শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার জন্ম নিয়ে বলেছেন, তার জন্ম সাধারণ মানুষের মতো নয় এবং তার মৃতু্যও সাধারণ মানুষের মতো নয়। মানুষ জন্মগ্রহণ করে এবং মারা যায় কিন্তু আমি জন্মরহিত হয়েও আবির্ভূত হই এবং অবিনশ্বর হয়েও অন্তর্ধান করে থাকি। আবির্ভূত হওয়া এবং অন্তর্হিত হওয়া দুটিই আমার অলৌকিক লীলা।

প্রকাশ | ১১ আগস্ট ২০২০, ০০:০০

তারাপদ আচার্য্য
গীতার কথামতো ধর্মের গস্নানি এবং অধর্মের বৃদ্ধির তাৎপর্য হলো- ভগবদ্‌প্রেমী, ধর্মাত্মা, সদাচারী, নিরপরাধ এবং মানুষের ওপর নাস্তিক, পাপী, দুরাচার, বলবান ব্যক্তিদের অত্যাচার বৃদ্ধি পাওয়া এবং মানুষের মধ্যে সদগুণ সদাচার অত্যন্ত কমে গিয়ে দুর্গুণ-দুরাচারের অত্যাধিক বৃদ্ধি পায়। শ্রীকৃষ্ণ যখন আবির্ভূত হন তখন পৃথিবীতে বহু ধর্মমত ও উপধর্মমত প্রচলিত ছিল। যে সনাতন যোগধর্ম অনেকবার প্রচারিত হয় এবং লয়ও হয়, শ্রীকৃষ্ণ তাই আবার প্রচলন করলেন। শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বলেছেন, হে অর্জুন, আমার এই দিব্য জন্ম ও কর্ম যিনি তত্ত্বত জানেন, তিনি দেহত্যাগ করে আর জন্মগ্রহণ করেন না, তিনি আমাকেই পেয়ে থাকেন। দ্বাপরে যুগের সন্ধিক্ষণে রোহিণী নক্ষত্রের অষ্টমী তিথিতে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটেছিল এই ধরাধামে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত লীলাকে কেন্দ্র করেই জন্মাষ্টমী উৎসব। ওই সময় অসুররূপী রাজশক্তির দাপটে পৃথিবী হয়ে ওঠে ম্রিয়মাণ, ধর্ম ও ধার্মিকরা অসহায় সংকটাপন্ন অবস্থায় নিক্ষিপ্ত হন। অসহায় বসুমতি পরিত্রাণের জন্য প্রজাপতি ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন। ব্রহ্মার পরামর্শে দেবতারা সবাই মিলে যান দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে পরিত্রাণের উপায় খুঁজে বের করতে। সৃষ্টিস্থিতি ও প্রলয়ের যুগসন্ধিক্ষণে তারা সবাই বিষ্ণুর বন্দনা করেন। স্বয়ং ব্রহ্মা মগ্ন হন কঠোর তপস্যায়। ধরণীর দুঃখ-দুর্দশায় ব্যথিত হয়ে দেবতাদের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি দেবতাদের অভয়বাণী শোনান এই বলে যে, তিনি অচিরেই মানবরূপে ধরাধামে অবতীর্ণ হবেন দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তানরূপে শঙ্খ, চক্র, গদাপদ্মধারী শ্রীকৃষ্ণ নামে। ভগবান বিষ্ণু দেবতাদের নির্দেশ দিলেন তার লীলার সহচর হওয়ার প্রয়োজনে এই ধরণীতে জন্ম নেওয়ার জন্য। ভগবান বিষ্ণুর নির্দেশমতো দেবতারা তাদের স্ব স্ব পত্নীসহ ভগবানের কাঙ্ক্ষিত কর্মে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে যদুকুলে বিভিন্ন পরিবারে জন্ম নিতে থাকেন। এভাবে ভগবানের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য দেবতাদের মর্ত্যলোকে অবতরণ। কৃষ্ণ যখন জন্ম নেন তখন বাসুদেব দেখলেন, শিশুটির চারহাতে শঙ্খ, চক্র, গদা এবং পদ্ম ধারণ করে আছেন। নানা রকম মহামূল্য মণি-রত্ন খচিত সব অলংকার তার দেহে শোভা পাচ্ছে। তিনি বুঝতে পারলেন জগতের মঙ্গলার্থে পূর্ণব্রহ্ম নারায়ণই জন্মগ্রহণ করেছেন তাদের ঘরে। বাসুদেব করজোড়ে প্রণাম করে তার বন্দনা শুরু করলেন। বাসুদেবের বন্দনার পর দেবকী প্রার্থনা শুরু করলেন এবং প্রার্থনা শেষে একজন সাধারণ শিশুর রূপ ধারণ করতে বললেন শ্রীকৃষ্ণকে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার জন্ম নিয়ে বলেছেন, তার জন্ম সাধারণ মানুষের মতো নয় এবং তার মৃতু্যও সাধারণ মানুষের মতো নয়। মানুষ জন্মগ্রহণ করে এবং মারা যায় কিন্তু আমি জন্মরহিত হয়েও আবির্ভূত হই এবং অবিনশ্বর হয়েও অন্তর্ধান করে থাকি। আবির্ভূত হওয়া এবং অন্তর্হিত হওয়া দুটিই আমার অলৌকিক লীলা। গীতাতে স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে আরও বলেছেন, আমি জন্মহীন, অব্যয় আত্মা, ভূতগণের ঈশ্বর (শাসক, নিয়ন্তা শ্রষ্টা) হয়েও নিজ প্রকৃতিকে (অনির্বচনীয় মায়াশক্তিকে) আশ্রয় করে আত্মমায়ায় জন্মগ্রহণ করি। পুরাণে একে ধরাভারহরণ, অসুর-নিধনাদি নামে অভিহিত করা হয়েছে। কিন্তু শুধু এটাই শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্য নয়। বুদ্ধ, খ্রিষ্ট, শ্রীচৈতন্য অনেককেই অবতার বলা হয়, কিন্তু এসব অবতারের অসুর-বিনাশ নেই, এসব অবতারের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে মানবাত্মাকে দিব্য প্রেম-পবিত্রতা-জ্ঞান-ভক্তির অনুপ্রেরণা দেয়। পক্ষান্তরে, পৌরাণিক নৃসিংহাদি অবতারের অসুর-বিনাশ ছাড়া আর বেশি কিছু প্রয়োজন দেখা যায় না। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ অবতারের দুটি উদ্দেশ্য আছে। প্রথমটি হচ্ছে- অন্তর্জগতে মানবাত্মার উন্নতি সাধন ও বাহ্যজগতে মানবসমাজের রাষ্ট্রীয় বা নৈতিক পরিবর্তন সাধন। বেদে বলা আছে ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়, নিরাকার, জ্যোতির্ময়, সর্বত্র বিরাজমান এবং সর্বশক্তিমান। বেদজ্ঞ জ্ঞানী ঋষিরা নিরাকার ঈশ্বরের উপাসনা করে থাকেন। সাধারণ মানুষের পক্ষে নিরাকার ঈশ্বরের উপলব্ধি করা খুবই কঠিন কাজ। তারপরও মানুষই সেই অসাধ্যকে সাধন করছে। মহাকাল ও মহাজগৎ ব্যাপ্ত হয়ে যিনি অনন্ত সর্বশক্তিমান সত্তায় শাশ্বত সত্যরূপে বিরাজিত, আমরা তাকেই ভগবান বলে থাকি। কেবল সনাতনীকল্প মনীষাতেই তিনি অষ্টোত্তর শতনামে সম্ভাসিত হয়েছেন। ভক্তরা তাকে যে নামে ডাকেন, সে নামে তিনি সাড়া দেন। যেভাবে তাকে পেতে চান, সেভাবেই তিনি ধরা দেন। সনাতনী সমাজে তার অবস্থান অনেকটা পরিবারের একজনের মতো। তাই তো তিনি দেবকী ও বাসুদেবের আকুল প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে কংসের কারাগারে তাদের সম্মুখে আবির্ভূত হন পুত্ররূপে, কৃষ্ণনামে। তারাপদ আচার্য্য : সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ