমিটি এবং অভিভাবকদের সক্রিয় তৎপরতা থাকলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সব ধরনের দুনীির্ত, অপতৎপরতা এবং কোচিং ব্যবসায়ের মতো কমর্কাÐ বন্ধ করা সম্ভব। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি, বৈষম্য এবং অসুস্থ প্রতিযোগিতা ও দুনীির্ত বন্ধ করতে হলে কোচিং ব্যবসা এবং শিক্ষকদের প্রাইভেট টিউশনি বন্ধ করতেই হবে। শিক্ষাকে কিছুসংখ্যক লোকের অনৈতিক বাণিজ্যের ধারা থেকে বের করে আনতে মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ, শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে শিক্ষকদের পূণর্ প্রস্তুতি ও মনোযোগ দিতে। কোচিং বাণিজ্য এমন এক পযাের্য় পেঁৗছেছে যে এটা বন্ধ করতে দুনীির্ত দমন কমিশনকেও (দুদক) মাঠে নামতে হয়েছে। এটা একদিকে যেমন পরিস্থিতির ভয়াবহতাকে তুলে ধরছে অন্যদিকে স্বস্তির কারণ যে এর ফলে কোচিং বন্ধে এবার হয়তো এটা কাযর্কর কিছু হতে চলেছে। কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ঢাকার আটটি নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৯৭ শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক চূড়ান্ত সুপারিশ মন্ত্রিপরিষদে পাঠিয়েছে দুদক। একই সঙ্গে বছরের পর বছর ধরে ‘কোচিং বাণিজ্যের’ মাধ্যমে অথর্ উপাজের্নর অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে ‘শাস্তিমূলক’ ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশও করেছে দুদক। এটি অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক ঘটনা। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কোনো বিকল্প নেই। এমপিওভুক্ত চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৭২ শিক্ষক এবং সরকারি চারটি বিদ্যালয়ের ২৫ শিক্ষক কোচিং বাণিজ্যে যুক্ত বলে দুদক প্রমাণ পেয়েছে। এদের বিরুদ্ধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা, ২০১২ অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়েছে- এমনটি শোনা যায়নি। বিশ্বের কোথাও মূলধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি এ ধরনের কোচিং ও প্রাইভেট টিউশনির রমরমা ব্যবসা নেই। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও মনোযোগের বদলে প্রাইভেট টিউশনি ও কোচিং সেন্টারে বেশি সময় দেয়ার পাশাপাশি অনৈতিক পদ্ধতিতে পাবলিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের নিশ্চয়তা দেয়ার কারণে শিক্ষাথীর্ ও অভিভাবকরা সন্তানদের কোচিং সেন্টারে ভতির্ করাতে প্রলুব্ধ অথবা বাধ্য হন। আমাদের শিক্ষাঙ্গন থেকে এ অনৈতিক ব্যবসা বন্ধ করতে শিক্ষাথীের্দর কোচিং সেন্টারে ভতির্ ও খরচ না যোগাতে অভিভাবকদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শিক্ষার মানোন্নয়নে নৈতিক শিক্ষার বিষয়ে গুরুত্ব দেয়ার পাশাপাশি ভিনদেশি অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ রোধে, অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গে সকল সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা রাখতে হবে। নবম পে-স্কেলে শিক্ষকদের বেতন বেড়েছে। তবে তুলনামূলক কম। বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য রয়েই গেছে। এটা দূর করতে হবে যে কোনো মূল্যে। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দানের পাশাপাশি দক্ষ, মেধাবী ও সঠিক যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের শিক্ষকতার পেশায় আকৃষ্ট করতে শিক্ষকদের বেতন কাঠামো ও সুযোগসুবিধা বৃদ্ধি ও বেতন বৈষম্য দূর করার বিষয়ে বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ড. হারুন রশীদ: সাংবাদিক ও কলামিস্ট যধৎঁহথঢ়ৎবংং@ুধযড়ড়.পড়স